চীনের ঋণ সাম্রাজ্যবাদ

ব্রহ্ম চেলানি
ব্রহ্ম চেলানি

শ্রীলঙ্কা এ মাসে চীনের বিপুল পরিমাণ ঋণ শোধ করতে না পেরে হাম্বানটোটার মতো কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বন্দর এশিয়ার এই পরাশক্তির হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দিয়েছে। এটা ছিল চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) অধীনে তাদের এক বড় অধিগ্রহণ। দেশটির প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং এই প্রকল্পকে ‘শতাব্দীর সেরা প্রকল্প’ আখ্যা দিয়েছেন। এই ঘটনায় বোঝা যায়, চীনের ঋণ ফাঁদের কূটনীতি কতটা কার্যকর হতে পারে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের ঋণের মতো এটি নয়, চীনা ঋণের বিপরীতে গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ জামানত রাখতে হয়, যেসব সম্পদের দীর্ঘ মেয়াদে উচ্চ মূল্য আছে। উদাহরণ হিসেবে এই হাম্বানটোটার কথাই বলা যায়। এই বন্দর ভারত মহাসাগরে ইউরোপ, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার বাণিজ্যপথের সংযোগকারী বন্দর হিসেবে কাজ করে। গরিব দেশে অবকাঠামো নির্মাণ ও অর্থায়ন করে চীন সেখানকার প্রাকৃতিক সম্পদের সুবিধাজনক ব্যবহার দাবি করে, তার মধ্যে যেমন প্রাকৃতিক সম্পদ আছে, তেমনি বন্দরও আছে।

এ ছাড়া শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা থেকে নগ্নভাবে বোঝা যায়, চীনা অর্থায়ন তার ‘সহযোগী’ দেশকে অর্গলে বাঁধতে পারে। অনুদান বা বিশেষ ছাড়ে ঋণ না দিয়ে চীন বাজারমূল্যে বড় বড় প্রকল্পে ঋণ দিয়ে থাকে। এতে যেমন স্বচ্ছতা থাকে না, তেমনি পরিবেশ ও সামাজিক প্রভাব সমীক্ষারও বালাই থাকে না। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন সম্প্রতি বলেছেন, এই বিআরআই দিয়ে চীন ‘নিজের নিয়মকানুন ও মানদণ্ড নির্ধারণ’ করতে চায়। নিজের অবস্থান আরও শক্তিশালী করতে চীন স্বীয় কোম্পানিগুলোকে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বন্দরগুলো সরাসরি কিনতে উৎসাহিত করে। ওদিকে চীন ভূমধ্যসাগরে ৪৩ কোটি ৬০ লাখ ডলারে নগদ অর্থের ঘাটতিতে থাকা গ্রিসের কাছ থেকে পিরায়েয়ুস বন্দর কিনে নিয়েছে, যেটা ইউরোপে বিআরআই প্রকল্পের ‘ড্রাগন হেড’ হিসেবে কাজ করবে।

আর্থিক শক্তি এভাবে কাজে লাগিয়ে চীন মূলত এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চায়। প্রথমত, তারা নিজেদের অতি সক্ষমতার সমস্যা মোকাবিলায় রপ্তানি চাঙা করতে চায়। আর দ্বিতীয়ত, তারা নিজেদের কৌশলগত স্বার্থ এগিয়ে নিতে চায়, যার মধ্যে আছে কূটনৈতিক প্রভাব অর্জন, প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ, নিজ মুদ্রার আন্তর্জাতিক ব্যবহার বাড়ানো ও অন্য শক্তিগুলোর সাপেক্ষে আপেক্ষিক শক্তি অর্জন।

চীনের এই আক্রমণাত্মক আচরণ সম্পর্কে কম করে বললেও বলতে হয়, এটা পরিহাসমূলক। শ্রীলঙ্কার মতো ছোট দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে চীন ইউরোপীয় উপনিবেশ তার সঙ্গে যে আচরণ করত সেই কৌশল ব্যবহার করছে, যেটা শুরু হয়েছিল ১৮৩৯-৬০ সালের আফিম যুদ্ধ দিয়ে আর শেষ হয়েছিল ১৯৪৯ সালের কমিউনিস্টদের ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে। এই কালপর্বকে চীন অত্যন্ত তিক্ততার সঙ্গে ‘অপমানের শতক’ হিসেবে আখ্যা দেয়। তবে ১৯৯৭ সালে শতাব্দীরও অধিক কাল পর চীন ব্রিটিশদের কাছ থেকে হংকংয়ের সার্বভৌমত্ব পুনরায় লাভ করার ঘটনাকে ঐতিহাসিক অন্যায্যতার প্রতিকার মনে করে। কিন্তু হাম্বানটোটার ঘটনার মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, হংকং যেমন ঔপনিবেশিক শাসনে ছিল, চীন এখন সেই ঢঙে নব্য ঔপনিবেশিক বন্দোবস্ত করতে যাচ্ছে। দৃশ্যত, সি চিন পিং যে চীনা জাতির ‘মহান পুনরুত্থানের’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তার সঙ্গে ছোট ছোট রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ক্ষয়ের প্রসঙ্গটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।

ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো যেমন যুদ্ধজাহাজ নিয়ে নতুন বাজার ও উপনিবেশ দখল করেছে, তেমনি চীন সার্বভৌম ঋণ ব্যবহার করে অন্য রাষ্ট্রকে নিজের ইচ্ছার কাছে মাথানত করাচ্ছে। তবে এ জন্য তাদের একটি গুলিও খরচ করতে হচ্ছে না। ব্রিটিশরা যেমন চীনে আফিম রপ্তানি করত, তেমনি চীনের সহজ ঋণের মাদকতা আছে। আর চীন তো দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত মূল্যের সাপেক্ষে প্রকল্প বাছাই করছে, তাতে যে স্বল্পমেয়াদি ফল আসবে, তা দিয়ে ওই দেশগুলো ঋণ পরিশোধ করতে পারবে না। এতে চীন অতিরিক্ত সুবিধা পেয়ে যাবে, যেটা কাজে লাগিয়ে সে ঋণগ্রহীতাদের ঋণকে ইকুইটিতে (শেয়ার) পরিণত করতে পারে। এভাবে তারা বিভিন্ন দেশকে ঋণের ফাঁদে ফেলে তাদের দিয়ে ঋণ দাসত্ব করাতে পারে।

পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো যে শর্ত দিয়ে চীনকে তার বন্দর ইজারা দিতে বাধ্য করত, এখন চীনের শর্তে তার প্রতিধ্বনি শোনা যায়। ব্রিটেন ১৮৯৮ সালে ৯৯ বছরের জন্য চীনের কাছ থেকে নতুন ভূমি ইজারা নেয়। এতে হংকংয়ের ভূমি ৯০ শতাংশ সম্প্রসারিত হয়। তা সত্ত্বেও এই ৯৯ বছরের চুক্তির মূল কারণ ছিল চীনের মাঞ্চু কিং রাজপরিবারকে মুখরক্ষার সুযোগ দেওয়া। বাস্তবতা ছিল এ রকম যে সব অধিগ্রহণই চিরস্থায়ী মনে করা হতো।

এখন চীন নিজে এই শর্তগুলো প্রয়োগ করছে। হাম্বানটোটা বন্দরের ইজারা চুক্তিতে, যেটা এ বছরের গ্রীষ্মে শেষ হয়েছে, এই অঙ্গীকার ছিল যে চীন শ্রীলঙ্কার ১১০ কোটি ডলার ঋণ মওকুফ করে দেবে। এর আগে ২০১৫ সালে চীন অস্ট্রেলিয়ার ডারউইন গভীর সমুদ্রবন্দর ৩৮ কোটি ৮০ লাখ ডলারে ৯৯ বছরের জন্য ইজারা নেয়, যেখানে সহস্রাধিক মার্কিন মেরিন সেনার অবস্থান। একইভাবে তারা বিপুল ঋণে জর্জরিত জিবুতিকে শত শত কোটি ডলার ঋণ দিয়ে সেখানে তাদের প্রথম বিদেশি ঘাঁটি নির্মাণ করেছে। মার্কিন নৌঘাঁটি থেকে সামান্য দূরে হওয়ায় জিবুতি কৌশলগতভাবে তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। শুধু এখানেই নয়, তুর্কমেনিস্তান, আর্জেন্টিনা, নামিবিয়া ও লাওসে তারা একই কাজ করেছে।

এসব অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের কাছে সতর্কবার্তা হিসেবে আবির্ভূত হওয়া উচিত, সেটা হলো বিআরআই মূলত এক সাম্রাজ্যবাদী প্রকল্প, যার লক্ষ্য হচ্ছে রূপকথার সেই মিডল কিংডমের অবসান ঘটানো। যেসব রাষ্ট্র চীনের ঋণ দাসত্বে আটকা পড়েছে, তারা যেমন নিজেদের সবচেয়ে মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ হারানোর ভয়ে আছে, তেমনি সার্বভৌমত্বও হারানোর ঝুঁকিতে আছে। নতুন সাম্রাজ্যবাদীর লৌহহস্ত মখমলের দস্তানায় ঢেকে আছে। এই হাত ছোট দেশের প্রাণশক্তি নিংড়ে বের করে নিতে পারে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।
ব্রহ্ম চেলানি: নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক।