সামরিক কূটনীতি: বাংলাদেশের সম্ভাবনা

জাতিসংঘের শান্তি মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সুনাম অর্জন করেছে
জাতিসংঘের শান্তি মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সুনাম অর্জন করেছে

বর্তমান রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বাংলাদেশ বড় ধরনের চাপের মধ্যে রয়েছে। এই সংকট মোকাবিলা করতে গিয়ে দেশকে কিছু নতুন কূটনৈতিক বাস্তবতার সম্মুখীন হতে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। আমরা হঠাৎ করে আবিষ্কার করলাম আমাদের দীর্ঘদিনের কিছু বন্ধুরাষ্ট্র আমাদের সঙ্গে নেই। সংকট উত্তরণে গতানুগতিক কূটনৈতিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে আমরা অনেকাংশেই প্রত্যাশিত ফল লাভ করতে পারিনি। কাজেই আধুনিক কূটনীতির যে নানাবিধ পন্থা রয়েছে, সেগুলো সফলভাবে প্রয়োগের ক্ষেত্রে নতুন করে চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। যেমন অর্থনৈতিক কূটনীতি, সামরিক কূটনীতি, সাংস্কৃতিক কূটনীতি ইত্যাদি। দেশের স্বার্থরক্ষা এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে রাষ্ট্রের কূটনৈতিক অবস্থান মজবুত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশ যেসব কৌশল অবলম্বন করে থাকে, এর মধ্যে সামরিক কূটনীতি একটি বিশেষ কৌশল এবং বর্তমান বিশ্বে এর প্রভাব ও প্রয়োগ দুটিই উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সামরিক কূটনীতির তাৎপর্য সর্বজনস্বীকৃত হলেও এটার প্রয়োগকৌশল নিয়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। ফলে সামরিক কূটনীতির কোনো সর্বজনস্বীকৃত সংজ্ঞা নেই। তবে সাধারণভাবে এটাকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে-কোনো রাষ্ট্রের সামরিক মাধ্যমগুলোকে শান্তিপূর্ণভাবে আলোচনা এবং সহযোগিতার মাধ্যমে রাষ্ট্রের কূটনৈতিক স্বার্থে অন্য দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় কৌশলগত লক্ষ্য পূরণে ব্যবহার করা। সামরিক কূটনীতিসংক্রান্ত কৌশল প্রণয়ন ও প্রয়োগ করার দায়িত্ব পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। সামরিক মাধ্যমগুলো এ ক্ষেত্রে সহযোগীর ভূমিকা পালন করে। সামরিক কূটনীতিসংক্রান্ত কৌশলনীতি উন্মুক্ত এবং স্বচ্ছ হয়। গবেষণা ও অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিশ্বের অনেক দেশই ইতিমধ্যে সামরিক কূটনীতির ওপর জাতীয় কৌশলনীতি প্রণয়ন করেছে। উদাহরণস্বরূপ, স্পেন সামরিক কূটনীতিসংক্রান্ত একটি চমৎকার জাতীয় কৌশলনীতি প্রকাশ করেছে। ২০০৪ সালে চীন একটি সামরিক শ্বেতপত্র প্রকাশ করে, যাতে উল্লেখ করা হয়, সামরিক কূটনীতিকে চীন রাষ্ট্রীয়ভাবে একটা কৌশলগত পর্যায়ে উন্নীত করতে চায়। আমি জানি না, এ ধরনের কোনো জাতীয় পরিকল্পনা আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আছে কি না।
যদিও সামরিক কূটনীতির বিষয়টা ইদানীং বেশ জোরেশোরে আলোচিত হচ্ছে, কিন্তু এর ইতিহাস অনেক পুরোনো। তবে সময়ের সঙ্গে এর প্রকৃতি ও প্রয়োগ ভিন্ন ছিল। প্রাচীনকালে বিভিন্ন দেশের সম্রাটেরা নানা দেশে সামরিক প্রতিনিধিদল পাঠাতেন। কখনো অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যে, আবার কখনো প্রভাব বিস্তার করার লক্ষ্যে। চীনের প্রাচীন মিং সম্রাটের প্রতিনিধি হয়ে সামরিক কর্মকর্তা ঝেং হো তৎকালীন ভারতবর্ষসহ নানা অঞ্চল পরিভ্রমণ করেন। বর্তমানে সামরিক কূটনীতির ধরন বদলালেও উদ্দেশ্য অভিন্ন রয়ে গেছে। উদ্দেশ্যটা হলো দেশের কূটনৈতিক স্বার্থ সমুন্নত করা। সামরিক কূটনীতি কাজে লাগিয়ে দেশের স্বার্থে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা আদায় করার নানাবিধ কৌশল রয়েছে। বাংলাদেশের এ ক্ষেত্রে বেশ কিছু সুবিধা ও সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর মাধ্যমে কোনো দেশের