গোধূলি গগনে মেঘে

গানটি রবীন্দ্রনাথের। শ্রোতার অভাব ঘটলে নিজেকেই শোনাই, যখন আমার সঙ্গে একমাত্র কবি। বসি রাত বারোটার পর, সবাই ঘুমিয়ে। প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি সুরের বিন্যাস আমাকে নিয়ে যায় উপলব্ধির অন্য স্তরে, যেখানে পৌঁছাতে প্রয়োজন এমন শ্রোতার, যে গানটির মধ্যে ডুবে গিয়েছে।

সম্প্রতি কয়েকজন শিল্পীর নতুন নতুন পরিবেশনায় পাচ্ছি এ গানগুলোর সঙ্গে ইউরোপীয় অর্কেস্ট্রেশনের অপূর্ব সমন্বয়। নতুন নতুন বাদ্যযন্ত্র সংযোজিত হয়েছে, পুরোনোর বদলে। নেই তবলা, নেই সেতার, সেখানে জায়গা করে নিয়েছে পিয়ানো, গিটার, স্যাক্সোফোন, অক্টোপ্যাড, বেহালা, সন্তুর ও মধ্যপ্রাচ্যের নানা যন্ত্র। বৃন্দ বাদ্যের এই সমন্বয় কবি শুনে যেতে পারেননি।

সন্ধ্যাবেলায় হাঁটতে যাই। চয়ন করা শিল্পীর সেরা গানগুলো দুই কানে বাজতে থাকে। এক ঘণ্টায় পাঁচ কিলোমিটার হাঁটতে গিয়ে বেশ কিছু গানের মর্মে প্রবেশ করতে পারি। শরীরের প্রয়োজনে হাঁটা, আত্মার প্রয়োজনে কর্ণে সংযোজিত সর্বাধুনিক হেডফোন। বাহবা দিতেই হয় সেই সব সংগীত পরিচালককে, যাঁদের কারণে এখনো হৃদয় ভরে যায় অনাস্বাদিত সুরালোকের ছোঁয়ায়। সংগতি রেখে শিল্পীর পরিবেশনা একেকটি গানকে দেয় নতুন মহিমা। গান শুনতে হয় গভীর অনুভূতির স্পর্শ নিয়ে, নীরব নিভৃত একাকিত্বে।

গোধূলি গগনে মেঘে যখন মেঘে ঢেকে ছিল তারা, তখন শ্রোতা সেই তারাগুলো দেখতে পেয়েছিল কি? গোধূলি গগনের তারার সঙ্গে রজনীর অন্য প্রহরের তারার কী পার্থক্য, কোথায় মিল, কোথায় অমিল, তা খুঁজে ফিরবে শ্রোতা ওই শিল্পীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে। একটি গান শুনে ফেলা অত সহজ নয়। গানটির মীর, সেতারের অল্প একটু ছাড়, বেহালার ক্রন্দন, পিয়ানোর রিনিঝিনি একই গানকে নানাভাবে হৃদয়ের দুয়ার খুলে দিতে পারে। স্বাগতালক্ষ্মীর প্রথম গান শুনে অভিভূত হয়ে পড়ি। কোথায় কোথায় তাঁর গান পাওয়া যায় খুঁজে ফিরি। ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে ঠিক তাঁর সামনাসামনি বসে বুঝতে চেষ্টা করি সেই গানগুলো, যা রবীন্দ্রনাথ অর্গানে নিজে বাজিয়ে গাইতেন। আমিও চেষ্টা করি পিয়ানোতে সুর তুলে সেই ছন্দের আবিষ্কার। ওই শিল্পী পরপর ১২টি গান গেয়ে শুনিয়েছিলেন। ঢাকার কোনো কাগজে সে গানের বিবরণী ছিল কি না, আমি জানি না।

কিন্তু আমার হৃদয়ে গানগুলো অক্ষয়। ঠিক যেমন মধুমিতার কণ্ঠে বেশ কটি গান প্রতি সন্ধ্যায় আমাকে নতুন সংগীতের পথ দেখায়, রেজওয়ানার গান আমি শুনছি বহুদিন ধরে এবং যখন বলা হয় সে সবচেয়ে সুন্দর রবীন্দ্রনাথের গান পরিবেশন করে, তখন আমার মনে কিছুটা গর্ববোধ জাগে বৈকি। তেমনি মিতা হক ও অদিতি মহসিনের পরিবেশনায়। একদিন ক্লাবে গেলাম অদিতির গান শুনব বলে। কিন্তু সে এত দেরিতে গান ধরল যে আমার তখন দারুণ খিদে পেয়েছে। শিল্পীকে বললাম, তোমার গান শোনার জন্য সন্ধ্যা থেকে বসে আছি। তুমি এত দেরিতে আবির্ভূত হলে।

