গ্রামে চিকিৎসার দায়িত্ব কারা নেবেন?

উপজেলা ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসক না থাকার বিষয় নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে মাঝেমধ্যে খবর প্রকাশিত হয়। এ বিষয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতাও রয়েছে আমাদের অনেকের। সমস্যাটি আলোচিত হয় জাতীয় সংসদেও। স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন সরকার স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণের জন্য বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে চলেছে। এটা হয়তো প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। তবে আমাদের রাষ্ট্রের সামর্থ্যের বিবেচনায় অনেক বললেও অত্যুক্তি হবে না। এ ক্ষেত্রে সরকারের রাজস্ব বাজেট ছাড়াও বিদেশি দাতা সংস্থার ঋণ রয়েছে। দান-অনুদানও আছে কিছু। তবে ঋণ শোধ করতে হয় সুদসহ। দান-অনুদানটাও এ দেশের জনগণের জন্য বিভিন্ন বন্ধুরাষ্ট্র ও সংস্থার উপহার। এসব অর্থে উপজেলায় নির্মিত হয়েছে ৩১ থেকে ৫০ শয্যার হাসপাতালসহ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। আর ইউনিয়নে স্বাস্থ্যকেন্দ্র। ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে প্রচুর ব্যয় হয়। পাশাপাশি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বহু মূল্যবান চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ করা হচ্ছে। অনেক কেন্দ্রেই আছে অ্যাম্বুলেন্স। বেশ পরিমাণ টাকার ওষুধও প্রতিবছর কেনা হয় এসব চিকিৎসাকেন্দ্রের জন্য। এগুলোর সদ্ব্যবহার হতে হলে প্রয়োজন উপযুক্ত জনবল। বিশেষ করে চিকিৎসক, প্যারামেডিকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, কর্মচারী। কর্মচারীর স্বল্পতা ক্ষেত্রবিশেষে প্রকৃত সেবাদানে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। 

তবে তার চেয়েও বড় বিঘ্নের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে চিকিৎসকদের গ্রামে থাকার ব্যাপারে অনীহা। এটা দীর্ঘকাল ধরে চলছে। এ কারণে প্রায় সব উপজেলা ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সেবাদানের মান ঈপ্সিত মাত্রার অনেক কম। অথচ এসব স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসকের সংখ্যা সরকার অকৃপণভাবে বাড়িয়েছে। তবে শূন্য পদে সময়মতো নিয়োগ না দেওয়া এবং তদবিরে গ্রাম থেকে শহরে, বিশেষ করে ঢাকায় চলে আসার সুযোগ এই সংকট সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে উপজেলা ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো রয়েছে বেহাল অবস্থায়। সরকার বিশেষ বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে দুই দফায় শিগগিরই ১০ হাজার চিকিৎসক নিয়োগের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। কিন্তু চিকিৎসকদের কর্মস্থলে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে না পারলে তিমির ঘুচবে না। তিন বছর আগেও একসঙ্গে ৬ হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তখনো তাঁদের অনেকে গ্রামঞ্চলে ছিলেন কাগজে-কলমেই।
