মানবমেলায় মুসলমানদেরও মিলতে হবে

প্যারিস-প্রবাসী সিরীয় কবি আদোনিস । ছবি: সাইফুল ইসলাম
প্যারিস-প্রবাসী সিরীয় কবি আদোনিস । ছবি: সাইফুল ইসলাম

মুসলিম বিশ্বকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকলে চলবে না। এখনো তারা শুধু ব্যবহৃতই হচ্ছে। চিন্তা ও সৃষ্টিশীলতায় বাকি বিশ্বের সঙ্গে বোঝাপড়া না করলে তাদের মুক্তি নেই। প্রথম আলোর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে বললেন আদোনিস। ধোঁয়া ওঠা কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে প্যারিস-প্রবাসী সিরীয় এই কবি আরও বললেন, আরব দেশগুলোর দুর্দশার একটি কারণ তার ক্ষমতাকাঠামো ও রাষ্ট্রনায়কেরা। আরেক কারণ এ যুগের দাবির মুখে নিজেদের ঐতিহ্যকে চ্যালেঞ্জ করতে না পারা। এই পরিস্থিতি বদলানোর জন্য প্রয়োজনে অস্তিত্ব উৎসর্গ করতে হবে।

আদোনিস বাংলাদেশে এসেছিলেন ১৬ থেকে ১৮ নভেম্বরে অনুষ্ঠিত ঢাকা লিট ফেস্টের প্রধান আকর্ষণ হয়ে। আলী আহমাদ সায়ীদ এসবার নামে ১৯৩০ সালের ১ জানুয়ারি সিরিয়ার এক মুসলমান পরিবারে তাঁর জন্ম। বামপন্থী রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন তরুণ বয়সেই। তাঁর চিন্তা ও রাজনীতি বিপজ্জনক হয়ে উঠলে তাঁকে কারাগারে বন্দী করা হয়। ১৯৫৬ সালে মুক্তি পেয়ে তিনি দেশত্যাগ করে লেবাননে আশ্রয় নেন। আদোনিস ছদ্মনামে নতুন ও প্রথাবিরোধী আরব কবিতার প্রবক্তা হয়ে উঠেছিলেন যুবা বয়সেই। লেবাননের গৃহযুদ্ধের পটে ১৯৮০ সাল থেকে স্থায়ীভাবে আবাস গড়েন প্যারিসে। সাহিত্যের সম্ভাব্য নোবেল প্রার্থী হিসেবে আদোনিস গত কয়েক বছর একটি নিরবচ্ছিন্ন নাম।

কবিতাই আদোনিসের রাজপথ। তাঁর আলাপে তাই রাজনীতির সঙ্গে ফিরে ফিরে এল কবিতার কথা। কবিতায় তিনি দেখেন পুরোনো পৃথিবীর নতুন করে তুলে ধরা এক চেহারা। কারণ, চারপাশের পৃথিবীর সঙ্গে কবিতা আমাদের সম্পর্ককে নবীন করে তোলে।

বয়স এখন ৮৭ বছর। শরীরটাও তেমন ভালো নেই। তবু দুপুরের খাওয়া সেরে নীল জিনসের ট্রাউজার আর শার্টের ওপর ধূসর ব্লেজার চাপিয়ে আদোনিস যখন এলেন, তাঁকে দেখাচ্ছিল দিব্যি ঝকঝকে। আরবি তাঁর মাতৃভাষা হলেও ফরাসিতে তুখোড়। তবে ইংরেজিতে কিছুটা কুণ্ঠিত। দোভাষী হিসেবে তাই সঙ্গ দিলেন কবির বড় মেয়ে আরওয়াদ এসবার। আরওয়াদ প্যারিসভিত্তিক হাউস অব ওয়ার্ল্ড কালচার্সের পরিচালক। তাঁর মধ্যস্থতায় বাংলা একাডেমিতে উৎসবের ক্যানটিনে এগিয়ে চলল কবির সঙ্গে সংলাপ। ইংরেজি, ফরাসি আর আরবি—এই তিন ভাষার বিনুনিতে।

আদোনিস কথা বলে গেলেন সহজ ছন্দে। যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ও কৌশল কিংবা মুসলিম দেশগুলোর দুর্বলতা ও সম্ভাবনা নিয়ে যেমন; ধর্ম, বিতর্ক আর কবিতা নিয়েও অকপটে, স্বতঃস্ফূর্ত ভঙ্গিতে।

