দেখুন, কীভাবে আপনার শিশুকে মেরে ফেলছেন!

দোষ করে বুড়োধাড়িরা, মাশুল গোনে শিশু। নইলে ৯৫ শতাংশ শিশুর শরীরে নিকোটিন ঢুকবে কেন? হ্যাঁ, ধূমপানের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের কথাই বলা হচ্ছে। গতকাল সোমবার পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরটি ভয়াবহ—রীতিমতো আতঙ্কজনক! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ যুক্তরাজ্যের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা সিটি করপোরেশনের আশপাশের ৯৫ শতাংশ শিশুর দেহে নিকোটিন রয়েছে, যা ফুসফুসের ক্যানসারে মারাত্মক ইন্ধন জোগায়। শুধু ফুসফুসই নয়, নিকোটিনের কুপ্রভাবে যকৃৎ-কিডনি-মস্তিষ্ক কোনোটাই সুস্থ থাকে না। বড়রাই নিকোটিনের মরণ ছোবল থেকে রেহাই পান না, আর কচিপ্রাণ শিশুদের বেলায় এটি যে কেমন মারাত্মক হতে পারে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, তামাক থেকে আসা নিকোটিনের ক্ষতিকর প্রভাবে বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৬০ লাখ লোক মারা যায়, যা বিশ্বে প্রতিবছরের গড় মৃত্যুর ১০ শতাংশ। এর মধ্যে ছয় লাখ মানুষ মারা যায় ধূমপানের পরোক্ষ প্রভাবে। অর্থাৎ, ধূমপায়ী তামাক সেবন করে আর তার ধোঁয়ায় আক্রান্ত হয় আশপাশের মানুষ। আমাদের দেশে ধূমপায়ীর অন্ত নেই। গ্রামই বলুন আর শহরই বলুন, ছেলেপুলেরা অনেকে গোঁফের রেখা ফোটার আগেই তলে তলে ধূমপানে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। আর তা বড়দের দেখে দেখেই শেখে। কেবল পুরুষই নয়, আমাদের দেশে নারী ধূমপায়ীর সংখ্যাও কম নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, দেশে মোট নারীর দুই কোটিরও কিছু বেশি তামাক সেবন ও ধূমপানে আসক্ত (বাংলাদেশ প্রতিদিন)।

আর ঢাকা তো ধোঁয়ার ধূম্রজালে ঢাকা। একদিকে ইটভাটায় কাঠ আর কয়লা পুড়ে শ্বাসরোধী ধোঁয়া উড়ছে, আরেক দিকে রয়েছে নানা কলকারখানার ধোঁয়া। আবর্জনা পুড়িয়ে ধোঁয়া ওড়ানো হচ্ছে। উড়ছে বিটুমিন পোড়ানো ধোঁয়া। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে রাশি রাশি তামাক পোড়ানো ধোঁয়া। কার্বনজনিত গ্যাসে ঢাকার আকাশ ঢাকা। এর মধ্যে অক্সিজেন ফেরারি।

অনেকটা কৌতূহল থেকেই ধূমপানের শুরু। বড়রা কত মজা করে সিগারেট ফোঁকে, আমিও একটু টেনে দেখি না কেমন লাগে—এ ধরনের কৌতূহল থেকে ছোটরা ধীরে ধীরে ধূমপানে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। বয়স বাড়ে, ক্ষতিকর অভ্যাসটাও ক্রমে গ্যাঁট হয়ে বসে। গ্রামে খেতখামারে যাঁরা কাজ করেন, কায়িক শ্রমে হাঁফ ধরে গেলে পালা করে তাঁরা হুঁকা টানেন বা বিড়ি ফোঁকেন। ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে, এটা তাঁদের ক্লান্তি দূর করে। কাজে জোশ এনে দেয়।

অনেক পরিবারে ঘরের বাড়ন্ত ছেলে বা মেয়েকেই হুঁকা সাজানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়। হুঁকা সাজানো হলে তারা গুড়ুক গুড়ুক করে দু-একবার টেনে পরখ করে ঠিকমতো হয়েছে কি না। কুয়াশাঢাকা শীতে হি-হি করে কাঁপছেন কোনো চাষি বা দিনমজুর, গা গরম করতে কী করেন দেখুন। নিকোটিনে ভরপুর ওই বিড়ি বা সিগারেট ফুঁকবেন। মানা করুন, গাল বাঁকা করে হাসবেন। উল্টো বুঝ দেবেন, ‘আরে, এতে গা গরম হয়!’