চিকিৎসকেরা সমাজের মেধাবী ছাত্রদের মধ্য থেকে আসেন। সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে একরূপ বিনা মূল্যে পড়াশোনার সুযোগ নিয়েছেন অনেকে। অর্থের জোগান দিয়েছেন করদাতা জনগণ। অবশ্য বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়তে বেশ টাকা ব্যয় হয়। তবে মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিক তো পড়েছেন সরকারের অর্থানুকূল্যেই। যেভাবেই হোক, তাঁদের জন্য ভালো বেতন-ভাতার ব্যবস্থা রয়েছে। আইনগত সুযোগ আছে কর্ম সময়ের পর ফি নিয়ে রোগী দেখার। সামাজিক মর্যাদাও তাঁদের অনেক। শ্রেণি হিসেবে চিকিৎসকদের ওপর আমরা সবাই নির্ভরশীল। স্বাস্থ্যগত যেকোনো সংকটে তাঁদের দ্বারস্থ হতে হয়। তাঁরা এই সমাজেরই অংশ। ফলে সমাজের প্রতি তাঁদের দায়বদ্ধতার একটি ব্যাপার রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কোনো ঘাটতি দেখা গেলে আমরা আহত হই। আর এর খেসারতও দিতে হয় জনগণকে।
এর একটি দিক চিকিৎসকদের গ্রামছাড়া হওয়া। তাঁরা যাচ্ছেন শহরে। বিশেষ করে ঢাকা মহানগরে। কেউ কেউ উচ্চশিক্ষার জন্য, কেউবা ‘গ্রামে থাকা সম্ভব নয়’ অজুহাতে। সম্প্রতি স্থানীয় একটি বাংলা দৈনিকের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন অনুসারে হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ১৩ জনের মধ্যে ৫ জন চিকিৎসক কর্মরত আছেন। পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলা ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অনুমোদিত ৩৯ জনের বিপরীতে আছেন ১৪ জন। তেমনি শরীয়তপুরের গোসাইরহাটে ২৫ জনের বিপরীতে ৫ জন। সেই প্রতিবেদন ৫০টি উপজেলার তথ্য নিয়ে প্রণীত। এর সারসংক্ষেপ হলো তিন বছর আগে নিয়োগ পাওয়া চিকিৎসকদের ৭৫ শতাংশ গ্রাম ছেড়েছেন। অন্যরাও চেষ্টায় আছেন। কৌতূহল থাকতে পারে, তাঁরা যাচ্ছেন কোন পদের বিপরীতে?
ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে খুঁজলে দেখা যাবে, অনেক ক্ষেত্রে পদের অতিরিক্তসংখ্যক চিকিৎসক প্রেষণে বা সংযুক্তি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া আছে। কেউ কেউ উচ্চশিক্ষা নিতে সচেষ্ট। উচ্চশিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন। তবে কারা উচ্চশিক্ষা নেবেন এবং কোন প্রক্রিয়ায়, এটা তো সরকার কর্তৃক নির্ধারিত নিয়মে হতে হবে। আর মেধা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে বাছাই করে এই সুযোগ দিলে বিভ্রাটও হবে না। তা না করে যাঁর যঁার সুযোগমতো দেনদরবার করে এসব করায় গ্রামাঞ্চলের চিকিৎসাব্যবস্থায় বরাবর সংকট অবস্থা বিরাজ করছে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে আমাদের বিনিয়োগ অনেক।
উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসকদের না থাকা সম্পর্কে যেসব কারণ বলা হয়, তা একটু তলিয়ে দেখা দরকার। বলা হয়, থাকার মতো উপযুক্ত পরিবেশ নেই। নেই প্রয়োজনীয় অবকাঠামো। সবার জন্য বাসভবন তৈরি হয়নি এটা সত্য। তবে চিকিৎসকেরা সেখানে থাকা শুরু করলে প্রয়োজনে সরকার আরও বাড়িঘর তৈরি করতে পারে। তবে বাসা ভাড়ার ভাতা হিসেবে এখন যে টাকা দেওয়া হচ্ছে, তার অনেক কম টাকায় উপজেলা পর্যায়ে থাকার ব্যবস্থা করা যায়। ইউনিয়ন পর্যায়ে যাঁদের পদায়ন হয়েছে, সেখানে চিকিৎসকদেরও থাকার আবশ্যকতা রয়েছে। আজকের উপজেলা পর্যায়ে নগরায়ণ অর্ধশতাব্দী আগের অনেক মহকুমা (এখনকার জেলা) শহরের চেয়ে কম নয়। ভাড়ায়ও বাসা পাওয়া যায়। বহুসংখ্যক ইউনিয়ন পর্যায়েও চিকিৎসকদের ভাড়ায় বাসা পাওয়া সম্ভব।