কবি আদোনিস
 জন্ম: সিরিয়া, ১ জানুয়ারি ১৯৩০
 জেলবন্দী: ১৯৫৫–১৯৫৬
 দেশত্যাগ: ১৯৫৬ সালে লেবাননে, ১৯৮০ থেকে ফ্রান্সে
 নোবেল: বছরকয়েক ধরে সংক্ষিপ্ত তালিকার নিয়মিত নাম

প্রথম আলো: ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ঘুরে এসে আপনি ‘নিউইয়র্কের জন্য একটি কবর’ কবিতাটি লিখলেন। স্পেনের কবি ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকার নিউইয়র্কে এক কবির কবিতাগুলোর পর যুক্তরাষ্ট্রের এত ক্ষুরধার সমালোচনা আর পড়িনি। নিউইয়র্ককে আপনি বর্ণনা করেছেন একটি চার পাওয়ালা জন্তু হিসেবে, যে খুন করার বাসনায় ছুটে বেড়াচ্ছে, যখন কিনা দূরেই শোনা যাচ্ছে আহত মানুষের গোঙানি। কেন এত ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন?

আদোনিস: ভিয়েতনামে তখন যুদ্ধ চলছে। এ যুদ্ধ আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের নীতি বলছিল, মানুষের বিন্দুমাত্র কোনো মূল্য নেই। মানুষ মেরে ফেলা কোনো ব্যাপারই নয়। এই বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করেই যুক্তরাষ্ট্র তার রাজনৈতিক নীতি ও কৌশলগুলো প্রণয়ন করে। এর প্রয়োগ ঘটায় ভিয়েতনামে; একইভাবে ফিলিস্তিনেও। যুক্তরাষ্ট্র পুরো পৃথিবীকে একটি কুচকাওয়াজের ময়দানে পরিণত করতে চায়। সেখানে তারা হতে চায় সেনাপতি। আমার এই সমালোচনা যুক্তরাষ্ট্রের জনগণকে নিয়ে নয়। এমন অনেককে আমি দেখেছি, পৃথিবীকে যাঁরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুপম ক্যাম্পাসে পরিণত করার জন্য চেষ্টা করে চলেছেন।

প্রথম আলো: আপনি বলেছেন, ওসামা বিন লাদেনের মতো আরব বসন্তও যুক্তরাষ্ট্রের সৃষ্টি। প্রথম অভিজ্ঞতার এত বছর পরে এসে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আপনি কোনো পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছেন?

আদোনিস: সেই সময় থেকে এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী বাসনার কোনো নড়চড় আমি দেখিনি। বরং এতগুলো বছরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। তাদের সব তৎপরতার একটিই লক্ষ্য—পুরো পৃথিবীর ওপর একচেটিয়া অর্থনৈতিক ও সামরিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। এই উদ্দেশ্যে তারা দেশে দেশে বিভিন্ন শক্তিগুলোকে নিজেদের বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলছে, যারা ভেতর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে তাদের নীতি বাস্তবায়ন করছে। বিভিন্ন দেশে তাদের নীতি অসম্ভব নিপীড়ন ও শোষণমূলক। বিশ্ব-ইতিহাসে রাষ্ট্র হিসেবে তারা প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করল না। মানবজাতির ভবিষ্যৎ অগ্রগতির পথে অবদান রাখতে চাইল না। তাই রাষ্ট্রটির ব্যাপারে আমার অবস্থানেরও কোনো পরিবর্তন হয়নি।

প্রথম আলো: মুসলিম বিশ্ব নিয়েও তো আপনার সমালোচনার অন্ত নেই। আপনি এই কারণে ক্ষুব্ধ যে তারা পুরোনো বিশ্বাস ও পন্থাকে মোটেই চ্যালেঞ্জ করতে চায় না।

আদোনিস: হ্যাঁ, তাই তো। তা ছাড়া দেখুন, মুসলিম বিশ্বের প্রভাবশালী অংশ তো এই যুক্তরাষ্ট্রেরই মিত্র।

প্রথম আলো: আপনার কি মনে হয় এই পরিস্থিতিতে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে বাদবাকি পৃথিবীর সংলাপ সম্ভবপর কিংবা সে সংলাপের কোনো পথ আছে?

