রাখাইনের পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে?

মিয়ানমারে বিদ্রোহী বাহিনীর সংখ্যাও কম নয়
মিয়ানমারে বিদ্রোহী বাহিনীর সংখ্যাও কম নয়

উত্তর মিয়ানমারে কাচিন ইনডিপেনডেন্ট আর্মির (কেআইএ) ছত্রচ্ছায়ায় উত্তর জোট গঠিত হয়েছিল, যার অন্যতম সদস্য আরাকান আর্মি। অবশ্য আরাকান আর্মির দুটি আলাদা গ্রুপ আছে। এদের একটি আরাকান আর্মি, কাচিন স্টেট; অন্যটি আরাকান আর্মি, কিয়ান স্টেট। উভয় গ্রুপই আরাকান স্টেট আর্মি নামে পরিচিত। এই গ্রুপের অবস্থান কিয়ান স্টেট হলেও এরা মূলত রাখাইন বিদ্রোহী বলে পরিচিত। এই দুটি দলই রাখাইন জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। আরাকান আর্মি ও তাদের রাজনৈতিক সংগঠনগুলো মনে করে, রাখাইনরা আলাদা জাতিসত্তা এবং তাদের মধ্যে বিভিন্ন উপগোত্রের মানুষ আছে। বহু উপগোত্রের এ অঞ্চলের আলাদা সত্তা ফিরিয়ে আনতে হবে। এরা মূলত রাখাইন, সাম ও বৌদ্ধ। এরা বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে গেরিলাযুদ্ধে লিপ্ত।

এই দুই গ্রুপই সাম্প্রতিক সময়ের উত্তর আরাকানসহ সমগ্র আরাকান বা রাখাইন রাজ্যের অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে আরও হামলার প্রস্তুতি চালাচ্ছে। এই দুই বিদ্রোহী গ্রুপের সদস্যরা রাখাইন বৌদ্ধ, যাদের আবাসস্থল বাংলাদেশের দক্ষিণ পার্বত্যাঞ্চল এবং দক্ষিণে সুদূর কুয়াকাটা অঞ্চলেও রয়েছে। রাখাইন বৌদ্ধদের সিংহভাগ মারমা, এরা এ অঞ্চলে মগ বলেও পরিচিত। এদের একাংশ ভারতেও রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, রাখাইন অঞ্চলের বৌদ্ধ, যাদের পক্ষ থেকে রাখাইন বা আরাকান জাতীয়তাবাদী তত্ত্বের জন্ম, তাদের সংখ্যা মিয়ানমারের মোট জনগোষ্ঠীর ৬ শতাংশ। দক্ষিণ রাখাইনে বেশি ঘনবসতি হলেও উত্তরে রোহিঙ্গাদের অঞ্চলেও এদের অনেকের বাস।

এই দুই গ্রুপের মধ্যে আরাকান আর্মির (কাচিন) সংখ্যা বেশি। এই সংগঠনের সদস্য তিন হাজারের মতো। এদের প্রশিক্ষণ, গেরিলাযুদ্ধের অভিজ্ঞতা ও অস্ত্রবলও আরাকান আর্মির (কিয়ান) চেয়ে বেশি। এদের কমান্ডার ইন চিফ সাবেক ছাত্রনেতা ও স্বঘোষিত মেজর জেনারেল তোয়ান ম্রাট নেইং। অপর গ্রুপ এই গ্রুপের চেয়ে অনেকটা ছোট হলেও আরাকান আর্মি বা আরাকান স্টেট আর্মির জনবল প্রায় ৪০০। এদের তথাকথিত কমান্ডার ইন চিফ তথাকথিত স্বঘোষিত কর্নেল মিন জেন ওই। এই গ্রুপটিও রাখাইন রাজ্যে রাখাইনের সব উপজাতি নিয়ে রাখাইন স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে। এ দুই গ্রুপের অর্থ জোগানের উৎস মাদক চোরাচালান, কাঠ পাচার আর কাচিন অঞ্চলে ‘জেড’ খনিতে কর্মরত রাখাইনদের কাছ থেকে চঁাদা। এদের মধ্য থেকে সদস্য সংগ্রহও করা হয়। দুই গ্রুপই ভারী অস্ত্রে সজ্জিত, যার ধারণা পাওয়া যায় গত নভেম্বরের প্রথম দিকের ভয়াবহ হামলার ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়ে। এ হামলা আরাকান আর্মির কিয়ান স্টেট বা আরাকান স্টেট আর্মির দ্বারা সংঘটিত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ অঞ্চল এই বাহিনীরই ‘অপারেশন’ অঞ্চল। উল্লেখ্য, উত্তর রাখাইনের ‘এই হামলার জায়গা’ কালাদান নদীসংলগ্ন পালিতওয়া গ্রামটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম পার্বত্য চট্টগ্রাম সীমান্ত থেকে মাত্র ১৮ কিলোমিটার দূরে।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ওই অঞ্চলের টহলের ওপর এমন সময় হামলাটি হয়েছে, যখন মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গা নিধনের অভিযোগে জর্জরিত। উত্তর রাখাইনে সামরিক বাহিনী যে ধরনের বর্বরোচিত আচরণ করে চলেছে, তার বিরুদ্ধে বিশ্বের জনমত অবশ্যই এ বাহিনীর মনোবল মারাত্মকভাবে দুর্বল করেছে। এর সুযোগ নিয়েছে আরাকান আর্মি। পালিতওয়া গ্রামের হামলার ১০ দিনের মাথায় ১৮ নভেম্বর রোহিঙ্গাশূন্য বুথিডং অঞ্চলে মিয়ানমার বাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির গোলাগুলি হয়। তবে হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।

খবরে প্রকাশ, এই দুই ঘটনার আগে গত ২৫ আগস্ট তথাকথিত ‘আরসা’র (এআরএসএ) হামলার অজুহাতে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা করেছিল; এই হামলার তিন দিন আগে ২২ আগস্ট ওই অঞ্চলে আরাকান আর্মির (কিয়ান) গ্রুপের হামলা হয়েছিল। তবে কোনো ক্ষয়ক্ষতির তথ্য পাওয়া যায়নি। এ ঘটনার তিন দিনের মাথায় মিয়ানমার সামরিক বাহিনী আরসার আক্রমণের অজুহাতে মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড শুরু করলে আরাকান আর্মির এই আক্রমণের তথ্য ধামাচাপা পড়ে যায়।

মিয়ানমার যে আরসা নিয়ে বিশ্ববাসীকে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, তাতে কিছুটা সফলও হয়েছিল। সেই তথাকথিত আরসা রাখাইনে গৃহযুদ্ধে জড়িত আরাকান আর্মির ধারেকাছেও নেই।এই দুই সংগঠনের কোনো তুলনাই হয় না। আরাকান আর্মির দুই অংশ—কিয়ান ও কাচিন পরিচালিত হচ্ছে পৃথকভাবে, নিজস্ব রাজনৈতিক সংগঠনের ছত্রচ্ছায়ায়। আরাকান আর্মি কাচিন পরিচালিত হয় ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান দ্বারা, আর আরাকান আর্মি কিয়ান পরিচালিত হচ্ছে আরাকান ন্যাশনাল কাউন্সিল ইউনাইটেড ন্যাশনালিটিজ ফেডারেল কাউন্সিলের রাজনৈতিক দিকনির্দেশনায়। অথচ তথাকথিত রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠন বলে আখ্যায়িত আরসা পরিচালনা করতে পারে, এমন কোনো রাজনৈতিক সংগঠন আছে বলে কোনো তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি।

আরাকান আর্মি বলে পরিচিত এই দুই গ্রুপের সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় কাচিন ইনডিপেনডেন্স আর্মির কথিত সামরিক প্রশিক্ষণ স্কুল এবং কথিত মিলিটারি একাডেমির মাধ্যমে। খবরে প্রকাশ, কাচিন অঞ্চলের কাচিন আর্মির দখলে থাকা কথিত মুক্তাঞ্চলে এসব প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়, যেখানে ওই অঞ্চলের সব বড় ধরনের ইনসারজেন্ট গ্রুপের সদস্যকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, যার তুলনায় আরসা একেবারেই র‌্যাগ-ট্যাগ (ছেঁড়া কাপড়ের টুকরা) সংগঠন। অর্থাৎ আরসা নিয়ে মিয়ানমার যে ধরনের প্রচার চালিয়েছিল, তাতে আরাকান আর্মির তৎপরতা বিশ্ববাসী তথা মিয়ানমারের জনগণের কাছেও ধামাচাপা পড়ে গিয়েছে। হঠাৎ আরাকান আর্মির ক্রমবর্ধমান ভয়াবহ হামলা নাইপেথু এবং তাদমাদ্যের (সামরিক বাহিনী) জন্য উদ্বেগের বিষয় বটে। কারণ, একাধারে আন্তর্জাতিক ধিক্কার এবং রাখাইনের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দুই ফ্রন্ট সামাল দিতে হচ্ছে। অন্যান্য প্রান্তরের গৃহযুদ্ধ তো রয়েছেই।

ওপরে আলোচিত হামলার পর থেকে আরাকান আর্মি রাখাইন অঞ্চলের অশান্ত পরিস্থিতির পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে তাদের তৎপরতা বাড়িয়ে দিয়েছে বলে একাধিক সূত্র-সমর্থিত খবরাখবর প্রকাশিত হচ্ছে। ১৮ নভেম্বর রোহিঙ্গাশূন্য বুথিডংয়ে আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাদের আরেকটি সংঘর্ষ হয়েছিল, যা ছিল ‘হিট অ্যান্ড রান’। উল্লেখ্য, ২২ আগস্ট আরাকান আর্মি একই জায়গায় পালিতওয়া অঞ্চলে দুর্বল আরাকান লিবারেশন আর্মি, যারা সরকারের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি করে সহযোগিতা করছিল, তাদের ঘঁাটি দখল করেছিল। সে অঞ্চলেই এখন এদের শক্তি বাড়ছে। স্মরণযোগ্য, ওই অঞ্চলে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর প্রধান ওয়েস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার মেজর জেনারেল মং মং সোয়েকে প্রত্যাহার করা হয়েছিল। আরাকান আর্মির তৎপরতা বৃদ্ধি এবং এই ভয়াবহ আক্রমণে হতাহতের জন্য দায়ী করে প্রত্যাহার করা হয়েছিল সেন্ট্রাল কমান্ডের এই কমান্ডারকে। রোহিঙ্গা নিধনের কারণে নয়, যেমনটা আমাদের অনেকের ধারণা ছিল। মং মং সোয়েকে প্রত্যাহার করা হয়েছিল পালিতওয়ায় হামলার কয়েক দিন পর, যখন সিনিয়র জেনারেল মিন অং লেইং সিত্তে সেনাছাউনি পরিদর্শন করেন।

২০১৬ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী রাঙামাটি-বান্দরবান অঞ্চলে অভিযান চালিয়ে আরাকান আর্মির হাতে ধৃত মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর একজন সদস্যকে উদ্ধার করে মিয়ানমারের সরকারের কাছে হস্তান্তর করেছিল। ওই অভিযানেই কথিত আরাকান আর্মির এক সদস্য কয়েকটি ঘোড়া এবং বেশ কিছু সরঞ্জাম উদ্ধার করেছিল। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমারের সঙ্গে সুপ্রতিবেশীসুলভ আচরণ করেছিল। অথচ মিয়ানমার ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের বাঙালি আখ্যা দিয়ে উৎখাত করে যেভাবে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে, তাকে কোনোভাবেই সৎ প্রতিবেশীসুলভ আচরণ বলে আখ্যায়িত করা যায় না।

যা-ই হোক, রোহিঙ্গা সংকট সহজেই নিষ্পত্তি হতে যাচ্ছে বলে মনে হয় না। এমনটা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও মনে করে। আরসার মতো অন্য কোনো রোহিঙ্গা বিদ্রোহী গোষ্ঠীর জন্ম হবে না, এমন নিশ্চয়তা নেই। প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশে। তাদের মধ্যে ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সী পুরুষের সংখ্যা অনেক কম। প্রশ্ন উঠেছে, তাদের সংখ্যা এত কম হওয়ার কারণ কী? তাদের সবাইকে মিয়ানমারের সেনারা হত্যা করেছে, এমন ধারণা করাও বেশ কষ্টকর।

মিয়ানমারে নতুন আরও বিদ্রোহী গ্রুপ যোগ হবে কি না, তা নিশ্চিত নয়। আরসা বা অন্য সংগঠন, বিশেষ করে কাচিন আরাকান আর্মির সহযোগী হবে কি না, তা নিয়েও আন্তর্জাতিক মহলে সংশয় রয়েছে। অবশ্য গত মাসে আরাকান আর্মির স্বঘোষিত প্রধান তুন মিয়াত নাইং ফ্রান্সের পত্রিকা লা ফিগারোতে সাক্ষাৎকারের সময় অস্বীকার করে বলেছিলেন, এ ধরনের সম্ভাবনা নেই। কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন, মুসলমানদের সঙ্গে মিয়ানমারের সংঘাত ভিন্ন আঙ্গিকে, কাজেই আরাকান আর্মির জড়ানোর ইচ্ছা নেই।

তবে এমন সহযোগিতা ভবিষ্যতে হবে না, তা-ও হলফ করে বলা যায় না। এমনটা হলে তা উত্তর রাখাইন অঞ্চলে মিয়ানমারের বাহিনীর জন্য আরও উদ্বেগজনক হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সংকট আরও জটিলতায় পড়বে। ওই অঞ্চল হয়ে উঠবে আরও অশান্ত।

এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার, কলাম লেখক ও পিএইচডি গবেষক।