১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর যে প্রত্যাশা নিয়ে বিপুল গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচারের পতন ঘটানো হয়েছিল, তা আজও পূরণ হয়নি। গত ২৭ বছরের রাজনৈতিক আমলনামা সামনে রেখে এ কথা জোর দিয়ে বলার উপায় নেই যে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো গণতান্ত্রিক চেতনা ধারণ করতে পেরেছে।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে এরশাদের স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের পতন ছিল মাইলফলক ঘটনা। শুধু রাজনৈতিক দল নয়, শিক্ষার্থী-তরুণসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের ও পেশার মানুষ যুক্ত হয়েছিল সেই আন্দোলনে। লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্রের মুক্তি। কিন্তু বহু ত্যাগ ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্র এখনো যে স্বৈরাচারের ছায়ামুক্ত হয়েছে তা বলা যাবে না। আন্দোলনের অন্যতম দাবি ছিল সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তন এবং হত্যা, ক্যু, চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের অবসান। কিন্তু বাস্তবে আমরা এত বছর পরও একটি সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারিনি। স্থানীয় থেকে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত নির্বাচনগুলো জনমতের প্রতিফলন ঘটাতে পারছে না। জনপ্রশাসন থেকে শিক্ষাঙ্গন—সবকিছু দলীয়করণের পঙ্কে নিমজ্জিত।
ব্রিটেনে ম্যাগনা-কার্টা চুক্তি ছিল গণতন্ত্রের সনদ, বাংলাদেশের বেলায় ১৯৯০ সালের তিন জোটের রূপরেখা ছিল তেমনই এক ঐতিহাসিক সনদ। গণতন্ত্রের প্রশ্নে তিন জোটের সেই ঐক্য আজ যেন রূপকথার; সেই সনদ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে উপেক্ষিত। ক্ষমতা জবরদখল ও কুক্ষিগত করার রাজনীতির বিপরীতে তিন জোটের ওই রূপরেখা গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা, সার্বভৌম সংসদ প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্র ও সমাজের গণতান্ত্রিক ও মানবিক রূপান্তরের অঙ্গীকার তুলে ধরেছিল। কিন্তু পূর্বাপর সরকারগুলো প্রতিশ্রুতি পূরণে কেবল ব্যর্থই হয়নি, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। গণতন্ত্রের মূল কথা অভয় পরিবেশ, যাতে দলমত-নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিক স্বাধীনভাবে তার মতামত প্রকাশ করতে পারবে। কিন্তু সেই ক্ষেত্রও আজ সংকুচিত হয়ে পড়েছে। আইনি-বেআইনি পথে ভিন্নমত ও গণমাধ্যমের হাত-পা বেঁধে রাখার চেষ্টা চলছে।
সেদিন স্বৈরাচারের পতন হলেও গণতান্ত্রিক শক্তির বিভক্তি ও দুর্বলতার সুযোগে তার পুনরুত্থান লক্ষ করা যাচ্ছে। এ সময়ে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমাদের অনেক অর্জন আছে সত্য। কিন্তু গণতন্ত্রের সূচকে আমরা ক্রমেই পিছিয়ে পড়েছি। জাতীয় সংসদ রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হওয়ার কথা থাকলেও প্রায় অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
তারপরও আমরা আশা রাখতে চাই। যে গণতন্ত্রের জন্য রাউফুন বসুনিয়া, দীপালি সাহা, ডা. মিলন, তাজুল, নূর হোসেনসহ অগণিত সাহসী যুবক প্রাণ দিয়েছেন, সেই গণতন্ত্র বৃথা যেতে পারে না। গণতান্ত্রিক ধারা সমুন্নত রাখতে হবে। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ব্যর্থ হলে ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না।