শাহবাগে বাংলাদেশের নতুন যুগ

শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের অর্জন অপরিসীম
শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের অর্জন অপরিসীম

গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি যখন অনলাইন ব্লগার অ্যাক্টিভিস্টরা কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে জড়ো হয়েছিলেন, তখন কেউই সম্ভবত জানতেন না, এ দেশের রাজনীতির ইতিহাস শাহবাগ আন্দোলনকে এড়িয়ে আর লেখা যাবে না। সমবেত কয়েকজন তরুণ থেকে হাজার পার হয়ে লাখো মানুষের যে কাফেলা নেমেছে শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চে, যা ছড়িয়ে গেছে ঢাকা থেকে সারা দেশে, সেসব জাগরণ মঞ্চের মানুষ গেয়েছেন এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের তিমির হননের গানটি। বাংলাদেশকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নামের বিমূর্ত ধারণার মূর্ত আকাঙ্ক্ষাগুলোর, যা বাংলাদেশ বারবারই ভুলে গেছে কিংবা বিচ্যুত হয়েছে। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘কমরেড, নব যুগ আনবে না?’ এ দেশের রাজনীতির সাংস্কৃতিক নয়া যুগের ডাকটি দিয়েছে শাহবাগ।
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা নিরস্ত্র বাঙালির ওপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বলে কিছু বীর সৈনিক ও মুক্তিপাগল সাধারণ মানুষের আত্মরক্ষার তাগিদে অংশগ্রহণের ফলে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল বলে সামরিক শাসকদের কারখানায় রচিত যে বিকৃত ইতিহাস পড়ে আমরা বড় হয়েছি, শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চ চ্যালেঞ্জ করেছে সেই ইতিহাস বিকৃতির।
জাতীয় ইতিহাস নির্মাণের রূপকাঠামোটি যা মুক্তিযুদ্ধকে অনিবার্য করেছিল ১৯৭১ সালে, জাগরণ মঞ্চ সেই কাঠামোর স্তম্ভগুলোকে ফের আলোতে এনেছে। শাহবাগ মনে করিয়ে দিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল একটি শোষণহীন অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের চিন্তাকে পরিণতি দেওয়ার জন্য। একটি গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করার তাগিদে। ‘একটি ফুলকে বাঁচানো’র মতো মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রামের ফসল মুক্তিযুদ্ধ। শাহবাগ মঞ্চ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবির পাশাপাশি এ দেশের জন্মকালীন রণধ্বনি ‘জয় বাংলা’ আর যুদ্ধের প্রস্তুতিকালীন স্লোগানগুলো ফের মানুষের মুখে তুলে দিয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আরও দায়িত্বশীল এবং অধিকতর মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ঘোষিত হয়েছে তাঁদের কণ্ঠে। তাই ‘পদ্মা, মেঘনা, যমুনা-তোমার আমার ঠিকানা’র পাশাপাশি উচ্চারিত হয়েছে, ‘তুমি কে, আমি কে? বাঙালি, চাকমা’, ‘তুমি কে, আমি কে? বাঙালি, সাঁওতাল।‘ জাতিসত্তার প্রশ্নটি মীমাংসা করার পাশাপাশি ধর্মের প্রশ্নটিও আন্তরিকভাবে দেখতে চেয়েছে শাহবাগ। ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিষ্টান, বাংলার মুসলমান—আমরা সবাই বাঙালি’, ষাটের দশকের এ জনপ্রিয় আকাঙ্ক্ষাকে তাঁরা ফের মাঠে এনেছেন।
গণজাগরণ মঞ্চের আরেক অর্জন নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণের গুণগত ও পরিমাণগত মাত্রা। শত শত নারী এ মঞ্চে কাজ করেছেন। লাকী আক্তারসহ অনেক নারী আন্দোলনকারীর নামে ধারাবাহিকভাবে অপপ্রচার করা হয়েছে, কিন্তু তাঁদের অংশগ্রহণ যেমন স্তব্ধ করা যায়নি, তেমনি নারীসংক্রান্ত কোনো একটি দুর্ঘটনার খবরও জানা যায়নি। এ যেন ভেতর থেকে শুদ্ধ হয়ে এসে নারী-পুরুষ একত্র হয়েছেন দেশ মায়ের ডাকে, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে দেশটিকে প্রকৃত অর্থেই জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ নির্বিশেষে সবার করে তোলার প্রত্যয়ে। আরেকটি গুণগত উত্তরণ হতে দেখেছি, সেটি হলো স্লোগান দিয়ে শুরু করা মেয়েরা কীভাবে এই রাজনৈতিক-দলহীন রাজনীতির পরিক্রমায় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে অংশ নেওয়ার জন্য তৈরি হয়েছেন।
শাহবাগ আন্দোলনের অনবদ্যতা তার অহিংস আন্দোলনের ধারায়। বারবার অপপ্রচার আর সহিংসতার শিকার হয়েও এই মাটির সহিষ্ণু আচরণকেই আন্দোলনের উপায় হিসেবে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত জারি রেখেছে। কোনো ঘটনাকে বুঝতে হয় একই সময়ে জারি থাকা বিপরীত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। যখন জামায়াত-হেফাজত আগুন দিচ্ছে শহীদ মিনারে-ট্রেনে, উপড়ে নিচ্ছে ট্রেন লাইন, এমনকি খুন করা হয়েছে ব্লগারদের, শাহবাগ তখনো অহিংস কর্মসূচি থেকে বিচ্যুত হয়নি। আগুন আর আলোকশিখার পার্থক্য স্পষ্ট করেছে শাহবাগ। সহিংস শক্তি আগুন দিয়েছে, শাহবাগ লাখো মোমের শিখায় আলোকিত করে তুলে ধরছে এ দেশের ইতিহাস। শাহবাগের পরিচ্ছন্ন, মানবিক রাজনীতির পাশে জামায়াত-হেফাজতের বিধ্বংসী রাজনীতিটি অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে প্রকটভাবে উন্মোচিত হয়েছে। কিন্তু সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণই শাহবাগের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। শাহবাগের তরুণেরা নিশ্চিতভাবে চিহ্নিত করেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতি করার অধিকার বহাল রেখে, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দুরাশামাত্র। তাঁরা ডাক দিয়েছেন যুদ্ধাপরাধী ও সহিংস দল হিসেবে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার এবং আরও সঠিকভাবে চিহ্নিত করেছেন এসব রাজনীতিকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয় যে অর্থনীতি সেই অর্থনীতির জোগান বন্ধ করার। আবার তাঁদের তাগিদ গড়ে ওঠা অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের বিলোপ নয় বরং রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে নিয়ে আসার। বলতেই হয় তরুণদের এ আন্দোলন যথেষ্ট প্রজ্ঞাবান।
সহজ চোখে দেখলে গত এক বছরে শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের অর্জন অপরিসীম। যুদ্ধাপরাধের বিচারকে এখন ঘরে ঘরে পৌঁছে যাওয়ার দাবিতে পরিণত করতে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে এই মঞ্চ, প্রচলিত রাজনীতি যেখানে ব্যর্থ হয়েছে। পরিষ্কারভাবে তাঁরা ঘোষণা করতে পেরেছেন, এ দেশের রাজনীতিতে কোনো যুদ্ধাপরাধী দল অংশ নিতে পারবে না। সরকারি দল কিংবা বিরোধী দল, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আনুগত্য তাদের থাকতেই হবে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাই বাতিল হয়েছে জামায়াতের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার যোগ্যতা। এ কথাগুলো বলে ফেলা বা করে ফেলা এখন যত সহজ, গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি হওয়ার আগে এতটা সহজ ছিল না।
প্রচার-প্রপাগান্ডা কম হয়নি জাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে। ‘আস্তিক-নাস্তিক’ বিতর্কে জড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। প্রতিপক্ষ সফলও হয়েছিল। কিন্তু সব বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বহনকারী তারুণ্য ফের তাঁদের অনন্যতা স্থাপন করেছেন নির্বাচনোত্তর সহিংসতায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের পাশে তাঁদের উপস্থিতির মাধ্যমে। তাঁরাই যে সবচেয়ে আস্থার জায়গা এখন দেশবাসীর, সেটিও প্রমাণিত হয়েছে যশোরের অভয়নগর, মনিরামপুর এবং দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁওয়ে তাঁদের সমাবেশে লাখো মানুষের উপস্থিতিতে। কোনো রাজনীতিবিদের পক্ষেই এমন জনসমাবেশ ঘটানো নিকট অতীতে সম্ভব হয়নি। কাজেই বোঝা যায়, তারুণ্যের এই শক্তির ওপর দেশের জনগণ তাদের আস্থা স্থাপন করেছে এবং এভাবেই তারা আস্থা জ্ঞাপন করেছে মুক্তিযুদ্ধে।
তারুণ্যই যুদ্ধে যায়। ‘৫২-তে তরুণেরা গেছেন, মুক্তিযুদ্ধে গেছেন ’৭১-এর তরুণেরা। তবে সেসব যুদ্ধের সঙ্গে আজকের তরুণদের যুদ্ধের পার্থক্য হলো, এবারের যুদ্ধ কেবল চিহ্নিত শক্তির বিরুদ্ধে নয়। বরং নানা পর্যায়ের নানা আপস এবং দেশীয় আন্তর্জাতিক নানা হুমকির বিপরীতে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশকে উদ্ভাসিত করার যুদ্ধ। সেই যুদ্ধেও শাহবাগের তারুণ্য জয়লাভ করবে কারণ এই দেশের জন্মকালীন আকাঙ্ক্ষার কাছেই কেবল তাঁদের আনুগত্য। শাপলা চত্বরে যে উপায়হীন কিশোর-তরুণদের আমরা দেখেছি, তাদের ভাবনাও এই তরুণেরা রাখবেন তাঁদের বিবেচনায়, শুরু হওয়া নতুন যুগের মানবিকতায় এ দাবি থেকেই যায়। তারুণ্যের জাগরণ চিরজীবী হোক। জয় বাংলা।

ড. কাবেরী গায়েন: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।