যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের মেধাবী মানুষেরা

বাংলাদেশে সেমিকন্ডাক্টর শিল্প স্থাপনের সম্ভাব্যতা নিয়ে সান হোসেতে প্রবাসীদের সম্মেলন
বাংলাদেশে সেমিকন্ডাক্টর শিল্প স্থাপনের সম্ভাব্যতা নিয়ে সান হোসেতে প্রবাসীদের সম্মেলন

আমার জীবনের বেশির ভাগ ভ্রমণই হয়েছে আমার মেধাবী ছাত্রদের সুবাদে। এবারের ভ্রমণ যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যের মিলওয়াকি শহরের মার্কেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইকবাল আহামেদের সৌজন্যে। দীর্ঘদিন ইউবিকুইটাস কম্পিউটিং নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি মোবাইলের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবার প্রকল্প বাংলাদেশ পর্যন্ত সম্প্রসারিত করেছেন, উপাত্ত সংগ্রহের স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছেন বাংলাদেশকে। এর ফলে আমাদের ছাত্রদেরও সুবিধা হচ্ছে। অধ্যাপক ইকবালের সুবাদে মার্কেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের একটি দ্বীপ তৈরি হয়েছে, যেমনটি করেছেন অস্ট্রেলিয়ায় অধ্যাপক মঞ্জুর মুর্শেদ এবং আমেরিকার নানা শহরে লব্ধপ্রতিষ্ঠ বাংলাদেশি বিজ্ঞানীরা। 

এবার ৪ ডিসেম্বরের ফ্লাইট ধরার আগের সময় এত ব্যস্ততায় কেটেছে যে ফ্লাইট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশের কোনো সময় ছিল না। অত্যন্ত ব্যস্ততার মধ্যে বিমানবন্দরে পৌঁছালাম এবং চেক-ইনের সম্ভাব্য ঝামেলা থেকেও রেহাই পেলাম। শিকাগো শহরে এলে মন গর্বে ভরে যায় বিশ্বখ্যাত স্থপতি ড. এফ আর খানের জন্য এবং তঁার নানা রকম স্বীকৃতির জন্য।
ছাত্রদের জন্য আমি সময় ও শ্রম যতটুকু দিয়েছি, তা যে কত গুণে ফেরত আসছে, বলে বোঝানো যাবে না। বিদেশ-বিভুঁইয়ে যেখানেই যাই, ব্যস্ত সময়ের মধ্যেও আমার সঙ্গে দেখা করা, দর্শনীয় স্থানে নিয়ে যাওয়া, এমআইটির মতো দামি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনারের আয়োজন করা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এবার আমার ভ্রমণ শুরু হলো প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব উপকূল দিয়ে আমেরিকার পশ্চিম পাশে। পৌঁছালাম ক্যালিফোর্নিয়ার সবচেয়ে ধনী অরেঞ্জ কাউন্টির সবচেয়ে বড় শহর সান্টা আনার জন ওয়েন বিমানবন্দরে। আমাদের জন্য জার্মানিতে ডিগ্রি করা ড. আবদুল্লাহ আল ফারুক অপেক্ষা করছিলেন। এই মেধাবী মানুষটিকে চিনতেই পারতাম না, যদি কিছুদিন আগে আমাদের বিভাগে তিনি এসে সেমিনারের আয়োজন না করতেন। ত্রিমাত্রিক প্রিন্টারের শব্দ থেকে প্রোগ্রাম পুনর্নির্মাণ করা তঁার গবেষণার বিষয়। আবার ডিজিটাল টুইন অভিধারণাকে এগিয়ে দিচ্ছে। ডিজিটাল টুইন হলো একটি বাস্তব সিস্টেমের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ডিজিটাল সিস্টেম। ডিজিটাল সিস্টেমের সিমুলেশন থেকে বাস্তব সিস্টেমের সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ সমস্যা অনুমান করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা যাবে।