আদোনিস: সংলাপ শুধু সম্ভব নয়। সেটা অত্যন্ত জরুরিও। কারণ সংঘাত আর যুদ্ধ কোনো সমাধান নয়। কিন্তু আপনি যে মুসলিম বিশ্ব বলছেন, সেটা আসলে কী বোঝায়? প্রায় সারা বিশ্বই তো এখন ক্রমশ মুসলিম বিশ্ব হয়ে উঠেছে। সে কারণে সংলাপ আরও বেশি করে দরকার।

প্রথম আলো: মুসলিম বিশ্বে এখন ব্যাপক সংঘাত চলছে। এই জনগোষ্ঠী থেকে কি কোনো শান্তিপূর্ণ অহিংস আন্দোলন জন্ম নিতে পারে? গান্ধী বা ম্যান্ডেলার মতো কোনো নেতা এখান থেকে বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা আছে?

আদোনিস: আমি মনে করি, এ ছাড়া মুসলিম বিশ্বের এগোনোর আর কোনো পথ খোলা নেই। সমাধানের একটা পথ তাদের খুঁজে বের করতে হবেই। এ জন্য নিজেদের ঐতিহ্য তাদের নতুন করে পাঠ করতে হবে। বর্তমান পৃথিবীর বাস্তবতার আলোতে সেটাকে বুঝতে হবে। আরও ভালো করে বুঝতে হবে এই সময়ের পৃথিবীটাকে। ক্ষমতার অপরিসীম লোলুপতা থেকে আগে তাদের বের হয়ে আসতে হবে। মানুষের ভবিষ্যতের ওপরে আস্থা রাখতে হবে। ধর্মবিশ্বাসের দিক থেকে মুসলমানেরা এখন সংখ্যায় বিশ্বের সামনের সারিতে। অথচ একমাত্র ব্যবহৃত হওয়া ছাড়া পৃথিবীর কোনো আয়োজনে তাদের কোনো উপস্থিতি নেই।

প্রথম আলো: আপনি বলেছেন, পৃথিবীর পবিত্র গ্রন্থগুলো অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীলভাবে ব্যাখ্যা করা এ সময়ে একটি জরুরি কর্তব্য। আপনি কি মনে করেন, এটি আদৌ সম্ভব, বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বে?

আদোনিস: কেন সম্ভব নয়? আমরা মুসলমানেরা তো এখন নিতান্ত ব্যবহারের বস্তু হয়ে আছি। যদি মানবজাতির উদ্দেশ্যে আমরা কিছু বলা কর্তব্য বলে মনে করি, তাহলে তার জন্য প্রয়োজনে আমাদের অস্তিত্ব উৎসর্গ করতে হবে। আর মুসলমানেরা অবশ্যই এটি করতে সক্ষম। মুসলিম বিশ্ব অতীতে মানবজাতিকে শ্রেষ্ঠতম দার্শনিক উপহার দিয়েছে। কবি, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক—কত-কী উপহার দিয়েছে। সমস্যাটা ব্যক্তির নয়, সমস্যাটা এই সমাজের ক্ষমতাকাঠামোর, এই দেশগুলোর রাষ্ট্রনায়কদের।

প্রথম আলো: এবার একটু সাহিত্যে আসি। আপনার বাবা আপনাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ইমরুল কায়েসের মতো ধ্রুপদি আরব কবিদের কবিতার সঙ্গে। কবিতার প্রতি সেই আপনার ভালোবাসার শুরু। কিন্তু আপনি হয়ে উঠলেন নতুন আরব কবিতার নেতা। আপনার ভাষা, বলার ভঙ্গি ও বিষয়—সব আলাদা হয়ে গেল।

আদোনিস: পুরোনো সব আরব কবিতা আর তার ছন্দও কিন্তু সব সময় এক রকমের নয়। পুরোনো যুগের মহৎ আরব কবিদের মধ্যে যে মিল আপনি পাবেন, তা মাত্র সামান্য কিছু ক্ষেত্রে। প্রকাশভঙ্গি স্বতন্ত্র না হলে আর কবি কেন? কারও প্রকাশভঙ্গি যদি অন্য কারও মতোই হয়ে গেল, তাহলে তো তিনি কবিই নন। ইসলামের আগের যুগে ইমরুল কায়েসসহ অন্য কবিদের মধ্যে দীর্ঘ দীর্ঘ কবিতা লেখার চল ছিল। কিন্তু তাঁদের কবিতার ধরন ছিল আলাদা আলাদা। ছন্দ আর প্রকাশভঙ্গি একটা পথ, কবি যার ওপর পা ফেলে ফেলে হেঁটে যান। আরেকজনের ফেলে আসা পথের ওপর দিয়েই যদি হেঁটে যাই, তাহলে আর কবি হলাম কী করে? আগের কবিদের হাঁটা পথের পাশ দিয়ে কবি নিজের পথে তাঁর নতুন কবিতার পদচিহ্ন রেখে যান। যাঁরা চিরকাল পুরোনো পথেই চলতে চান, তাঁরাই সালাফি। বলতে পারেন, একেবারে গোঁড়া।

