রাষ্ট্রপতি মুখার্জিকে ভাবতে হবে

প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের পরে প্রণব মুখার্জিরই তাঁর উত্তরাধিকারী হওয়ার কথা। মূলত এ কারণেই ব্যাপক যোগাযোগ থাকা সত্ত্বেও তাঁকে ঠেলে ওপরে পাঠানো হয়। সোনিয়া গান্ধী তাঁর সন্তান রাহুল গান্ধীকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বানাতে বদ্ধপরিকর। রাহুল গান্ধীই ছিলেন প্রণব মুখার্জির রাজনৈতিক অভিলাষের পথের বাধা।
রাষ্ট্রপতি পদ গ্রহণ করা না-করার সিদ্ধান্ত প্রণব মুখার্জির ওপরই নির্ভর করে। কিন্তু যেই তিনি ঘোষণা করলেন যে ২০১৪ সালের নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হচ্ছেন না, সেই পরিষ্কার হয়ে গেল, সাজঘরে অপেক্ষা করতে করতে তিনি ক্লান্ত হয়ে গেছেন। সোনিয়া গান্ধীও সঙ্গে সঙ্গে এই ঘোষণা মেনে নিলেন, প্রণব তো রাহুলের জন্যই পথ ছেড়ে দিলেন। প্রণব মুখার্জি কংগ্রেসের খারাপ সময়ে যেভাবে উদ্ধারকর্মীর ভূমিকায় নেমেছিলেন, তাতে তাঁর ধারণা হয়েছিল নেহরুর রাজবংশকে তিনি যেমন নিরবচ্ছিন্নভাবে সেবা দিয়েছেন, তাতে তাঁকে কখনো উপেক্ষা করা হবে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, প্রণব নিজেকে রাষ্ট্রপতির পদের জন্য তৈরি করেননি। রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি যা বলতে পারেন, রাষ্ট্রপতি হিসেবে তেমন মন্তব্য করা থেকে নিজেকে বিরত রাখা উচিত ছিল তাঁর।
কিন্তু কেজরিওয়াল তাঁর আইনমন্ত্রীর পক্ষ নিয়ে যা করলেন তাতে বাজে নজির তৈরি হলো। তাঁর উচিত ছিল, দুই পুলিশের ‘ঔদ্ধত্যের’ প্রতিকারের দায়িত্ব রাজ্যের মুখ্য সচিবকেই দেওয়া। তাঁর যুক্তি হলো, তিনি তো সংবিধান লঙ্ঘন করেননি। এটা এক অদ্ভুত যুক্তি, কেননা তিনি সেই সংবিধানের ভাষা ও চেতনার কথা বলছেন, যা সব ক্ষমতা দিয়েছে নির্বাহী বিভাগকে আর মুখ্যমন্ত্রীকে বানিয়ে রেখেছে নামমাত্র সরকারপ্রধান।
মুখ্যমন্ত্রীর এই ধরনা অসাংবিধানিক নয় এমনতর যুক্তি ধোপে টিকবে না। তিনি উপলব্ধি করতে পারেননি, যে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভেতরে তাঁর দুর্গ, তারা মুখ্যমন্ত্রীর তরফে ধরনা জাতীয় কর্মসূচি চায় না, তারা চায় নিয়মতান্ত্রিক প্রশাসন। কিন্তু কেন রাজনৈতিক বিষয়ে প্রণব মুখার্জি মন্তব্য করলেন, তা আমার কাছে বোধগম্য নয়। রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রথম দিন থেকেই তিনি রাজনীতি মেশানো বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। দেশের সামনে উপস্থিত হওয়া সমস্যাগুলো নিয়ে তিনি এমনভাবে মন্তব্য করে যাচ্ছেন, যেন তিনি দেশ চালানোর সভার সভাপতি। প্রজাতন্ত্র দিবসের বক্তৃতায় তিনি আগের সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছেন এবং অনেকের মুখ থেকে বের করেছেন রাগত প্রতিক্রিয়া। কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়াসহ (সিপিআই) কয়েকটি রাজনৈতিক দল তাঁর ওই বক্তব্যকে রাজনৈতিক বলে চিহ্নিত করেছে।
রাষ্ট্রপতি মুখার্জি যা বলেছেন তা সাধারণভাবে সঠিক। যেমন, জনপ্রিয় প্রতিবাদ কখনো দেশ পরিচালনকার্যের বিকল্প নয় কিংবা বলেছেন, লোকচক্ষুর সামনে হাজির করা ভাবমূর্তির মধ্যে অনেক শঠতা থাকে। কিন্তু তিনি ভুলে গেছেন যে তিনি নিছকই সাংবিধানিক প্রধান। নির্বাচিত সংসদ এবং রাষ্ট্রের আইনসভা রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তির কাছ থেকে অন্য এ রকম মন্তব্য কেউ আশা করে না।