ক্লান্ত দুপুরে ছায়ায় দাঁড়িয়ে ধূমপানরত কোনো রিকশাচালক বা স্কুটারচালকের কাছে গিয়ে ধরনা দিন, আপনাকে কেয়ারই করবে না। সুখটান দিয়েই তবে নড়বে। আর এই সুখটানে কী যে সুখ, অল্পবয়সী ধূমপায়ীরা যখন পালা করে সিগারেট টানে, তখন বোঝা যায়। কেউ কেউ এমন মরিয়া থাকে, সুখটান না দিলে যেন মরেই যাবে। নিম্নশ্রেণির মানুষের মধ্যে অনেকের ধূমপানে এমন নেশা, ঘুম থেকে উঠেই বিড়ি ধরায়। নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত—এসব ঘরেও এমন ঘটনা দেখা যায়। আর সারা দিনে এক থেকে দেড় প্যাকেট সিগারেট ধ্বংস করা ধূমপায়ীরও অভাব নেই। ধূমপায়ীরা জেনেশুনে বিষ পান করে নিজেদের স্বাস্থ্যের বারোটা বাজালে কার কী করার আছে? কিন্তু তাঁদের এই রোজকার অভ্যাস যে অন্যদের যমের বাড়ি যাওয়ার পথ তৈরি করছে, কথা তো সেখানেই। নিজে মরবেন ভালো কথা, কিন্তু শিশুকে নিয়ে কেন? নারী বা পুরুষ যিনিই শিশুর সান্নিধ্যে ধূমপান করবেন, অলক্ষ্যেই শিশুর জীবনকে ধ্বংস করবেন তুষের আগুনের মতো। দেখা যায়, ধূমপায়ী অভিভাবক ঘরের ভেতর শিশুর সামনেই সিগারেট ধরিয়েছেন। শিশুটি নাক কুঁচকে অনুচ্চ আপত্তি জানাচ্ছে, পাত্তাই দিচ্ছেন না। এমন দৃশ্যও দেখা যায়, স্কুলগামী শিশুর পাশে থাকা (দায়িত্বশীল?) ব্যক্তিটিই অবলীলায় ধূমপান করছেন।

একবার এক ব্যক্তি সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন। পেছনে পাগল কিসিমের এক লোক তাঁকে অনুসরণ করছেন। হাতে আবার দা। ওই ব্যক্তি যেখানেই যান, পাগলা সেখানেই হাজির। একপর্যায়ে ব্যক্তিটি ভালোই ভড়কে গেলেন—এই পাগল আবার দা না চালায়! সিগারেট ফেলে দিয়ে তিনি ভোঁ-দৌড়! আর ওই পাগলা তখন আধখাওয়া সিগারেট তুলে আরামসে টানতে শুরু করল। কী মজা!

জানি, ধূমপান ত্যাগের কথা বললে অনেকে গাল বাঁকা করে হাসবেন। কটু কথা বলবেন। নিজের চরকায় তেল দেওয়ার ভালো পরামর্শ দেবেন। এরপরও পুরোনো সেই বচনই আওড়ে যাব। ধূমপান ত্যাগ করুন। নিজের স্বাস্থ্যের দিকে না তাকান, আপনার ঘরের শিশুর দিকে তাকান, পাশের শিশুর দিকে তাকান, নগরের শিশুর দিকে তাকান, যারা এ দেশের ভবিষ্যৎ। ঠান্ডা মাথায় একবার অন্তত ভাবুন, আপনার তামাক পোড়ানো নিকোটিন কীভাবে একটি কচিপ্রাণে ঢুকে তার মধ্যে প্রাণঘাতী ক্যানসারের বীজ বুনে দিচ্ছে! অথচ ওর কোনো দোষ নেই।

এ মুহূর্তে একটা গর্ব করতেই পারি যে আমি একজন অধূমপায়ী। কোনো দিনও তামাকজাত কোনো পণ্য বা সিগারেট আমাকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। বন্ধুদের পীড়াপীড়িতে দু-একবার যে সিগারেটে টান দিইনি, তা নয়। কিন্তু এর ধোঁয়া বা স্বাদ কোনোটাই আমাকে কখনো আকৃষ্ট করতে পারেনি। আমার কাছে সব সময়ই মনে হয়েছে, আমি ধূমপান করব না—ধূমপান ত্যাগে এই ইচ্ছাশক্তিই যথেষ্ট। অন্য কোনো কিছুর দরকার নেই।
আর ধূমপানের নেশাটা যদি অদম্যই হয়ে থাকে, যা কিছুতেই বশে আনা সম্ভব নয়, তাহলে কিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা তো নেওয়া যায়। লোকজনের ভিড়পূর্ণ জায়গায় ধূমপান না করলেই হয়। যেমন: খেলার মাঠ, বাস টার্মিনার, রেলস্টেশন, বাস বা ট্রেনের ভেতর। ধারেকাছে শিশু আছে—এমন কোনো জায়গাও বাদ দিতে হবে। সচ্ছল ব্যক্তিরা চাইলেই বাড়ির ভেতর আলাদা ধূমপানঘর তৈরি করে নিতে পারেন, যেখান থেকে পরিবারের অন্যরা, বিশেষ করে শিশুরা থাকবে দূরে। বস্তিবাসীর পক্ষে এমন জায়গা খুঁজে নেওয়া কঠিন। সে ক্ষেত্রে ঘর থেকে দূরের কোনো জায়গায় গিয়ে বিড়ি বা সিগারেট ফোঁকার কাজটা চালানো যেতে পারে। আর ধূমপানের পর একটা কাজ কিন্তু সবারই করা উচিত। তা হচ্ছে ধূমপানের পর হাত ও মুখ এমনভাবে ওয়াশ করা, যার ফলে নিকোটিন শিশুর কাছে যাওয়ার আশঙ্কা কমে যা।

শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: সাহিত্যিক, সাংবাদিক
[email protected]