কেন কুড়িগ্রাম দারিদ্র্যের শীর্ষে?

আবার দারিদ্র্যের শীর্ষস্থানটি অধিকার করল কুড়িগ্রাম জেলা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সদ্য প্রকাশিত ‘খানা আয় ব্যয় জরিপ-২০১৬’ অনুযায়ী, এই জেলার ৭০ দশমিক ৮৭ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। অথচ ২০১৪ সালের জরিপে এই জেলায় দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের হার ছিল ৬৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ। চিলমারীর মতো উপজেলায় তা ৭৭ শতাংশ। কিন্তু গোটা দেশে দারিদ্র্যের হার ২০১৪ সালের ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে চলতি বছর তা ২৪ দশমিক ৩ শতাংশে নেমেছে। তবে কুড়িগ্রামের কেন এই উল্টো যাত্রা? কেন ২০টিরও বেশি নদ–নদীর জেলায় মাছ ভোগের হার অন্যান্য জেলার চেয়ে কম? কেন হিমালয়বাহিত খনিজ উপাদানে উর্বর এই মাটির সন্তানেরাই বৈচিত্র্যহীন এবং কম খাদ্য গ্রহণে বাধ্য হয়। কেন অপুষ্টিতে, ধারদেনায় ও কিস্তিতে, অসুখে-রোগে, সড়ক দুর্ঘটনায়, রাষ্ট্রীয় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে বেশি মৃত্যুহার এখানেই?

ব্রিটিশ আমলে ফকির-সন্ন্যাসীদের হেডকোয়ার্টার ছিল রৌমারীর জাফরগঞ্জ। ভূরুঙ্গামারীতে সরাসরি যুদ্ধ হয়েছে রমানন্দ গোসাঁইয়ের সঙ্গে লেফটেন্যান্ট মরিসনের। মুক্তিযুদ্ধে রৌমারী ছিল একমাত্র মুক্তাঞ্চল; যেখানে চালু ছিল প্রথম বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন, যেখানে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ৬৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধা, ছিল বিশ্বের কাছে তুলে ধরার মতো উদাহরণ। চিলমারী, উলিপুর, ভূরুঙ্গামারী, টগরাইহাট ও তিস্তার যুদ্ধ ছিল মুক্তিযুদ্ধের গতি-প্রকৃতি পাল্টে দেওয়ার যুদ্ধ। কুড়িগ্রাম জেলার হেন কোনো গ্রাম নেই, যেখানে শহীদদের রক্ত ঝরেনি! তারপরও?

খানা আয়-ব্যয় জরিপে জেলাগুলোর দারিদ্র্যের পরিমাপ করা হয়েছে উচ্চতর দারিদ্র্যসীমার বিবেচনায়। পরিবারের দৈনন্দিন খাবারের ব্যয় ন্যূনতম খাদ্য দারিদ্র্যসীমার (ফুড পোভার্টি লাইন) সমান হলে তাকে উচ্চতর দারিদ্র্যসীমা ধরা হয়। এটা পরিমাপ করা হয় মাথাপিছু দৈনিক ২ হাজার ১২২ কিলোক্যালরিকে মানদণ্ড ধরে নির্দিষ্ট ১১টি খাদ্যদ্রব্যের ভিত্তিতে। গৃহীত খাদ্যদ্রব্যের মূল্য নিরূপণের পর তাকে খাদ্য দারিদ্র্যসীমা বিবেচনা করা হয়। সেই দারিদ্র্যসীমার কুড়িগ্রামবাসী ৭১ থেকে ৭৭ শতাংশ। খানা আয়-ব্যয় জরিপ (এইচআইইএস) ২০১৬ অনুযায়ী অন্যান্য পেশার তুলনায় কৃষিজীবীদের মধ্যে দারিদ্র্যের হার বেশি। কারণ, সরকারি সংস্থা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশে শস্যের গড় দাম কমেছে। ২০১০ সালে প্রতি টন শস্যের গড় দাম ছিল ১৯ হাজার ১৯১ টাকা। ২০১৪ সালে তা নেমে এসেছে ১৭ হাজার ৫০০ টাকায়। অথচ উল্টো দিকে কৃষি উৎপাদন খরচ আরও বেড়েছে। আর কুড়িগ্রাম জেলার বেলায় এটা আরও বেশি সত্য। খানা জরিপমতে, কৃষি খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পরই সবচেয়ে বেশি দরিদ্র রয়েছেন কর্মহীনেরা। কুড়িগ্রাম যে কর্মহীনের খনি, এ আর নতুন করে বলার কিছু নেই।