রাষ্ট্রপতি মুখার্জি সাধারণভাবে যা বলেছেন তা যে সঠিক, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রাজনীতিকে তিনি পরিচিত বিচরণভূমি ভেবেছিলেন, কিন্তু রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে তিনি সেই ভূমি ছেড়ে দিলেন। সোনিয়া গান্ধীর দ্বারা তাঁর বঞ্চনা হয়তো নিখাদ।
‘সরকার দাতব্য দোকান নয়’ বলেছেন রাষ্ট্রপতি মুখার্জি। নির্বাচনের আগে জনসমর্থন কাড়ার জন্য সরকারের নানা রকম প্রতিশ্রুতির সমালোচনা করে তিনি এটা বলেন। সব রাজনৈতিক দলই এটা করে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যখন ‘গরিবি হটাও’ স্লোগান তুলেছিলেন, সেই মন্ত্রিসভায়ও মুখার্জি ছিলেন। ডিএমকে পার্টির সমর্থন ধরে রাখতে মনমোহন সিং সরকার তাদের বেশ কিছু সুবিধা দিয়েছিল।
সবাই জানে, কীভাবে মুলায়ম সিং যাদবের দলের সমর্থন পেতে তাঁর বিরুদ্ধে করা সিবিআইয়ের মামলাটি তুলে নেওয়া হয়েছিল। অনাস্থা ভোটে মনমোহন সিং সরকারের পতন ঠেকাতে যে ‘দেওয়া-নেওয়া’ হয়েছিল, মুখার্জিও তার অংশ ছিলেন। মুখার্জি যদি এসবের এতই বিরুদ্ধে, যা তাঁর এখনকার
মন্তব্য থেকে মনে হচ্ছে, তাহলে কেন তিনি মুখ খুললেন না? তাঁর বিরোধিতা নিশ্চয়ই গণ্য হতো, কারণ তিনি জ্যেষ্ঠ নেতা।
যে সময় মিসেস গান্ধী পাঞ্জাব বিষয়ে রাষ্ট্রপতি জ্ঞানী জৈল সিংয়ের সঙ্গে মতবিরোধের জেরে তাঁর কাছে সরকারি কাগজপত্র পাঠানো বন্ধ করলেন, সে সময়ও মুখার্জি মন্ত্রী ছিলেন। মিসেস গান্ধী সরাসরি সংবিধান লঙ্ঘন করেছিলেন। পারতেন মুখার্জি সে সময় প্রতিবাদ করতে! রাষ্ট্রপতির দপ্তর এমন এক প্রতিষ্ঠান, যাকে হেয় করা উচিত নয়। তার পরও রাজনীতিবিদেরা তা করে থাকেন। মুখার্জিও যদি সেটা করেন, তাহলে সেটা হবে তাঁর মতো বিচক্ষণ মানুষের জন্য দুঃখজনক উদাহরণ।
মুখার্জির নীরবতার আরেকটি বড় উদাহরণ হলো, ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা জারির ঘটনা। তিনি সে সময় তাঁর বাবা জওহরলাল নেহরুর তৈরি করা সংবিধানের ওপর মারাত্মক আঘাত হেনেছিলেন। মুখার্জি সে সময় ইন্দিরাপুত্র সঞ্জয় গান্ধীর অসাংবিধানিক ক্ষমতাকেন্দ্রের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। সেই জরুরি অবস্থার সবচেয়ে ন্যক্কারজনক ফল হলো, রাজনীতি থেকে নৈতিকতার বিদায় নেওয়া। সেটা এমন এক ভয়ের সময়, যখন রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আলি আহমেদ মন্ত্রিসভায় পাস হওয়ার আগেই সরকারি ঘোষণায় সই করে ফেলতেন।
আমার অভিজ্ঞতা হলো, প্রধানমন্ত্রীরা রাষ্ট্রপতির কথায় কমই মনোযোগ দেন। যাঁরা রাষ্ট্রপতিশাসিত পদ্ধতির জায়গায় সংসদীয় পদ্ধতিকে পছন্দ করেছিলেন, সংবিধানের সেই কাঠামোকারেরা ঠিক করে দিয়েছেন যে রাষ্ট্রপতি কী করতে পারেন। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে কংগ্রেস রাষ্ট্রপতির পদকে অবান্তর করে দিয়েছে।
ঠিক-বেঠিক, নৈতিক-অনৈতিকের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম পার্থক্যরেখা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব হলো সেই রেখাটা বজায় রাখা। বক্তৃতামঞ্চ থেকে বলা সহজ যে দেশের জন্য কোনটা বিপজ্জনক আর কোনটা তা নয়। রাষ্ট্রপতি মুখার্জি যতই সঠিক হয়ে থাকুন না কেন, তাঁর উচিত ফিরে দেখা যে মন্ত্রী থাকাকালে যা যা করেছেন তার কতটা সঠিক ছিল। কেবল আইনি বিচারেই নয়, নৈতিক বিচারেও। বল এখন তাঁর কোর্টে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।