উপজেলা পর্যায়ে ইউএনও এবং এসি ল্যান্ডরা থাকছেন। থাকছেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ বেশ কয়েকজন অফিসার ও কনস্টেবল। অন্যান্য বিভাগের অনেক কর্মকর্তাই থাকেন। থাকেন কিছু চিকিৎসকও। সেখানে আছেন কলেজ ও স্কুলের শিক্ষকেরাও। সবাই থাকলে সমাজ আরও সমৃদ্ধ হবে। রয়েছে হাটবাজার ও দোকানপাট। যোগাযোগব্যবস্থা ক্রমান্বয়ে সহজতর হচ্ছে। মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক সর্বত্র। সুন্দরবনে বন বিভাগের দুর্গম বিট অফিসগুলোতেও সার্বক্ষণিক অবস্থান করছেন সেখানে পদায়নকৃত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সুতরাং পরিবেশ না থাকার কথাটি বলা গ্রহণযোগ্য নয়। অন্যদিকে যে পদটির বিপরীতে যার পদায়ন, সেখানে সেবা নিশ্চিত করা তাঁর দায়িত্ব।
কথা থাকবে, এর বিকল্প কী হতে পারে? কেউ হয়তো বলতে পারেন বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারভুক্ত চিকিৎসকদের সিংহভাগ যখন উপজেলা ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কাজ করতে অনিচ্ছুক, সে ক্ষেত্রে বিসিএসের বাইরে থেকে সরাসরি এগুলোর জন্য চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হোক। একসময় থানা পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা জেলা বোর্ডের নিয়ন্ত্রণে চলত। জেলা বোর্ডই নিয়োগ দিত এলএমএফ ডাক্তারদের। সেই জেলাতেই তাঁদের নিয়োগ-বদলি হতো। ওই চিকিৎসকেরা সেই সব স্থানেই অবস্থান করতেন সপরিবার। তাঁদের সন্তানেরা স্কুল পর্যায়ে পড়াশোনাও করত সেখানেই। তাদের কেউ কেউ দেশে কর্মজীবনের উন্নতির শিখরে পৌঁছেছে এমন নজিরও আছে।
অবশ্য এমবিবিএস পাস করা চিকিৎসকদের এরূপ নিয়োগ দেওয়া হলে তাঁদের চাকরিতে পদোন্নতির সুযোগ সীমিত হয়ে যাবে। কমে যাবে বিসিএসের মাধ্যমে তাঁদের নিয়োগ। তবে বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে এরূপ কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার জোরালো দাবি আসতে পারে। সুতরাং আগে থেকেই এর কোনো সুযোগ যাতে না থাকে, সেদিকে চিকিৎসকদের সতর্ক হওয়া আবশ্যক। তাঁদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে এবং চিকিৎসকদের একটি নির্দিষ্ট সময় অবস্থানের বিষয়ে কঠোর ভূমিকা নিতে সরকারকে সহায়তা করতে পারে। তাদের পক্ষ থেকে অবশ্য সংগঠনের মহাসচিব চিকিৎসকদের মানসিকতা পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়েছেন। তবে এটাই যথেষ্ট নয়। সরকার ও অধিদপ্তরের পক্ষপাতহীন কঠোর অবস্থানই এখানে প্রয়োজন।
অবশ্য গোটা ব্যবস্থাটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়েছে বলে পত্রপত্রিকায় দৃশ্যমান হয়। উপজেলা পর্যায়ে হাসপাতালে চিকিৎসকদের না থাকার বিষয়ে সংসদেও জোরালো বিতর্ক রয়েছে। দেখে অবাক লাগল, সেখানে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী বললেন, ‘ডাক্তাররা বেশ প্রভাবশালী এবং তদবিরে পাকা। প্রভাব খাটিয়ে তদবির করে বদলি হয়ে যান। অনেকে তদবির করে উচ্চতর ডিগ্রি ও প্রশিক্ষণে চলে যান।’ তাঁদের প্রভাব সরকারের চেয়ে বেশি কি না, এটা বোধগম্য হলো না। এই নৈরাশ্যবাদী বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। আশা করব সব মহলই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখবে।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
[email protected]