মৃদু হাসিতে বলল, আপনি তো আমার সব গান শুনেছেন। আর নতুন কী গাইব? বাসায় গিয়ে আমার শব্দসঞ্চারি যন্ত্রে অদিতি শুধু আমার জন্য গাইল সেই সব গান, যা নতুনভাবে পরিবেশিত অর্থাৎ আরও সুন্দরভাবে আরও দীর্ঘ সময়ব্যাপী আয়োজনে, যা শ্রোতাদের জন্য প্রস্তুত। শুভমিতার গান ভালো লাগে। কয়েকটি বছরে তার আধুনিক বাংলা গান, রবীন্দ্রনাথের গান, গজল, ঠুমরি, কাজরি, শ্রোতাদের হৃদয় জয় করতে সমর্থ হয়েছে। বারবার শোনার পর মনে হয়েছে, আরও শুনব, এখানেই তার জিত। কারণ, তার সঙ্গে মিশ্রিত কয়েকটি ঘরানার শাস্ত্রীয় সংগীতের চর্চা। এরপর নচিকেতার আবির্ভাব তার জীবনে। একটি গানেই মোটামুটি বোঝা যায় একজন শিল্পীর আবির্ভাব ঘটেছে।

গোধূলি গগনে আমার চোখের সামনে ঠিক যেমন একটি রুপালি নদীর দৃশ্য ভেসে ওঠে, তেমনটি আর কারও চোখের সামনে ভাসে কি না আমার জানা নেই। আমি দেখতে পাই আমার নিজ গ্রামের কালজানি নদী। কানের মধ্যে পৌঁছায় আরেক সুর: ‘কন বঁধুয়া মোর কেমন আছে রে’। দূরে কতগুলো গরু বাড়ি ফিরছে। পথের ধূলিতে ক্লান্ত তারা। এটাই গোধূলি লগ্ন, সূর্যের ডুবে যাওয়ার আগের দৃশ্য।

জীবনে এমন মুহূর্ত আসতে পারে, যখন সবকিছুই মনে হয় অর্থহীন, হৃদয়–কোণে অস্থির ভালোবাসার অনুভূতিটুকু ছাড়া। গানগুলো কোথা থেকে নিয়ে আসে নতুন অর্থ, যা আগে বুঝিনি। অবাক হয়ে শুনে যাই গীতিকারদের সেই বাণী, যার মধ্যে সংযোজিত সুর ও গাওয়ার ভঙ্গি। সত্যিকার শ্রোতা কত গভীরভাবে গানগুলোর মধ্যে আনন্দ আহরণ করে, তার খবর বেশির ভাগ লোকের কাছে নেই। নন্দনতত্ত্বের কথা আসবে, সুরের কারুকার্যের সঙ্গে যন্ত্রের যে বিবাহ, তার কথা আসবে; কিন্তু সবচেয়ে প্রয়োজনীয় হবে সেই মনটির, যে রাগিণীর মধ্যে ভালোবাসার ছোঁয়া পেয়েছে।

একজন পণ্ডিত যশরাজ, যাঁর বয়স হয়তো ছিয়াশি ছাড়িয়ে গিয়েছে, তিনি কোনো রাগ স্পর্শ করার আগে দু-তিন মিনিট ধ্যানে প্রবিষ্ট হন। ওই ধ্যানটুকু তাঁকে নিয়ে আসে সংগীতের ভালোবাসার কাছাকাছি। যে ভালোবাসবে না, সে সংগীতের কাছে কিছু পাবে না। তাই ওই পণ্ডিতের গান যখন শ্রোতারা প্রাণভরে উপভোগ করেন, সেটা রূপময় হয়ে প্রকাশিত তাঁদের হৃদয় অঙ্গনে। সংগীত যে কত উৎকৃষ্ট সাধনা, তাও বোঝা যায় এই মানের শিল্পীদের পরিবেশনায়।

জীবনভর অনেক সংগীতগুরুর পায়ের কাছে গান শোনার সৌভাগ্য হয়েছে, কেউ আমার বন্ধু। এখন আর ফুল কাননের ফুলগুলোকে সাধ্যমতো বাঁধতে পারি না তোড়ায়। যখন রাগিণীর সুরে কণ্ঠ আশ্রয় পেয়ে যায়, তখন নিজের মনেই আসে অন্য এক অনুভূতি। কোথা থেকে ছুটে আসে অশ্রুজল, তার হদিস আজও পাইনি।

মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব।