অভুক্ত শিক্ষকেরা অনশনে, সরকার কী করছে?

জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনের ফুটপাতে বসে ছিলেন খুলনা থেকে আসা শিক্ষক শাহীনূর বেগম। পাঁচ দিন ধরে সেখানে অবস্থান করছেন তিনি l হাসান রাজা
জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনের ফুটপাতে বসে ছিলেন খুলনা থেকে আসা শিক্ষক শাহীনূর বেগম। পাঁচ দিন ধরে সেখানে অবস্থান করছেন তিনি l হাসান রাজা

রোববার প্রথম আলোর প্রথম পাতায় প্রকাশিত সহকর্মী হাসান রাজার ছবিটি যেকোনো পাঠককে নাড়া দেবে। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এই নারী শিক্ষককে দেখা যাচ্ছে গভীর বেদনা নিয়ে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তাঁর চোখ বেয়ে যে পানি ঝরছে, সেটিও ছবিতে স্পষ্ট। পাঁচ দিন ধরে নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা অবস্থান ধর্মঘট পালনের পর আজ রোববার থেকে তাঁরা অনশন পালন করছেন।

যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের মাসে বেতন-ভাতা বাবদ সরকারি অংশ দেওয়া হয়, সেগুলো এমপিওভুক্ত। আর যেগুলো এমপিওভুক্ত নয়, সেগুলোর শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকার থেকে কোনো আর্থিক সুবিধা পান না। অথচ এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সরকারি স্বীকৃতি আছে। প্রতিবছর এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষার্থী পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাসও করে। কিন্তু শিক্ষক-কর্মচারীরা বেতন পান না। প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বেতন থেকে যা পাওয়া যায়, তাতে দৈনন্দিন খরচ জোগানোও কঠিন।

সর্বশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হয় ২০১০ সালে। গত সাত বছরে বহু নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলেও এমপিওভুক্ত হয়নি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়ই কেবল শ্রেণিবিভাজন নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও রয়েছে নানা শ্রেণি—সরকারি, বেসরকারি, এমপিওভুক্ত, নন-এমপিওভুক্ত। একই পাঠ্যক্রমের আওতায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একই শ্রেণিভুক্ত হওয়া উচিত।

বর্তমানে দেশে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে প্রায় সাড়ে ২৬ হাজার। এগুলোয় শিক্ষক-কর্মচারী চার লাখের বেশি। এর বাইরে স্বীকৃতি পেলেও নন-এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান আছে ৫ হাজার ২৪২টি। এগুলোয় শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা ৭৫ থেকে ৮০ হাজার। যে সরকার বছরে চার লাখ কোটি টাকার বাজেট করতে পারে, যে সরকার মৃতপ্রায় ব্যাংকগুলোকে বাঁচাতে দুই হাজার কোটি টাকা বাড়তি বরাদ্দ দিতে পারে, সেই সরকার কেন ৭৬ হাজার শিক্ষক-কর্মচারীর দায়িত্ব নেবে না? সরকার তো দেশের প্রতিটি নাগরিককে দক্ষ জনবল হিসেবে গড়ে তুলতে চায়। শিক্ষা হলো শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ। আর এই খাতেই সরকারের বরাদ্দের হার কমে যাচ্ছে। এটি মোটেই সুলক্ষণ নয়।

এই যে পাঁচ দিন ধরে প্রায় এক হাজার শিক্ষক জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ব্যস্ত সড়কের পাশে অবস্থান নিয়েছেন, শীতের রাতে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাচ্ছেন, এ বিষয়ে সরকারের কাছ থেকে দাবিদাওয়ার বিষয়ে কোনো আশ্বাস নেই। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, এ বিষয়ে অর্থ প্রতিমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেই কমিটি যে নীতিমালা করে দেবে, সে অনুযায়ী কাজ হবে। শিক্ষকেরা আমরণ অনশনে আর মন্ত্রী বলছেন, কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কমিটি গঠিত হতে হবে শিক্ষকনেতাদের সঙ্গে নিয়ে।