সঙ্গে চমৎকার কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করা সম্ভব। বাংলাদেশ শান্তিরক্ষী বাহিনী প্রেরণের দিক থেকে প্রথম সারিতে অবস্থান করে। এই শান্তিরক্ষী বাহিনী পৃথিবীর নানা দেশে নিয়োজিত রয়েছে। আমাদের শান্তিরক্ষী বাহিনীর দক্ষতা ও বৈচিত্র্যপূর্ণ কৌশল বিশ্ব পরিমণ্ডলে বেশ সমাদৃত হয়েছে। সুদূর আফ্রিকার সিয়েরা লিওনে আমাদের শান্তিরক্ষী বাহিনীর সম্মানার্থে বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যে সম্মান ও মর্যাদা আমরা নানা দেশে পেয়েছি, তা কতটা বাংলাদেশের কূটনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগাতে পেরেছি, সেই প্রশ্ন আমার মনে বারবার ঘুরপাক খায়। বিশেষ করে আমার কম্বোডিয়ার অভিজ্ঞতার আলোকে প্রশ্নটা আরও জোরদার হয়েছে।
কম্বোডিয়ায় ১৯৯৩ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের পর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৮৮০ (১৯৯৩) প্রস্তাব অনুসারে আমি সে দেশে জাতিসংঘ স্থিতিশীলতা পর্যবেক্ষণ মিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিই। সেই বিরল অভিজ্ঞতার আলোকে আমি দেখতে পাই যে শান্তিরক্ষী বাহিনীতে অংশগ্রহণকারী দেশগুলো কীভাবে শান্তি মিশনোত্তর পর্যায়ে কম্বোডিয়ায় তাদের জাতীয় ও কূটনৈতিক অবস্থানকে শক্তিশালী ও প্রভাব বিস্তার করতে কাজে লাগায়। ইতিমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনী ৫৪টি মিশনে সুনামের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেছে। এই বিশাল অর্জন ও সম্ভাবনাকে আমরা কতটুকু কূটনৈতিক অর্জনে রূপান্তরিত করতে পেরেছি, সেই প্রশ্ন আমাদের করতে হবে। যেমন জিজ্ঞেস করা দরকার, লাইবেরিয়ার সঙ্গে আজ আমাদের কী সম্পর্ক রয়েছে? কিংবা মোজাম্বিকের সঙ্গে জাতীয় পর্যায়ে আমরা কী করছি? যেহেতু এসব দেশে স্থিতিশীলতা রক্ষায় বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনীর বিশাল অর্জন ও ভূমিকা ছিল, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে আমাদের সৈনিকেরা এ ক্ষেত্রে জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাই তঁাদের আত্মত্যাগের ফলে যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে, তা আমাদের ষোলো আনা কাজে লাগাতে হবে।
সামরিক কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমেও কূটনৈতিক সম্পর্ক শক্তিশালী করা সম্ভব। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানের সামরিক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এখানে বিভিন্ন দেশের সেনা অফিসাররা প্রশিক্ষণের জন্য আসেন। উদাহরণস্বরূপ, শ্রীলঙ্কার একমাত্র ফিল্ড মার্শাল এবং বর্তমান মন্ত্রিসভার সদস্য সারাথ ফনসেকাসহ দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ জ্যেষ্ঠ অফিসার আমাদের দেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। এই প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে যে গভীর সম্পর্ক স্থাপনে আমরা সক্ষম হয়েছিলাম, তা কি আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নে কাজে লাগিয়েছি? পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো এসব ক্ষেত্রে কার্যকর সামরিক অ্যালামনাই নেটওয়ার্ক তৈরি করে এবং তাদের কাজে লাগায়। আমরাও একইভাবে চিন্তা করতে এবং দেশের কূটনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগাতে পারি। বাংলাদেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নানা দেশের সেনা অফিসারদের কাজে লাগিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশে আমাদের কূটনৈতিক অবস্থান দৃঢ় করা এবং প্রভাববলয় শক্তিশালী করা সম্ভব।
প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক কূটনৈতিক যোগাযোগ সম্পর্ক দৃঢ় করার ক্ষেত্রে কার্যকর একটা কৌশল। ভারতের পর মিয়ানমার বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিবেশী রাষ্ট্র হওয়ায় এর কৌশলগত গুরুত্ব আমাদের জন্য অনস্বীকার্য। মিয়ানমারে চলমান রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে আমরা দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সব রকমের চেষ্টা করেছি, কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোনো আশাব্যঞ্জক ফল পাওয়া যায়নি। মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় সেনাবাহিনীর প্রভাব অপরিসীম। তা ছাড়া বর্তমান রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টা সেনাবাহিনীর আওতার মধ্যে পড়ে। ফলে দেশটির সেনাবাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত না করে সংকট মোকাবিলায় যেকোনো পদক্ষেপ বিফলে যেতে বাধ্য। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর মধ্যে যদি আগে থেকেই পেশাদার নিবিড় যোগাযোগ থাকত, তাহলে বর্তমান সংকট নিরসনে সেই সম্পর্ক চমৎকারভাবে কাজে লাগানো যেত।
কোনো দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ় করার ক্ষেত্রে সামরিক কূটনীতির অধীনে আরও বেশ কিছু কৌশল রয়েছে। উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় যোগাযোগ একটা অন্যতম মাধ্যম। ইদানীং বিভিন্ন দেশের মধ্যে যৌথ সামরিক মহড়া ও প্রশিক্ষণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, যেটা অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আস্থা ও যোগাযোগ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যুদ্ধাস্ত্র ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়-বিক্রয় ও প্রদর্শনী, আন্তরাষ্ট্রীয় সামরিক খেলাধুলার প্রতিযোগিতা ইত্যাদির মাধ্যমে পারস্পরিক সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ করা সম্ভব। এ ছাড়া দ্বিপক্ষীয় প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি অন্যতম একটা উপায়। সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের প্রেষণে সহযোগী দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও সামরিক স্থাপনায় নিয়োজিত করার মাধ্যমেও পারস্পরিক মেলবন্ধন শক্তিশালী করা যায়।
সার্বিকভাবে বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বাংলাদেশের বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে, যা সামরিক কূটনীতির ক্ষেত্রে চমৎকারভাবে কাজে লাগানো সম্ভব, কিন্তু সেটার সুবিধা আমরা এখনো পুরোপুরি অর্জন করতে পারিনি। সামরিক কূটনীতির পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করতে হলে বাংলাদেশকে একটা সমন্বিত পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। সবার প্রথমে সামরিক কূটনীতিসংক্রান্ত একটা সাধারণ জাতীয় কৌশলনীতি প্রণয়ন করতে হবে, যা দিকনির্দেশকের ভূমিকা পালন করবে। তারপর সামরিক কূটনীতির ধরন প্রতিটি রাষ্ট্রের জন্য কেমন হবে, সে সম্পর্কেও ধারণা দিতে হবে। সৈন্যদের বিদেশে পাঠানোর আগেই সামরিক কূটনীতির ওপর উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কূটনৈতিক মিশনে প্রেষণে যে সামরিক অ্যাটাশে প্রেরণ করা হয়, তাদের জাতীয় সামরিক কূটনীতিসংক্রান্ত কৌশলনীতির আওতায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। বর্তমানে ও ভবিষ্যতে যেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় চুক্তি রয়েছে কিংবা হবে, সেগুলোকে জাতীয় কৌশলনীতির অধীনে কার্যকর করতে হবে। এ বিষয়গুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করলে সামরিক কূটনীতির ক্ষেত্রে আমাদের যে অপার সম্ভাবনা রয়েছে, তা জাতীয় স্বার্থে কাজে লাগানো সম্ভব হবে।
মেজর জেনারেল আ ন ম মুনীরুজজামান (অব.): সভাপতি, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ (বিআইপিএসএস), ঢাকা।