আমাদের মেধাবী স্নাতক ও ফুলব্রাইট স্কলার ড. সারওয়ার পরিবারের বাসা হয়ে অত্যন্ত কেয়ারিং অদিতি ও ড. ফারুকের বাসায় রাত্রি যাপন করলাম। সকালে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া আরভাইনের ইঞ্জিনিয়ারিং ভবনে প্রবেশের পথেই ড. ফারুকের বিশাল ছবি-গবেষণার জন্য তিনি উপর্যুপরি সম্মাননা পাচ্ছেন। আমি ছবির সঙ্গে একটি ছবি তুলে গর্বিত হলাম। রাস্তায় ড. ফারুকের একাধিক পরিচিত অধ্যাপকের সঙ্গে সাক্ষাৎ-সবাই তঁাকে স্টার প্রফেসর বলে সম্বোধন করলেন। সব ক্ষেত্রেই স্টার পাওয়া যায়-যেমন সাহিত্যে, কলায়, নৃত্যে, সংগীতে, খেলাধুলায়, মুষ্টিযুদ্ধে। কিন্তু পড়ালেখা, গবেষণায়ও যে স্টার স্বীকৃতি জোটে, এই প্রথম দেখলাম। এরপর একটি সেমিনারে বক্তব্য দিলাম। আগে থেকেই ঠিক ছিল, চারজন প্রবীণ অধ্যাপকের সঙ্গে আমার কথা হবে আধা ঘণ্টা করে।
প্রত্যেকেই বাংলাদেশের ছাত্রদের ভূয়সী প্রশংসা করলেন; বিশেষ করে ড. ফারুক যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন এবং ভাবমূর্তি তৈরিতে প্রশংসনীয় অবদান রাখছেন, তা প্রত্যেকেই বললেন। এবার পঁাচজন ছাত্রকে ভর্তি করা হয়েছে, ভবিষ্যতে আরও বেশি বাংলাদেশি ছাত্রকে তারা ভর্তি করতে চায়। সন্ধ্যায় সান হোসের উদ্দেশে রওনা। প্রতিবারের মতোই চৌকস ড. ফারিবা বিমানবন্দর থেকে উদ্ধার করে মুহূর্তের মধ্যে ড. মোস্তফা পাটোয়ারীর বাসায় নিয়ে গেলেন। সেখানে আমাদের মেধাবী স্নাতকদের পাশাপাশি দেখা হলো দুই যুগ আগের সহকর্মী কাজী হাসানের সঙ্গে। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে তঁার বাসায় রাত্রিযাপন শেষে সকালে গেলাম ডিবিএল গ্রুপের কর্ণধার জব্বার সাহেবের উদ্যোগে আয়োজিত প্রবাসীদের কনফারেন্সে, যেখানে বাংলাদেশে সেমিকন্ডাক্টর শিল্প স্থাপনের সম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা হবে।
বাংলাদেশ থেকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সাইফুল ইসলাম এবং অধ্যাপক হারুন-উর রশীদ ও ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য রেজোয়ান খান এসেছেন। তারপর ফারিবার সুবাদে আবার সিএসই বিভাগের অ্যালামনাইদের ডিনারে যোগদান করলাম। আমাদের বদরুল মুনির সারওয়ার লিঙ্কডইনের মেশিন লার্নিং বিজ্ঞানী, যঁার রিকমেন্ডেশন অ্যালগরিদমের একটি পেপারের উদ্ধৃতি হয়েছে প্রায় ৬ হাজার ৭৩৬ বার, সম্ভবত কেবল প্রিন্সটন অধ্যাপক জাহিদ হাসানের একই পেপারে উদ্ধৃতির সংখ্যা বেশি ৮ হাজার ৮৯৭। প্রচারবিমুখ মুনির টেস্ট অব টাইম পুরস্কারও জিতেছেন, যা অনেক স্বনামধন্য বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন।
৯ তারিখ রাতে সিয়াটলের উদ্দেশে যাত্রা। আমার বুদ্ধিমত্তা এতই কম যে আমাকে স্বাগত জানাতে যঁারা আসেন, তঁারা ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে যান আমাকে খুঁজে পেতে। তাই সিয়াটলে মহাবুদ্ধিমান পাপ্পানাকে বলতেই আমাকে জানাল, সে খুঁজে বের করবে। নানা বিষয়ে কথা হলো, যা সত্যিই আমার বন্ধ জ্ঞানচক্ষু কিছুটা হলেও খুলে দিল। পরদিন ফারাহ পরিবারের বাসায় সারা দিন কাটালাম। ব্রাঞ্চ দিয়ে শুরু, তারপর লাঞ্চ, তারপর ডিনার এবং ফঁাকে ফঁাকে বিস্তর খাবার। এক হাতে এত কাজ কীভাবে করা যায়, তা আবার ফেরদৌস জানাল যে এত বুদ্ধির মানুষের পক্ষে মাত্র একটি কাজ করা মেধার প্রতি রীতিমতো অবিচার। তাই এক হাতে চৌদ্দ কাজ করে ফারাহ এবং তার মান হয় সবাইকে পেছনে ফেলে এইচএসসি পরীক্ষার মেধাতালিকায় প্রথম হওয়ার মতোই। মাইক্রোসফটের কাজের ফঁাকে দুপুরে লাঞ্চের উদ্দেশ্যে সবাই জমায়েত।