এ তো সরকারের নিষ্ক্রিয়তার দিক। এই যে কয়েক দিন ধরে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে শিক্ষকেরা অনশন করছেন, বিরোধী দলের কোনো নেতাকে তাঁদের প্রতি সংহতি জানাতে দেখা যায়নি। নির্বাচন ছাড়া তাঁদের মাথায় আর কিছু নেই। নন-এমপিও ভুক্তির সমস্যাটি কেবল বর্তমান সরকারের আমলের নয়। অনেক বছরের সমস্যা।

চলতি বছর সারা দেশে অনেক মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ সরকারি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অনেক স্থানে অপেক্ষাকৃত ভালো মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সরকারি না করে রাজনৈতিক বিবেচনায় কম মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সরকারি করা হয়েছে। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি করতে সরকারের যে খরচ হয়, এমপিওভুক্ত করার খরচ তার চেয়ে অনেক কম। সরকারি করার পর সরকারকে চিরতরের জন্য সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায় নিতে হয়। কিন্তু এমপিওভুক্ত করার পর কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খারাপ ফল করলে এমপিওভুক্তি বাতিলও করা যায়।

নন-এমপিওভুক্ত ও এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিভাজনরেখাটি কীভাবে করা হয়? শিক্ষার মানের ভিত্তিতে, না মন্ত্রী-এমপিদের সুপারিশের ভিত্তিতে? প্রতিবছর এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হওয়ার পর দেখা যায়, অনেক এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে একজন শিক্ষার্থীও পাস করেনি। আবার অনেক নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভালো ফল করেছে। সরকার এ রকম একটি আইন করে দিতে পারে, শতকরা এত ভাগ শিক্ষার্থী পাস করলে এমপিওভুক্ত হবে।

টানা পাঁচ দিন অবস্থান কর্মসূচি শেষে আজ ফেডারেশনের সভাপতি গোলাম মাহমুদুন্নবী জানান, ২০১১ সাল থেকে সরকার শুধু আশ্বাসই দিচ্ছে। তাই এবার দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত প্রাণ গেলেও তাঁরা অনশন থেকে সরবেন না। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা চান তাঁরা।

অবস্থানরত শিক্ষকনেতারা বলেন, এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও একই নিয়মনীতিতে পরিচালিত হয়। একই শিক্ষাক্রম, পাঠ্যক্রম ও প্রশ্নপদ্ধতি অনুসরণ করে। শিক্ষার্থীরাও বোর্ড থেকে একই মানের সনদ লাভ করে। অথচ তাঁরা বেতন পান না। অভুক্ত অবস্থায় শ্রেণিকক্ষে যান শিক্ষার্থীদের পাঠদান করতে। এটি জাতির জন্য লজ্জাজনক।

কয়েক দিন আগে প্রাথমিক সরকারি বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকেরা বেতনবৈষম্য দূর করার দাবিতে আমরণ অনশন পালন করছিলেন। পরে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর আশ্বাসে তাঁরা অনশন ধর্মঘট প্রত্যাহার করেন। কিন্তু উচ্চশিক্ষামন্ত্রী এখনো আলোচনার আশ্বাস দেননি। তিনি তাঁদের সঙ্গে কথাও বলেননি।

রোববার বছরের শেষ দিন। আর সেই দিনই নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা আমরণ অনশন শুরু করেছেন। সোমবার নতুন বছরের প্রথম দিন। রাত ১২টার মধ্যে সরকার তাঁদের দাবিদাওয়ার বিষয়ে কোনো আশ্বাস না দিলে খ্রিষ্টীয় নতুন বছরটিও তাঁদের শুরু হবে অনশনের মধ্য দিয়ে।

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন একবার বলেছিলেন, গ্রামের ছেলেমেয়েরা আধপেটা খেয়ে নামতা শেখে। কিন্তু সেই আধপেটা খাওয়া ছেলেমেয়েদের যাঁরা পড়ান, তাঁরা প্রায় অভুক্ত। অভুক্ত থেকে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা যায় না—সেই সহজ সত্যটি আমাদের শিক্ষাব্রতী সরকার বুঝতে চায় না।