আসাম ও পূর্ববঙ্গের দরজা খ্যাত চিলমারী নদীবন্দরসহ রৌমারী ও সোনাহাট স্থলবন্দর এই জেলাতেই অবস্থিত। মোগল ও ব্রিটিশ আমলে চিলমারীতে জাহাজ তৈরির কারখানা ছিল, আসাম-বেঙ্গলের রেলওয়ে হেডকোয়ার্টার ছিল কুড়িগ্রামেরই সাবেক উপজেলা লালমনিরহাট। আসাম, মেঘালয় ও পূর্ববঙ্গের সীমান্ত কুড়িগ্রাম জেলার লাগোয়া। কুড়িগ্রাম জেলার সীমানায় জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জে গ্যাসের পাইপলাইন এবং দেওয়ানগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইন আছে। ব্রহ্মপুত্রের পূর্ব পাড় ধরে অনিন্দ্যসুন্দর দৃশ্য সৃষ্টি করে প্রাচীরের মতো চলে গেছে আসামের পর্বতমালা। ২০টিরও বেশি নদ–নদী এখানে বহমান। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মিঠাপানির মাছ বাগাড়ের এলাকা এখানেই। এ ছাড়া বিরল প্রজাতির মাছ ও মসলার জন্য তিস্তা-ধরলা ও ব্রহ্মপুত্রের চরগুলো তো বিখ্যাতই।  

জামালপুরের বকশীগঞ্জ পর্যন্ত গ্যাসলাইন ও রেললাইন আসতে পারে, রৌমারী পর্যন্ত আসে না। প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিলেও ভাওয়াইয়া এক্সপ্রেস আসে না। মুক্তিযুদ্ধের মুক্তাঞ্চল রৌমারী ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। দুর্গমতার কারণে আমাদের কৃষকেরা কৃষিপণ্যের দাম পান না। গাইবান্ধার বালাসীঘাট থেকে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের মধ্যে বহুমুখী টানেল নির্মাণের ঘোষণা এসেছে, তাই চিলমারী-সুন্দরগঞ্জ তিস্তা সেতুর নকশায় রেলপথ যুক্ত করার কথা বলেছেন গণকমিটির নেতারা এতকাল। তাহলে চিলমারী থেকে ঢাকার দূরত্ব এক-তৃতীয়াংশে নেমে আসত। তাহলে রংপুর বা লালমনিরহাট-কুড়িগ্রাম-চিলমারী-বালাসীঘাট-দেওয়ানগঞ্জ-ঢাকা নামে সংক্ষিপ্ত নতুন রুট তৈরির মাধ্যমে কুড়িগ্রাম জেলা যোগাযোগব্যবস্থার মূল রুটে চলে আসত। এ কথা রেলমন্ত্রীকে বলেছিলেন তাঁরা, কিন্তু তিনি তাঁদের কথা রাখেননি।

ব্রহ্মপুত্রের বালু আজ লুটের মাল। স্থানীয় দুই জোটের নেতৃত্বে অবৈধ বালু উত্তোলন চলছেই আর সরকারের মন্ত্রীদের নেতৃত্বে সিঙ্গাপুর-মালদ্বীপে বালু পাচারের আয়োজন চলছে। অথচ ১ টন বালু থেকে ৫৪ কেজি খনিজ উপাদান আলাদা করে রপ্তানি করতে পারলেই অনেক বৈদেশিক মুদ্রা আয় কিংবা দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে শিল্পায়ন সম্ভব। অর্থাৎ, ব্রহ্মপুত্রের খনিজ, সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ এবং ভারতের সেভেন সিস্টার্স ও দেশীয় বাজার মিলে শিল্পক্ষেত্রে এখানে ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। সম্ভব বাংলাদেশকে পথ দেখানো। আর এসব দাবিতে ২৬ নভেম্বর ডাকা গণকমিটির গণসমাবেশও হতে পারেনি। মুক্তির পথ তাহলে কত দূর? আদৌ কি মুক্তি মিলবে?

নাহিদ হাসান: প্রধান সমন্বয়ক, রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি, কুড়িগ্রাম।