প্রথম আলো: কিন্তু আমরা জানি, সমকালের ফরাসি কবিদের পাশাপাশি রোমের প্রাচীন কবি ওভিদের কবিতাও আপনি অনুবাদ করেছেন। প্রাচীন কবিদের কাছ থেকে তাহলে আপনি কী নিতে চাইছেন?

আদোনিস: আপনার ‘সমকাল’ শব্দের ব্যবহারটি পর্যালোচনামূলক। শিল্পসাহিত্যে একই অর্থে এ শব্দের প্রয়োগ হতে পারে না। ‘প্রাচীন’ আর ‘নতুন’—এই শব্দ দুটো সময়ের সঙ্গে জড়িত। মহৎ সাহিত্য সময়ের অংশ নয়। মহৎ সাহিত্য নিজের প্রতিভার জোরে সময়কে তার অংশ করে নেয়। সে কারণে ভার্জিল আমাদের সমকালীন, ইমরুল কায়েস সমকালীন।

প্রথম আলো: আপনি এ-ও বলে থাকেন যে সামনের দিকে এগোতে হলে ঐতিহ্যকে কঠোরভাবে চ্যালেঞ্জ করতে হবে।

আদোনিস: প্রতিটি ঐতিহ্যের অনেকগুলো স্তর থাকে। ঐতিহ্যের যে স্তরটি আমরা চোখের সামনে স্পষ্টভাবে দেখি, সেটি ক্ষমতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত থাকে। ঐতিহ্যের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ স্তরগুলো মিশে থাকে সমাজের গভীরে। প্রত্যেক বড় কবি তাঁর মতো করে একেকটি স্বতন্ত্র ঐতিহ্যের জন্ম দেন।

প্রথম আলো: বলা হয়, সংস অব মিহিয়ার অব দামাস্কাস নামে কবিতার বইটিতে আপনি পুরোনো কবিতা ছেড়ে নতুন কবিতার দিকে চলে এলেন। এতে নতুন এমন কী এল, আরবে আগে যার অভিজ্ঞতা হয়নি?

আদোনিস: এটিই আমার প্রথম বই, যার কবিতাগুলো নানা দিক থেকে অনন্য হয়ে উঠতে চেয়েছে। প্রথমত, এতে ঐতিহ্যবাহী আরব কবিতার মতো কবির ‘আমি’ ‘আমি’ করা কণ্ঠস্বর মোটেই শোনা যাবে না। কবি এই কবিতায় সরাসরি নিজে কখনোই কথা বলছে না। কথা বলছে অন্য কেউ, অন্য কোনো কবিচরিত্র। মানে, এ কবিতায় আমি সরাসরি নেই। আমি আছি অন্যের মধ্যে। দ্বিতীয়ত, আগের আরব কবিরা—তাঁরা ধর্মে আগ্রহী বা অনাগ্রহী যা-ই হয়ে থাকুন না কেন—ধর্মকে দেখেছেন খুবই প্রথাগত চোখে। আরবের প্রখ্যাত কবি আবুল আলা ইমামি খুব সুন্দর করে বলেছিলেন, ‘মানুষ দুই রকমের। কারও ধর্ম আছে, যুক্তি নেই। কারও যুক্তি আছে, ধর্ম নেই।’ সংস অব মিহিয়ার-এ এই ধারণাটিকে আমি চূড়ান্তভাবে পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছি। পরম বিচারে তো ধর্ম ব্যক্তির একান্ত উপাদান। সমাজকে গড়ে উঠতে হবে মূল্যবোধ, মানবাধিকার আর স্বাধীনতার ওপর ভিত্তি করে। তৃতীয়ত, এই কবিতাটিতে আরব-দুনিয়া প্রথমবারের মতো পৃথিবীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিজেকে দেখতে চাইল। বলতে চাইল, আরব কবিতা বিশ্বজোড়া মানবজাতির সৃষ্টিশীল কল্পনার নিবিড় অংশ। আমি যদি টি এস এলিয়টের কথা বলি, একই নিশ্বাসে আমাকে ইমরুল কায়েসের কথাও বলতে হবে। তাঁরা একই সমতলে অবস্থান করছেন। চতুর্থত, আমার এই বইয়ে কবিতা আছে একটিই। একটি ভাবনার ওপর ভর দিয়ে একটি অখণ্ড কবিতা, কিন্তু ২০০টিরও বেশি পৃষ্ঠাজুড়ে এর পঙ্‌ক্তিগুলো ছন্দে ও চরণের বিন্যাসে বয়ে গেছে নানা বৈচিত্র্যে।

