পারিবারিক শান্তির পথ কী

সম্প্রতি দুটি পারিবারিক হত্যার ঘটনা সমাজে আলোড়ন তুলেছে। স্ত্রীর পরকীয়ার কারণে মেয়ে ও স্বামীকে হত্যা, সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়ার লোভে স্ত্রীসহ নিজ ছেলে হত্যায় স্বামীর সংশ্লিষ্টতার খবর অনেককে ভাবাচ্ছে। যেকোনো হত্যাকাণ্ডই ঘৃণিত ও নৃশংস। আর তা যদি হয় স্বামী, স্ত্রী বা পরিবারেরই অন্য কোনো সদস্যের দ্বারা, তাহলে তা হয়ে ওঠে আরও মর্মান্তিক। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, আমাদের পারিবারিক বন্ধন ও দাম্পত্য সম্পর্কে কি নতুন কোনো অবক্ষয়, জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে?

মনোচিকিৎসক হিসেবে আমি এবিসি রেডিওতে প্রতি রোববার ‘যাহা বলিব সত্য বলিব’ নামে একটি অনুষ্ঠানে পরামর্শ দিয়ে থাকি। এ অনুষ্ঠানে একজন অপরাধী তার জীবনের অপরাধের কথা স্বীকার করে থাকে। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে দাম্পত্য সম্পর্ক ও পরকীয়ার জটিল রসায়নের ভূমিকা নিয়ে আলোকপাত করতে চাই। পরকীয়া হচ্ছে স্ত্রী বা স্বামীর প্রতি বিশ্বস্ততা ভঙ্গ। দাম্পত্য জীবন শুরু করা মানে এই পবিত্র ও স্থায়ী সম্পর্কের সীমারেখা বজায় রাখা। এটি শুধু ধর্মীয়, সামাজিক দায় নয়, নৈতিক দায়ও বটে। এই ‘সীমারেখা’ বজায় রাখতে হবে পরিবারের সবার স্বার্থেই। তবে স্বীকার করতে হবে যে কখনো কখনো স্বার্থপরতা, হিংসা, ঈর্ষা, ক্রোধ, বাসনা পারিবারিক বন্ধন শিথিল করতে পারে, দাম্পত্য সম্পর্কে ফাটল ধরাতে পারে। তাই বিবাহিত জীবনের আনুগত্য ও বিশ্বস্ততার দেয়াল কীভাবে মজবুত রাখা যায়, সেদিকে প্রত্যেক বিবাহিত নর-নারীর বিশেষ নজর দিতে হবে।

বেলজিয়ামের মনস্তাত্ত্বিক এস্থার পেরেল তঁার দ্য স্টেট অব অ্যাফেয়ার বইয়ে পরকীয়াকে ক্যানসারের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি বলেছেন, জীবনযন্ত্রণার অন্যতম কারণ দ্বিতীয় কোনো নারী বা পুরুষের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নেভাদার অধ্যাপক ড্যানিয়েল উয়েগেল ও গবেষক রোজি শ্রাউটের মতে, পরকীয়া সম্পর্ক ভুক্তভোগীর মনে ক্রোধ, অশান্তি, দুঃখ, অবিশ্বাস ও অশেষ মনোযন্ত্রণার সৃষ্টি করে। শুধু আমাদের দেশের মতো রক্ষণশীল দেশে নয়, সব দেশেই বিবাহবহির্ভূত যৌন সম্পর্ক নিন্দিত। যুক্তরাষ্ট্রের জনমত জরিপকারী সংস্থা গ্যালপের এক জরিপে দেখা যায়, সে দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ মনে করেন, পরকীয়া সম্পর্ক অনৈতিক (immoral), ৬৫ শতাংশ মানুষ মনে করেন, এটা ক্ষমার অযোগ্য (unforgiveable)।

তবে মনে রাখতে হবে, প্রকৃতি একগামী নয়, বরং বহুগামিতাকে প্রশ্রয় দেয়। এ ছাড়া কোমল, সংবেদনশীল, শৈল্পিক মনে সহজে রং ছড়ায়। অনেকে মনে করেন, নবীন বয়সে দাম্পত্য জীবনে পরকীয়ার ঘটনা বেশি ঘটে। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, নবীন বয়সে নয়, সন্তানরা বড় হওয়ার পরই পরকীয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

পরকীয়ার নানান রকমফের আছে। যেমন, ১. সাধারণভাবে যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া, আবেগ ও মানসিকভাবে জড়িয়ে পড়া অথবা উভয়ভাবে জড়িয়ে পড়া। এ ছাড়া সুযোগসন্ধানী পরকীয়া হলো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বন্ধন ঠিকই আছে, কিন্তু তঁারা অন্য কারও সঙ্গে যৌন সম্পর্ক তৈরি করেন। ২. বাধ্যতামূলক পরকীয়া: ‘ভয় বা অনুমোদন’ পাওয়ার জন্য কেউ কেউ সম্পর্ক তৈরি করেন। ৩. রোমান্টিক পরকীয়া: তঁাদের মধ্যে স্বামী বা স্ত্রীর প্রতি তেমন আবেগীয় আকর্ষণ থাকে না। তঁারা অন্য পুরুষ বা নারী থেকে মানসিক চাহিদা খুঁজে বেড়ান। ৪. দ্বন্দ্বমূলক রোমান্টিক পরকীয়া: একই সময়ে তঁারা একাধিক নারী বা পুরুষের প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা ও যৌন আগ্রহ অনুভব করেন। এটা বেশ জটিল পরিস্থিতি। তঁারা হয়তো কাউকে আঘাত করতে চাইছেন না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবাই আহত হন।