পাপ্পানা বোয়িংয়ের কারখানা দেখাল, সঙ্গে রানওয়ে। যেসব দেশে বোয়িংয়ের উড়োজাহাজ রয়েছে, তাদের পতাকা শোভা পাচ্ছে লবির ওপরেই। বাংলাদেশের পতাকা দেখে গর্বে বুক ভরে উঠল। ইশ্‌, আমাদের দেশে যদি এ রকম একটি কারখানা
থাকত এবং তাতে অনেক দেশের পতাকা উড়ত, বুক নিশ্চয়ই গর্বে দ্বিগুণ হতো। খুবই খুশি হলাম জেনে যে সিয়াটলের বাংলাদেশিরা সবাই কোনো না কোনোভাবে বাংলাদেশের নানা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। এরপর ১১ তারিখ রাতে রওনা হলাম বোস্টনের উদ্দেশে-চার্লস নদীর তীরে গড়ে ওঠা বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় এমআইটি ও হার্ভার্ডের আবাসভূমি। ইফতিয়ার জাহিদ শীতবস্ত্রসহ বিমানবন্দর থেকে আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে এল।
পরদিন সকালে দেখলাম কীভাবে একই এলাকার শিশুরা কাছের বিদ্যালয়ে পড়তে যাচ্ছে। ধনী-দরিদ্রনির্বিশেষে একই বিদ্যালয়ে, কোনো গাড়ি লাগে না, যানজট সমস্যার সৃষ্টি করে না। আমাদের দেশে আমরা যদি এমন একটি ব্যবস্থা তৈরি করতে পারতাম! কেনেডির নামে করা লাইব্রেরি দেখলাম। পরিশেষে এমআইটিতে এসে আমাদের অত্যন্ত মেধাবী স্নাতক এমআইটিতে কমপক্ষে তিনবার পঁাচে পঁাচ পাওয়া ছাত্রী সুমাইয়া নাজনীনের সুবাদে একটি সেমিনারে যোগ দেওয়ার সুযোগ ঘটল। মার্কিন মুলুকে বাংলাদেশের অন্যতম শিক্ষা প্রশাসক ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটসের প্রভোস্ট এবং এক্সিকিউটিভ ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক আতাউল করিমও এসেছেন। এই গুণী মানুষটির ব্যস্ততার কমতি নেই, কিন্তু এর মধ্যে সব দায়িত্ব সুচারুরূপে সম্পন্ন করেন, এমনকি এই জমায়েতেও এসেছেন। আমাদের দেশে আইসিসিআইটি নামের কম্পিউটারের যে কনফারেন্স হয়, দীর্ঘদিন নিরলসভাবে তার নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন নিভৃতে। এ ছাড়া বাংলাদেশে নানা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে তঁার নিবিড় সম্পৃক্ততা রয়েছে। এর পরদিন নিউইয়র্ক হয়ে মিলওয়াকিতে ফিরে আসা। সাত দিন সময়ের মধ্যে পশ্চিম, পূর্ব মহাসাগরীয় সীমানা এবং মধ্য আমেরিকা ভ্রমণ। বোর্ডিং গেটসমূহে সর্বদাই ঘোষণা-
প্রথম উঠবেন সেনা-বিমান-নৌবাহিনীর সদস্যরা। যার যে গুরুত্ব যে দেশে!
ভারতে প্রবাসী ভারতীয়দের সহায়তায় অনেক উন্নয়নমূলক কাজ হচ্ছে। আইআইটি কানপুরে স্ট্যানফোর্ড অধ্যাপক রাজীব মতোয়ানির নামে সিএসই ভবন, যুক্তরাষ্ট্রের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা অধ্যাপকদের নিয়মিতভাবে সম্মানজনক চেয়ারে অধিষ্ঠিত করা হয়। যেসব অ্যালামনাই আর্থিক সহায়তা দান করে থাকেন, তঁাদের নামে ভবনগুলোর নামকরণ করা হয়। গোটা আমেরিকায়ও এভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ল্যাব, ভবনসমূহের নামকরণ করা হচ্ছে। আমাদের দেশে দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ রকমটি দেখা যায় না। সীমিত সম্পদের দেশে সব সম্ভাবনাই কাজে লাগানো প্রয়োজন। আশা করি, একদিন আমরা সঠিক পথে চলব এবং শুধু সুবিধাবঞ্চিত, অদক্ষ, অশিক্ষিত মানুষের শ্রমে নয়, সুবিধালব্ধ শিক্ষিত ও মেধাবী মানুষের সুবাদেও দেশের অগ্রগতি ত্বরান্বিত হবে।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।