প্রথম আলো: পর পর তিনটি সাহিত্যপত্র সম্পাদনা করেছেন আপনি। প্রথমটি ছিল মূলতই নতুন কবিতার। পরেরটিতে কবিতার পাশাপাশি জায়গা করে নিল নন্দনতত্ত্ব ও রাজনীতি। তার পরেরটিতে জায়গা করে দিলেন দার্শনিক বিতর্ক। এই যে কবিতা থেকে নন্দনতত্ত্ব ও রাজনীতি হয়ে দর্শনের দিকে আপনি ক্রমশ এগিয়ে গেলেন, এর পেছনে কি আপনার কোনো সচেতন চিন্তা কাজ করেছে?

আদোনিস: একটির পর একটি সাহিত্যপত্রের দিকে যেতে যেতে আমি ভেবেছি, একটি সমাজে গভীরতর চিন্তার সংস্কৃতি না থাকলে কীভাবে সেখানে ভালো কবিতা রচিত হওয়া সম্ভব? উত্তম কবিতাকে তো মহৎ সংস্কৃতির ভেতর থেকে পুষ্ট হতে হয়। এই যত্নটুকু দেওয়ার জন্য আমরা কিছু করার প্রয়োজন বোধ করলাম। আমরা এমন একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সূত্রপাত করতে চাইলাম, যার মধ্যে কবিতা ফুলের মতো প্রস্ফুটিত হবে। চারপাশে গান জানাবোঝার মতো লোক না থাকলে ভালো গান তো আপনি পাবেন না। থিয়েটারের সংস্কৃতি না থাকলে ভালো নাটক আপনি পাবেন কোথায়? মুসলমানেরা তো এই পৃথিবীতে একা বসবাস করে না। সুই থেকে গাড়ি পর্যন্ত সবকিছুই আমরা অন্য দেশ থেকে এনে ব্যবহার করছি। মানবজাতির সৃষ্টিশীলতার মহামিছিলে আমাদেরও এসে যোগ দিতে হবে। আমরা শুধু আমদানিই করব না, আমরা তৈরিও করব। আমরা এখন পাশ্চাত্যের লেখা পড়ি, প্রভাবিত হই। তারা আমাদের চিন্তা সরবরাহ করে। অতীতে এই কাজটা আমরা করেছি। ইসলামি সংস্কৃতির ভেতরে আমরা ইবনে রুশদের মতো ভাবুককে জন্ম দিয়েছি, পাশ্চাত্যের কাছেও যিনি বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিলেন। ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর চিন্তাধারা পড়ানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। আমাদের আবার সে রকম করে উঠে দাঁড়াতে হবে। বোমা বানানো আর সন্ত্রাসবাদী আদর্শের বাইরে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অন্য দিকগুলোও আমাদের জানতে হবে।

প্রথম আলো: আপনি বলতে চান, যুক্তির বলয়ের বাইরের জগৎটিকে বোঝার জন্য পশ্চিমা শিল্প ও সাহিত্য পরাবাস্তববাদ আবিষ্কার করেছিল। কিন্তু একই উদ্দেশ্যে পশ্চিমা জগতের বাইরে তারও বহু আগে সুফিবাদের আবির্ভাব ঘটেছে, যার দিকে আমরা তাকাইনি।

আদোনিস: আরবের দেশগুলোতে, বিশেষ করে লেবাননে পরাবাস্তববাদের গভীর প্রভাব পড়েছে। পরাবাস্তববাদের মতো যে গভীর ভাবধারাটি আরবের জমিতে জন্ম নিয়েছিল, আরবদের উচিত সেই সুফি কবিদের খোঁজখবর নেওয়া। গোঁড়া ও প্রথাবাদীরা দুঃখজনকভাবে সুফিদের প্রত্যাখ্যান করেছে।

প্রথম আলো: মেক্সিকোর কবি অক্তাভিও পাস বলেছিলেন, একজন কবি একই সঙ্গে একটি রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক সত্তা। আপনার কবিতায় এর একটি সুষম মিশ্রণ দেখতে পাই। আপনার কোনো কোনো কবিতা একই সঙ্গে তীব্রভাবে রাজনৈতিক এবং গভীরভাবে আত্মিক। এই দুরূহ গন্তব্যে আপনি কীভাবে পৌঁছলেন?

