উন্নয়নও চাই, বাঁচতেও চাই

বাংলাদেশে উন্নয়নের পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক-বিতর্ক চলমান। সামনের নির্বাচনেও এই বিতর্ক বড় ইস্যু হবে বলে মনে হয়। এ দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গর্ব করার মতো। বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পূর্বাভাসমতে, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাও আছে নিঃসন্দেহে। উন্নয়ন হচ্ছে। এক কথায় এই বাক্য নাকচ করে দেওয়া যাবে না। রাস্তাঘাট, বড় বড় ভবন-অট্টালিকা হচ্ছে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার মতো উন্নয়ন যথেষ্ট আছে।

তবে উন্নয়ন বলতে আসলে আমরা জনগণ কী বুঝি? উন্নয়ন কি ফাঁপা হবে, নাকি টেকসই হবে? কোনটা দরকার আমাদের? এই বিষয়ে সবাই একমত যে শুধু উন্নয়ন দিয়ে হবে না, সঙ্গে সুশাসন ও নাগরিক অধিকারের মতো বিষয়গুলো নিশ্চিত করে রাজনৈতিক উন্নয়নও ঘটাতে হবে। কিন্তু এই আলোচনার বাইরে সত্যিকার অর্থেই টেকসই উন্নয়নের কথা আমরা কতটা ভাবছি? আমরা কি এমন উন্নয়নের কথা ভেবেছি, যা শুধু আজকে আমাদের প্রয়োজন মেটাবে না, ভবিষ্যতের প্রয়োজনও মেটাবে? বা ভবিষ্যৎ প্রজন্মেরও একই রকম প্রয়োজন মেটাবে? এই ধারণাকেই টেকসই উন্নয়ন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। টেকসই উন্নয়নের ধারণায় রাজনীতি কোনো ভুতুড়ে বিষয় নয়। সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নও এর সহযোগী।

সাম্প্রতিক টেকসই উন্নয়নের ধারণা এসেছে ‘আওয়ার কমন ফিউচার’ বা আমাদের একক ভবিষ্যৎ নামক একটি প্রতিবেদন থেকে। পরিবেশ ও উন্নয়নবিষয়ক বৈশ্বিক কমিশন ১৯৮৭ সালে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

তো টেকসই উন্নয়ন না হলে কী হবে? যেভাবে উন্নয়ন হচ্ছে, তাতে সমস্যা কী? এখনই জীবন বাঁচে না, ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে লাভ কী! এই লাভ-লোকসানের খতিয়ান খুব সরল। কিন্তু আমরা চিন্তা করছি জটিলভাবে, তাই সহজ জিনিস বুঝতে এখন কষ্ট হয়। আপনার কাছে সারা দিন খাওয়ার জন্য আছে ১০ টাকা। তিনবেলা অন্তত খাওয়ার জন্য ১০ টাকা হিসাব করে খরচ করতে হবে। আপনি যদি একবারেই ১০ টাকা খেয়ে ফেলেন, তাহলে সারা দিন না খেয়ে থাকতে হবে। খুব সহজ হিসাব।

আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য আমরা যেসব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড করে থাকি, তা আমাদের চারপাশের প্রাণ-প্রকৃতি থেকেই আহরণ করি। আমাদের কৃষি ও শিল্পের কাঁচামাল আমরা প্রকৃতি থেকেই পাই। সুতরাং সেই আহরণ যদি এমনভাবে করি যে আমাদের চারপাশের পরিবেশ ও প্রকৃতি ধ্বংস হয়, তাহলে ভবিষ্যতে সেখান থেকে আর আহরণ করতে পারব না। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও তখন আর করা যাবে না। তাই শুধু প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন কোনোভাবেই টেকসই হতে পারে না।

সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এমডিজি অর্জনে বাংলাদেশের সাফল্য ছিল অনেক। সবারই আশা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি অর্জনেও একই রকম ভালো ফল করবে বাংলাদেশ। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় যে ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তার সবগুলোই একটার সঙ্গে আরেকটা সম্পর্কিত। যেসব লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, তা শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নে জোর দিয়ে অর্জন করা সম্ভব নয়। এর প্রমাণ আমরা পেলাম বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশ পরিবেশ সমীক্ষা-২০১৭’ শীর্ষক প্রতিবেদনে। এখানে দেখা যাচ্ছে, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে বাংলাদেশের পরিবেশের গুরুতর ক্ষতি হচ্ছে। এর ফলে বছরে ৪২ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির হিসেবে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২ দশমিক ৭ শতাংশ।

পরিবেশ ধ্বংস করে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। পরিবেশের ক্ষতির ফলে অন্যান্য খাত, যেমন: ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্তি, মানবস্বাস্থ্য, পানি ও স্যানিটেশন, পরিচ্ছন্ন জ্বালানি, জলবায়ু, জীববৈচিত্র্য, কাজের পরিবেশ ইত্যাদি নষ্ট হচ্ছে। এগুলো আবার ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনা নষ্ট করছে। আর এর সবগুলোই টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং এসব সূচকে অগ্রগতি না হলে অবস্থার বদল ঘটবে না। বড় বড় অট্টালিকাই শুধু বানাতে পারব; কিন্তু নিশ্বাসের নির্মল বায়ু পাওয়া যাবে না। অক্সিজেনের বদলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাতাসে দম নিয়ে বাঁচতে হবে।

পরিবেশ ও উন্নয়নের সম্পর্ক হতে হবে নিবিড়। নদীর সঙ্গে পানির সম্পর্ক যেমন। নদীকে নদীর মতো চলতে দিতে হবে আগে। তাহলেই নদীর পানি ও মাছ উপভোগ করতে পারব। ক্রমাগত নদীগুলোকে মেরে ফেলে আমরা এখন হাহুতাশ করছি। পরিবেশ ধ্বংস করে উন্নয়ন চলতে থাকলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কোনো লাভ হবে না। সত্যি বললে, দূষিত বাতাসে শ্বাস নেওয়াই সম্ভব হবে না। শ্বাস স্বল্প হবে, না দীর্ঘ হবে, সেই বিতর্ক করার সুযোগ কোথায়?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ক্রমাগত প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিবেশের সংকটের ফলে মানুষ উন্নয়ন ও পরিবেশের যোগসূত্র নিয়ে জোরেশোরে ভাবনা শুরু করেছে। তার আগে মানুষ পরিবেশ ও প্রকৃতি থেকে রসদ নিয়ে ইচ্ছামতো নিজের ভোগবিলাস পূরণেই ব্যস্ত ছিল। মানুষের এই যথেচ্ছার ভোগবিলাসকে বলা হয় ‘ট্র্যাজেডি অব কমন্স’ । ধীরে ধীরে অবস্থার অবনতি হয়েছে। মানুষ তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে প্রকৃতির ওপর প্রভুত্ব কায়েম করতে চেয়েছে। প্রকৃতিকে জয় করা, বদলে দেওয়া ও ইচ্ছামতো ব্যবহার করে কর্তৃত্ব ফলানোর মতো ভ্রান্ত ধারণায় মানুষ ডুবে ছিল। এখনো অবস্থার বদল ঘটেনি। প্রকৃতির ওপর মানুষের প্রভুত্ব কায়েমের এই যুগকে বলা হয় ‘এনথ্রোপোসিন’। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ। ফলে জীবাশ্ম জ্বালানি ও অন্যান্য সম্পদের ব্যবহার বেড়েছে। কমেছে গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ। অবনতি ঘটেছে প্রাকৃতিক পরিবেশের। ফলাফল হয়েছে মানুষের টিকে থাকার ওপর হুমকি।

এই অবস্থা থেকেই পরিবেশবিষয়ক ভাবনার সূত্রপাত। উন্নয়ন ও পরিবেশের মধ্যে একটা ভারসাম্য রাখার প্রচেষ্টা থেকে টেকসই উন্নয়ন ধারণার পথচলা। তাই সমকালীন সামাজিক উন্নয়নের সবচেয়ে সঠিক পদ্ধতি হলো সাধ্যের মধ্যে সমাজ ও অর্থনীতিকে বেড়ে উঠতে দেওয়া। সীমা ছাড়িয়ে না।

টেকসই উন্নয়নের মূল উপাদান তিনটি। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, পরিবেশের সুরক্ষা ও সামাজিক ন্যায়বিচার। তাই আমাদের নতুন অর্থনৈতিক উন্নয়ন মডেল খুঁজতে হবে। নিজেদের কাজের ফলাফল সম্পর্কে সজাগ হতে হবে। নিজেদের ক্ষুদ্র ও স্বল্পমেয়াদি ভোগের জন্য পরিবেশের বারোটা বাজানো যাবে না। আমাদের জীবন-জীবিকা রক্ষাকারী প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিবেশকে রক্ষা করতে হবে। প্রকৃতিকে অনবরত শুধু শোষণ করলেই চলবে না। আবার উন্নয়নের পাশাপাশি সামাজিক ন্যায়বিচার ও সমতার ধারণাও প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

এ কথা সত্য যে টেকসই উন্নয়নও মানুষের কল্যাণের জন্যই। তাই এই উন্নয়ন অর্জনে সমাজ, অর্থনীতি ও পরিবেশের মধ্যে একটি গতিশীল ও টেকসই ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।

খলিলউল্লাহ্‌: সহকারী সম্পাদক, প্রতিচিন্তা
ই-মেইল: [email protected]