নির্বাচন কমিশন কি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে?

গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন একটি রুটিন বিষয়। ওই সব দেশে নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষ বা ভোটাররা খুব একটা সংশয়ে থাকেন না। কারণ, নির্বাচনে ভোট না দিতে পারা কোনো বিতর্কের বিষয় না। নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তুতি, প্রচারাভিযান ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হয়।

আমরা নিজেদের গণতান্ত্রিক দেশ ভাবতে খুব ভালোবাসি। ১৯৯০ সালে থেকে ২০১৪ পর্যন্ত নির্বাচনের মাধ্যমেই সরকার পরিবর্তন হলেও ৪টি নির্বাচন ছাড়া বাকি দুটি নির্বাচনে ৯০ ভাগ মানুষও ভোট দিতে পারেননি। ২০১৪ সাল এবং তারপরেও স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও সিংহভাগ ভোটার ভোট দিতে পারেননি। ভোটকেন্দ্র ও নির্বাচনী পরিবেশের নিরাপত্তা নিয়ে মানুষ শঙ্কিত ছিলেন। সে শঙ্কা আজও কাটেনি। যার কারণে ভোটার ও সাধারণ মানুষ নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা, প্রক্রিয়া এমনকি নির্বাচন কমিশনের ওপরেও আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। এ কারণেই নির্বাচন কমিশনকে আলাদাভাবে পরিশ্রম করতে হয় নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার ওপরে আস্থা ফিরিয়ে আনার।

বিগত কয়েকটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হওয়ায় যত দিন ওই ব্যবস্থা ছিল, তত দিন নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সাধারণ ভোটার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে বিতর্ক করতে হয়নি। এখন একই বিষয়ে হাটে-মাঠে-ঘাটে বিতর্ক হচ্ছে, বিশেষ করে ২০১৪ সালের পর থেকে। এরই জের হিসেবে জনগণের কাছ থেকে একটি প্রশ্নই শোনা যায়, ‘আমার ভোটটা কি আমি দিতে পারব?’ আমাকে প্রশ্ন করলে এর উত্তর দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। এ ধরনের প্রশ্নই ইঙ্গিত দেয় যে সাধারণ মানুষ নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার ওপরে কতখানি আস্থা রাখতে পারছেন। আগামী নির্বাচন হবে কি না, তা নিয়েও অনেকে সংশয় প্রকাশ করেন। কেন এ ধরনের প্রশ্ন উঠছে, তা বলা কঠিন। এ ধরনের প্রশ্ন তখনই ওঠে, যখন মানুষ গণতন্ত্র, রাজনীতি আর নির্বাচন নিয়ে সংশয়ে থাকেন।
সংবিধান মোতাবেক নির্বাচন করার দায়দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। আমাদের সংবিধানপ্রণেতারা এবং ওই সময়কার গণতন্ত্রে বিশ্বাসী রাজনীতিবিদেরা স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের মডেল শুধু গ্রহণই করেননি, সংবিধান ও আইনের মাধ্যমে এই স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। তথাপি প্রায় টেলিভিশনের টক শোতে অনেক অংশগ্রহণকারী রাজনীতিবিদকে সংশয় প্রকাশ করতে শোনা যায় যে আদৌ আমাদের দেশের নির্বাচন কমিশন স্বাধীন সংস্থা কি না।
নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তার কথা প্রায়ই শোনা যায়। কিন্তু কীভাবে শক্তিশালী করতে চান, তার কোনো ফর্মুলা দিতে শোনা যায় না। মাত্র কয়েক দিন আগেই সরকারি দলের একজন দায়িত্বপূর্ণ নেতা বলেছেন, সরকার নির্বাচন কমিশনের কাজে হস্তক্ষেপ করবে না। সরকারি দলের অনেক শীর্ষ নেতা অহরহ যখন এ ধরনের কথা বলেন, তখন সাধারণ মানুষের মনে নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়। উপমহাদেশের আর কোনো দেশে নির্বাচন কমিশন বা নির্বাচন কমিশনের কাজে হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা নিয়ে এ ধরনের মন্তব্য হয় বলে আমার জানা নেই। নির্বাচন কমিশনের ওপরে মানুষের আস্থাই যদি না থাকে, তবে ভালো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করতে চায় না।
একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে হলে ওই সময়কার সরকারের, সব রাজনৈতিক দলের এবং সংসদের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। সংসদ যদি প্রয়োজনীয় আইন সংস্কার বা সংযোজন না করে, তবে নির্বাচনী আইন একপেশে হতে পারে এবং নির্বাচনী পরিবেশ তৈরির পরিপন্থী হতে পারে। এখানে ছোট কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হতে পারে।
২০০৮ সালে প্রধান নির্বাচনী আইন অর্ডিন্যান্স আকারে আরপিও জারি করা হয়েছিল। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আরপিওর আওতায় এ দেশে প্রথমবারের মতো ‘না’ ভোট-এর বিধান চালু করা হয়েছিল। অনেকে ‘না’ ভোট দিয়েছিলেন। কিন্তু অর্ডিন্যান্স থেকে আইন করার সময় ওই বিধানটি বাদ দেওয়া হলো। কেন বাদ দেওয়া হলো, তার কোনো যৌক্তিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এই বিধান ভোটারের গণতান্ত্রিক অধিকার হিসেবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা ও ব্যালটে সংযোজন করা হয়েছে। এ বিধান দ্বারা কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে খাটো করা হয়েছে, এমন কথা ওই দেশে শোনা যায়নি।
২০০৮-এ আরপিওর উপরোক্ত সংশোধনী ছাড়া অর্ডিন্যান্সটি আইনি রূপ দেওয়ার সময় প্রার্থীর অযোগ্যতার সব শর্তই রাখা হয়েছিল। এর মধ্যে অন্যতম ছিল আরপিও ধারা ১২(১)(জে), সেখানে উল্লেখ ছিল যে দলীয় প্রার্থী হতে
হলে ওই দলের সঙ্গে ন্যূনতম তিন বছর সদস্য হিসেবে
অবশ্যই থাকতে হবে। এর উদ্দেশ্য ছিল, নির্বাচনে মনোনয়ন-বাণিজ্য এবং উড়ে এসে জুড়ে বসা ব্যক্তিদের দল কর্তৃক মনোনয়ন না দেওয়া। হঠাৎ করে একটি দলে যোগ দেওয়া ব্যক্তি শুধু মনোনয়ন-বাণিজ্যই করেন না, বরং দলের
নির্বাচনী পরিবেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে থাকেন এবং এ ধরনের প্রার্থীদের কারণে স্থানীয় কোন্দল বাড়তে থাকে। এসব কারণেই বিগত সংসদগুলোতে অরাজনৈতিক ও বড় বড় ব্যবসায়ীর প্রাধান্য বাড়তে থাকে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর হিসাবে বর্তমান সংসদে ৬০ থেকে ৭০ ভাগ সদস্য এসেছেন ব্যবসায়িক ক্ষেত্র থেকে। শুধু মনোনয়ন-বাণিজ্যই নয়, নীতিবিবর্জিত রাজনীতিবিদদের এক দল থেকে অন্য দলে যোগদান করে ওই দলে এবং নির্বাচনের পরিবেশে বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি করা রোধকল্পে সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে এই বিধান রাখা হয়েছিল। অথচ এই বিধান কোনো আলোচনা বা ব্যাখ্যা ছাড়াই ২০১৩ সালে সংশোধনীর মাধ্যমে বাতিল করা হয়। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কোনো মতামত নেওয়া হয়েছিল কি না, তা পরিষ্কার নয়।
আগামী নির্বাচনে সামরিক বাহিনী নিয়োগ নিয়ে এখন বিতর্ক চলছে। আমি আগেও লিখেছি, সেনাবাহিনী বা অন্য যেকোনো বাহিনীর নিয়োগ এবং নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা বিধান করার দায়িত্ব একমাত্র নির্বাচন কমিশনের। কাজেই কী ধরনের বাহিনী কীভাবে ব্যবহার করতে হবে, নিরাপত্তার বিষয়ে ভোটারদের আশ্বস্ত করা এবং ভোটারদের আস্থার বিষয় মাথায় রেখে নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা হয়। নির্বাচনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই সব বাহিনীকে সরাসরি নির্বাচন কমিশনের অধীনে রাখা পূর্বশর্ত বলে মনে করি। এ কারণেই এবং যত দূর তথ্য পাওয়া যায় যে সামরিক বাহিনীর নিয়োগ আরও কার্যকর করতে ২০০১ সালে আরপিওর সংজ্ঞা বিধান 2(xiaa)তে সামরিক বাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় অন্তর্ভু‌ক্ত করে আরপিওর আওতায় আনা হয়েছিল। বিধানটি করার পেছনে যত দূর মনে পড়ে যে ওই সময়ে সামরিক বাহিনীর নিয়োগ এবং আরপিওর আওতায় প্রয়োজনে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের সুবিধার জন্য করা হয়েছিল।
সামরিক বাহিনীর নিয়োগ নিয়ে অনেকেই যুক্তি দেখান যে বেসামরিক প্রশাসনের সহযোগিতার জন্য সিআরপিসি মোতাবেক নিয়োগ দেওয়া হোক। আমার বোধগম্য নয় যে কেন বিজ্ঞজনেরা আরপিওর বাইরে নিয়োগের তর্ক জুড়ে দেন। এবং এর সুবিধা-অসুবিধা কোথায়, এ পর্যন্ত কোনো দিনও কেউ ব্যাখ্যা করেননি। ব্যাখ্যা পেলে ভালো হতো। কারণ, ২০০১ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত সামরিক বাহিনীর নিয়োগ আরপিওর অধীনেই থেকেছে। কিন্তু হঠাৎ করে এই বিধি কেন ২০১৩ সালে বাদ দেওয়া হয়েছিল, তার কোনো ব্যাখ্যাও পাওয়া যায়নি। অনেকে ভারতের উদাহরণ টানেন। ভারতের কয়েকটি রাজ্য ছাড়া নির্বাচনে সামরিক বাহিনীর প্রয়োজন হয় না। কারণ, সে দেশে কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ রয়েছে, যারা বিশেষ কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ভারতে কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ কেন্দ্রের অধীন একটি বাহিনী, আর ফেডারেল কাঠামোতে পুলিশ রাজ্য সরকারের বিষয়। আমি আগেও লিখেছি যে কোনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের হাকিমি ক্ষমতা (ম্যাজিস্ট্রিয়াল পাওয়ার) দেওয়া যায় না, যা আরপিওর বিধান ৮৯তে সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। কাজেই এ বিতর্ক যৌক্তিক নয় বলে মনে করি।
সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা অবশ্যই নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব। তবে অন্যদের, বিশেষ করে প্রশাসনের সহযোগিতা ছাড়া তা সম্ভব নয়। কিন্তু যে সহযোগিতার বাধ্যবাধকতা সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদে রয়েছে, তার ব্যত্যয়ও বহুবার ঘটেছে। ২০০৩ সালের ইউনিয়ন কাউন্সিল নির্বাচনের সময়, ২০০৫ সালে ঢাকা ১০ উপনির্বাচনে এবং সর্বশেষ ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সময়।
যাহোক, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে সব ধরনের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে নির্বাচন কমিশনকে। এ ক্ষমতা সংবিধান বা আইন দ্বারা নিশ্চিত করা হয়েছে; আর যে বিষয়ে আইন নেই, সেখানে সংবিধানের ১১৯ ধারার ক্ষমতা প্রযোজ্য। তবে এ কথা ঠিক যে কোনো সরকারই এ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের কাজে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেনি বা করেছে বলে প্রমাণ নেই, তবে অনেক সময় পূর্ণ সহযোগিতারও ব্যত্যয় ঘটেছে।
আশা করা যায়, আগামী সব নির্বাচনে সংবিধানে বর্ণিত সব পক্ষ নির্বাচন কমিশনকে সব ধরনের সহযোগিতা করবে। অপরদিকে নির্বাচন কমিশনকে আইনের প্রয়োগ শক্ত অবস্থানে থেকেই করতে হবে। এ কথা প্রমাণিত যে আইনের দিক থেকে এই উপমহাদেশে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন শক্ত অবস্থানে রয়েছে। সমস্যা হচ্ছে প্রয়োগের ক্ষেত্রে অনেক সময় নির্বাচন কমিশন আশানুরূপ কর্মতৎপরতা দেখাতে পারেনি। তবে ভবিষ্যতে এ অবস্থার পরিবর্তন দেখার আশা করা যায়। নির্বাচনে সম্পৃক্ত সব পক্ষ সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও ভালো নির্বাচনে পূর্ণ সহযোগিতা না করলে একা নির্বাচন কমিশনের পক্ষে আশানুরূপ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা সম্ভব নয়।

এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার, কলাম লেখক ও পিএইচডি গবেষক।
[email protected]