আদোনিস: আমাদের চারপাশের সবকিছুই রাজনীতির অন্তর্গত। গ্রিকরা যে অর্থে ‘পলিটিকস’ শব্দটি ব্যবহার করেছিল, আমি সেটি মাথায় রেখে বলছি। সেখানে তখন নগর-রাষ্ট্র গড়ে তোলার পাশাপাশি নাগরিকেরও নির্মাণ চলছে। অক্তাভিও পাস আমার বন্ধু ছিলেন। তিনি কী ভেবে কথাটা বলেছিলেন, আমি সেটা ভালোভাবে উপলব্ধি করি। রাজনীতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান—আপনার যা ইচ্ছা সবই কবিতা ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু কবিতাকে আদর্শের ধ্বজা হিসেবে ব্যবহার করলে সেটি তুচ্ছ হাতিয়ারে পর্যবসিত হয়।

প্রথম আলো: ভাষাই কবিতার শক্তি। আবার এই ভাষাই কি কবিতার জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় না? পাশ্চাত্য জগতের বাইরের কবিরা ভাষার ব্যবধানের কারণে বিশ্ব-ঐতিহ্যের অংশ হয়ে উঠতে পারেন না।

আদোনিস: দেখুন, সৃষ্টিশীলতার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। পৃথিবীতে বহু বড় কবি রয়ে গেছেন, এখনো যাঁদের অনুবাদ করা হয়নি। অনুবাদ বড় কবি হওয়ার কোনো সূচক নয়। এমন অনেক বড় কবিকে অনুবাদ করা হয়েছে, যাঁদের আসলে অনুবাদই করা উচিত হয়নি। অনুবাদে তাঁরা নষ্ট হয়ে গেছেন। আরবে আন-নিফফারি নামে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম একজন কবির জন্ম হয়েছিল। এমনকি আরবরাও তাঁকে পড়ে দেখেনি—না অতীতে, না বর্তমানে। তাঁর জন্ম হয়েছিল দশম শতকে। তাঁর মাত্র একটি পাণ্ডুলিপিই পাওয়া গেছে। তাঁর কথা কেউ জানতও না। ১৯৪৫ সালে এক প্রাচ্যবিদ তাঁকে আবিষ্কার করেন।

প্রথম আলো: আপনি কবি ও ভাবুক। রাজনীতি নিয়েও খুবই সোচ্চার। আপনি কি মনে করেন কবিতা পৃথিবীকে পাল্টে দিতে পারে?

আদোনিস: পৃথিবীকে পাল্টে দেওয়া বলতে আপনি কী বোঝাতে চাইছেন? রাজনৈতিকভাবে পাল্টে দেওয়া? নাকি অর্থনৈতিক বা সামাজিকভাবে? একটি তুচ্ছ গ্রেনেড বা গুলি কবিতার চেয়ে অনেক প্রত্যক্ষভাবে পরিস্থিতিকে পাল্টে দিতে পারে। ফলে পরিবর্তন কথাটাও উপলব্ধি করার দরকার আছে। কবিতা এমন কিছু বিষয়কে পাল্টে দেয়, যা কবিতা ছাড়া আর অন্য কিছু দিয়ে পাল্টানো সম্ভব নয়। ভাষার ভেতরকার সম্পর্কগুলোকে কবিতা আমূল পাল্টে দেয়। পাল্টে দেয় ভাষা আর পৃথিবীর সম্পর্ক, ভাষা আর আমাদের চারপাশের বস্তুপুঞ্জের সম্পর্ক। কবিতা আসলে পৃথিবীর চিত্রটিই পাল্টে দেয়। কবিতার মধ্যে আমরা পাই পুরোনো পৃথিবীর নতুন সম্পর্কের সম্পূর্ণ নতুন একটি উপলব্ধি।

প্রথম আলো: জীবনের দীর্ঘ সময় আপনি কবিতার সাহচর্যে কাটালেন। কবিতার কাছ থেকে কী পেয়েছেন?

আদোনিস: কবিতা আমাকে তৈরি করেছে।