ইন্টারনেটের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বিবাহবহির্ভূত বা পরকীয়া সম্পর্কের নতুন উপায় যুক্ত হয়েছে। এটাকে বলা হচ্ছে ‘সাইবার অ্যাফেয়ার’। এর সঙ্গে এতে যুক্ত হয়েছে চ্যাটিং, টেক্সটিং, সেক্সটিং ইত্যাদি শব্দমালা।

এটা মনে করার কারণ নেই, আমরা সুখী পরিবার, পরস্পরের প্রতি অগাধ ভালোবাসা আছে, তাই এসব নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তার প্রয়োজন নেই। সব দুর্ভেদ্য দুর্গেই ‘সিকিউরিটি অ্যালার্ম’ থাকে। আমাদের অনেক কিছু অজানা থাকে। এগুলো জানা ও সতর্ক থাকা প্রয়োজন। তাই হঠাৎ বিস্মিত হয়ে, উদ্‌ভ্রান্ত, ক্ষিপ্ত আচরণ করার চেয়ে পূর্ব থেকে সম্পর্ক ঝালাই করে নেওয়া, নবায়ন করা ও পরিচর্যা করার দিকে নজর দিতে হবে।

নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে যোগাযোগের ক্ষেত্রে কোনগুলো ‘অনুমোদনযোগ্য’ ও কোনগুলো ‘গ্রহণযোগ্য’ যোগাযোগ, সে ব্যাপারে একমত হয়ে নিন। ‘সাইবার অ্যাফেয়ার’ সম্বন্ধে সতর্ক থাকুন। মনে রাখবেন, গোপনে কাউকে টেক্সট মেসেজ পাঠানো আর বদ্ধ রুমে অন্যের সঙ্গে একাকী আলাপ করা একই রকমের সন্দেহ উদ্রেক করতে পারে। আবেগগতভাবে বিশ্বস্ত থাকুন এবং যৌন ব্যাপারে খোলামেলা আলোচনা করুন।

কিছু বিষয় আছে, যা কেবল বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যেই করা উচিত, অন্য কোথাও নয়। সততার সঙ্গে নিজেদের অস্বস্তি বা নিরাপত্তাহীনতার বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ করুন। মাঝেমধ্যে নতুন ও পুরোনো সহকর্মী বা বন্ধুদের নিয়ে নিজেদের মধ্যে মতবিনিময় করুন। যখন গুরুতর কিছু ব্যত্যয় ঘটে, তখনই সীমারেখা টানুন। মনে রাখবেন, আগের রাতের নিজেদের মধ্যকার মনোমালিন্য আগের রাতেই মিটিয়ে ফেলার পরও পরদিন তার রেশ থেকে যেতে পারে। তখন অন্য কারও সঙ্গে আবেগীয়ভাবে ঘনিষ্ঠ হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। সতর্ক থাকুন এবং নিজেদের অস্বস্তি, অসন্তোষ মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করুন।

ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের সময় সীমিত করুন; প্রয়োজনে কাউকে ব্লকও করতে হতে পারে। ফেসবুকে অন্যদের তথ্য দিয়ে নিজেদের তুলনা করবেন না। বাইরের সম্পর্কের ক্ষেত্রে শুধু নিজে ঠিক আছি, এ হলে হবে না, অন্য পক্ষ দুর্বল হয়ে পড়ছে কি না, সেটিও বিবেচনায় রাখতে হবে। পরিস্থিতি গুরুতর অবস্থায় নামার আগেই নিজেকে থামিয়ে রাখুন। নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের প্রতি সম্মান, শ্রদ্ধা ও বিশ্বস্ততা রয়েছে, নাকি প্রতারণাপূর্ণ ও বেপরোয়া জীবন যাপন করছেন।

ডিজিটাল মাধ্যমকে ইল্যুশন ভাববেন না। এটি বাস্তব জীবনকেও প্রভাবিত করে। ‘অপর পার অধিক সবুজ’, ওরা খুব সুখে আছে, আপনি একাই কষ্টের সংসার করছেন—এ রকম ভুল ধারণা মন থেকে ঝেড়ে ফেলুন। তর্কে বা যেকোনো কিছুতে নিজে জিততে চাইবেন না। পরস্পরের বিরুদ্ধে নয়, পরস্পরের জন্য লড়বেন। দাম্পত্যে কোনো লুকোচুরি চলবে না, দাম্পত্য জীবন থাকবে পূর্ণ স্বচ্ছ ও বিশ্বস্ত। স্বামী বা স্ত্রীর চেয়ে বন্ধু, বাইরের আড্ডা, অর্থ, ক্যারিয়ার এমনকি মা-বাবার প্রতিও অধিক আনুগত্য বৈবাহিক সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। নিজের ভুল হলে ভুল স্বীকার করে নিন, আন্তরিকভাবে ক্ষমা চেয়ে নিন। দাম্পত্য জীবনে সবচেয়ে শক্তিশালী ও আরোগ্য প্রদানকারী উক্তি হচ্ছে: ‘আমার ভুল হয়েছে। আমি সত্যিই দুঃখিত।’

তাজুল ইসলাম: অধ্যাপক ও বিভাগীয়  প্রধান, কমিউনিটি অ্যান্ড সোশ্যাল সাইকিয়াট্রি বিভাগ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা।