ঢাকার নির্বাচনটি যেন আটকে না যায়

রংপুরে এক লাখ ভোটের ব্যবধানে হেরে যাওয়ার পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য রাজধানীর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। নির্বাচন কমিশন স্বাধীন। কিন্তু তারা স্থানীয় সরকার প্রশ্নে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আজ্ঞাবহ কি না, সেই প্রশ্ন অপ্রিয় কিন্তু অবান্তর নয়। কারণ, সংকীর্ণ রাজনৈতিক কারণে ৪০০ বছরের ঢাকা আমরা চার মিনিটে ভাগ হতে দেখেছি। এখন সেই ঢাকার নির্বাচন প্রশ্নে আমরা একই রাজনীতি ঘূর্ণমান দেখছি। রাজধানী ঢাকায় নতুন ওয়ার্ড সৃষ্টি করা এবং তাতে নির্বাচন দেওয়ার যে উদ্যোগ নেওয়া হলো, তাতে এই নির্বাচন নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।

আমরা রাজধানীতে জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে এমন একটি জেরিমেন্ডারিংয়ের ধারা (রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নির্বাচনী এলাকা রদবদল করা) চালু করে দিয়েছি, তা থেকে অদূর ভবিষ্যতে বের হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখি না। ঢাকা সিটি করপোরেশন হওয়ার পর ১৯৯৪ সালের প্রথম নির্বাচনে যখন আওয়ামী লীগের নেতা মোহাম্মদ হানিফকে জয়ী হতে দেখেছিলাম, তখন বিএনপির আমল। লালবাগে ব্রাশফায়ারে ছয়জনের লাশ পড়েছিল। এরপর ২০০১ সালের অক্টোবরের সাধারণ নির্বাচনে ভোটে জিতে বিএনপি সংখ্যালঘু দলনসহ বিরোধী দলকে দৌড়ের ওপর রেখে নভেম্বরেই তারা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিকে নজর দিয়েছিল।

এর আগে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে ১৯৯৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা, খুলনা ও রাজশাহীতে তারা সিটি করপোরেশন নির্বাচন করার উদ্যোগ নিয়েছিল। এর প্রমাণ হলো, তারা ওই তারিখে তিনটি পৃথক প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে ঢাকার ৯০টি ওয়ার্ডকে ১০০, খুলনার ৩১টি ওয়ার্ডকে ৩৭টি এবং রাজশাহীর ৩০টি ওয়ার্ডকে ৩৫ টিতে উন্নীত করেছিল। কিন্তু রূঢ় বাস্তবতা হলো, আওয়ামী লীগ ঢাকায় মেয়র নির্বাচনটি ইচ্ছা করে এড়িয়ে গেছে। সে কারণে পাঁচ বছরের নির্বাচিত মেয়র হানিফ প্রায় আট বছর থাকলেন।

আবার মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন যখন মেয়র হলেন, তখন আওয়ামী লীগ তা বয়কট করেছিল। সাদেক হোসেন ১৩ বছর মেয়র থাকলেন। এরপর ঢাকা ভাগ। ২০১৫ সালের দুই ঢাকার নির্বাচনে বিএনপির আধা বয়কট নির্বাচনের দিন অপরাহ্ণে পুরো বয়কটে রূপ নিয়েছিল। সুতরাং, ২০২০ সাল আসার দুই বছর আগে তাদের এই পরীক্ষার মুখে পড়তে হবে, তা তাদের হিসাবের বাইরে ছিল।

এসব থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, ঢাকায় বড় কোনো নির্বাচন দেওয়ার বিষয়টির সঙ্গে রাজনীতির লাভ-লোকসানের একটি দীর্ঘ পরম্পরা রয়েছে। সুতরাং, বিষয়টি এতটা সরল নয় যে, শুধু আসন্ন সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ এত বড় ঝুঁকি নেবে। এ নিয়ে যে সংশয় আছে, সেটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। নির্বাচনী বছরে আওয়ামী লীগ ঢাকায় রংপুরের মতো একটি ঘটনার পুনরাবৃত্তি কেবল ‘আইনের শাসনের’ শর্ত পূরণে হতে দেবে, এমন ধারণায় অনেকেরই সংশয় থাকতে পারে। কিন্তু আমরা এই নিবন্ধে লক্ষ করব, নির্বাচন কমিশন বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মীমাংসা না করে কেন তফসিল ঘোষণা করে দিয়েছে? এটা নেহাত আইনের শর্ত পূরণ কি না? কিংবা বুঝেও না বোঝার ভান করার দায়ে তাদের দোষী করা যাবে কি না?

নির্বাচন কমিশনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। অথচ ঢাকা উত্তরের নতুন ১৮টি ওয়ার্ড এবং দক্ষিণের ১৮টি ওয়ার্ডের ভোটার ও প্রার্থীরা এখন সন্দেহমুক্ত নন যে তাঁরা প্রায় আড়াই বছরের মেয়াদে প্রতিনিধি নির্বাচন করতে যাচ্ছেন কি না? এটা প্রচলিত আইন সমর্থন করে কি না? আড়াই বছরের মেয়াদে মেয়র নির্বাচনও বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম উদাহরণ হবে। ঢাকা উত্তরের জনপ্রিয় প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক, যাঁর ভালো কাজের জন্য আমরা তাঁর নির্বাচনপ্রক্রিয়ার শুদ্ধতার প্রশ্ন বিস্মৃত হয়েছিলাম, যিনি কর্মগুণে প্রমাণ রেখে গেছেন, সব সময় বৈধতা কেবল কাগুজে আইন দ্বারা হয় না, সেখানে আমরা তাই তাঁর কাজ ও ব্যক্তিত্বকে বড় করে দেখেছি, সেখানে তাঁর মৃত্যুজনিত শূন্যপদে নির্বাচন নিশ্চয়ই আইনের শর্ত পূরণ করবে। কিন্তু সেখানে ১৮টি নতুন ওয়ার্ডের ভোটারদের পাঁচ বছরের পরিবর্তে আড়াই বছর মেয়াদে কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর নির্বাচন করার দরকার কী? এটা অপরিহার্য বিকল্প কি না?

আমরা এ বিষয়ে গতকাল নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করি। তিনি জানালেন, তফসিলে স্পষ্ট করা হয়েছে যে তাঁরা আড়াই বছরের মেয়াদে নির্বাচিত হবেন। বললাম, এ নিয়ে যে আইনি জটিলতা হতে পারে, সে বিষয়ে আপনারা সচেতন কি না? তাঁর উত্তর: ‘আমরা এ বিষয়ে সম্ভাব্য কোনো জটিলতা এড়াতে স্থানীয় সরকারকে অবহিত করেছি।’ কিন্তু কবে সেই চিঠি তাদের দেওয়া হয়েছে এবং তারা কী উত্তর দিয়েছে, তা তিনি তাৎক্ষণিক নিশ্চিত করতে পারেননি। বললাম, আপনারা এই নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কেন সংলাপ করেননি। আমাদের যুক্তি হলো, অংশীজনদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সংলাপ করার দরকার ছিল। আর যখন দলীয় ভিত্তিতে মেয়র পদে লড়াই হবে, তখন বিএনপির সঙ্গে সংলাপ হতে পারত। উত্তর ও দক্ষিণের ৩৬টি ওয়ার্ডের ভোটার ও প্রার্থীরা আড়াই বছরের জন্য হতে চান কি না কিংবা অন্য কোনো বিকল্প ছিল কি না, সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশন কী প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা পরিষ্কার নয়। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন কোনো স্বচ্ছ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে আগ্রহী ছিল, এর কোনো প্রমাণ আমরা এখনো পাই না।

আমরা জানতে পারি, ঢাকার ওয়ার্ডগুলো জনসংখ্যা ও এলাকার আয়তনের অনুপাতে সুষ্ঠুভাবে বিন্যাস এখনো হয়নি। অথচ শামসুল হুদার নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের পেশাদার ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা এ বিষয়ক একটি সংস্কারের কথা গুরুত্বের সঙ্গে চিন্তাভাবনা করেছিলেন। তাঁরা দেখেছিলেন, পুরান ঢাকায় কোনো ওয়ার্ড যখন ১০ থেকে ১২ হাজার লোক নিয়ে আছে, তখন মিরপুরে একটি ওয়ার্ড ১ লাখ লোক নিয়ে আছে। তখন মোট ওয়ার্ডসংখ্যা ৯০ রেখেই ৪২টি ওয়ার্ডে ব্যাপক পরিবর্তন এনে একটি খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছিল। কোতোয়ালির ১০টি ওয়ার্ডকে ৬ টি, সূত্রাপুরের ৬ টিকে ১০ টিতে পরিণত করার মতো একটি পেশাদারি পুনর্বিন্যাসের অনুশীলন কেন ফাইলচাপা পড়ল, তার কোনো সদুত্তর নেই। গত এক দশকে বাছাই কমিটির মাধ্যমে আমরা অনেক মাতামাতি করে দুটি নির্বাচন কমিশন পেয়েছি, কিন্তু তাদের কারও অ্যাজেন্ডায় এই লোকসংখ্যা ও আয়তনের অনুপাতে প্রতিনিধি নির্বাচনের মৌলিক কাজটি অন্তর্ভুক্ত হয়নি।

আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি উত্তরের মেয়র উপনির্বাচনে ভোট। এই দিন দুই সিটির প্রশাসনিক এলাকায় নতুন যুক্ত হওয়া উত্তরের ১৮টি ও দক্ষিণের ১৮টি ওয়ার্ডে ভোট হবে। সম্ভাব্য চিত্রটি এ রকম: উত্তরে উপনির্বাচন হবে। উত্তরে এখন যে ৩৬টি ওয়ার্ড রয়েছে, তার ভোটাররা শুধু মেয়রকে আর বাকি নতুন ১৮টি ওয়ার্ডের মানুষ মেয়রসহ কাউন্সিলরদের ভোট দেবেন। এর মধ্যে উপনির্বাচনটিই শুদ্ধতম। কারণ, মেয়রের শূন্যপদে ভোট হবে। কিন্তু বাকি ১৮ টিতে নির্বাচন আইনি প্রশ্নমুক্ত নয়। আবার দক্ষিণের বিদ্যমান ৫৭ ওয়ার্ডে কোনো ভোট নেই, শুধু নতুন ১৮ টিতে ভোটাররা কাউন্সিলর নির্বাচন করবেন।

অতীতে এমন নজির বিরল নয় যে সরকার যখন নির্বাচন করতে চায়নি, আবার ভোট না করার বদনামও নিতে চায়নি, তখন তারা এমনভাবে পরিস্থিতিকে ঠেলে দিয়েছে, যাতে আইনি চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়। আমরা অবশ্যই ঢাকার স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে অধিকতর কার্যকর ও প্রতিনিধিত্বশীল দেখতে চাই। যদি আড়াই বছরের বিষয়টি কোনো জটিলতা তৈরি না করে, যদি নির্বাচনকে আটকে না দেয়, তাহলে আমরা মনে করি, ঘোষিত তফসিলে নির্বাচন হলে ক্ষতি নেই। কেউ বলছেন, দক্ষিণের ১৮টি ওয়ার্ডের মানুষের নির্বাচিত কাউন্সিলর থাকবেন, কিন্তু নির্বাচিত মেয়র থাকবেন না।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার গত মঙ্গলবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে যা বলেছেন, তা সংবিধান বা নৈতিকতা-কোনোটিই সমর্থন করে না। তাঁর কথায়, ইসির কাজ নির্বাচন করা। তার মানে তিনি নিজেই নিজেকে ‘পোস্টবক্স’ দাবি করছেন। বলছেন, নির্বাচনের পরে ‘হয়তো’ স্থানীয় সরকার বিভাগ মেয়াদ নির্ধারণ করবে। আর মামলা হলে ইসির কিছু করার নেই। আমরা মনে করি, ১৮ জানুয়ারি মনোনয়নপত্র জমাদানের আগেই মেয়াদের বিষয়টি স্পষ্ট করা উচিত। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন নির্বাচন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, অবশিষ্ট মেয়াদের জন্য নতুন ৩৬ ওয়ার্ডে প্রশাসক নিয়োগ করা যায়। এই ৩৬ টিতে কোনো ভোট হবে না, এবার শুধুই মেয়র পদে উপনির্বাচন হবে। মেয়র মারা না গেলে সরকার ওই ৩৬ টিতে অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য নির্বাচন দিতও না।

২০০২ সালে ঢাকার মেয়র নির্বাচনের আগে অনুরূপ একটি প্রশ্ন উঠেছিল। কারণ, আওয়ামী লীগ ১৯৯৮ সালে ঢাকা, খুলনা ও রাজশাহীর ওয়ার্ডসংখ্যা বাড়ালেও তাতে নির্বাচন করেনি। ২০০১-এর নির্বাচনী জয়ের পর ঢাকাকে নিজেদের আরও নিয়ন্ত্রণে রাখতে ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনটি বিএনপির জন্য জরুরি হয়ে পড়েছিল। মওদুদ আহমদ তখন আইনমন্ত্রী। তিনি দেখলেন, নবগঠিত ওয়ার্ড নিয়ে হাইকোর্টে একাধিক রিট বিচারাধীন। তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এম এ সাঈদের সম্মতিতে মওদুদ এর একটি অভিনব সুরাহা দিলেন। ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনের এক মাস না পেরোতেই একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হলো। ২৫ নভেম্বর, ২০০১-এর ওই প্রজ্ঞাপনের (পৌর/১ /এন/৩ /৯৮/১৪৮৯, ১৪৯১ ও ১৪৯৩) মাধ্যমে সম্ভাব্য আইনি জটিলতা এড়ানো হয়েছিল। তাতে বলা হলো, ১৯৯৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বরের প্রজ্ঞাপনে যেভাবে তিনটি সিটিতে নতুন ওয়ার্ড সৃষ্টি করা হয়েছিল, সেই প্রজ্ঞাপন এখন এমনভাবে বাতিল করা হলো, যেন সেগুলো কখনো জারি করা হয়নি। ওই প্রজ্ঞাপন ১২ মার্চ ২০০২ তারিখে তফসিল ঘোষণার আগেই জারি করা হয়েছিল।

প্রশ্নের জবাবে মাহবুব তালুকদার বললেন, ওই প্রজ্ঞাপনের কথা তাঁর জানা নেই। তিনি বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন বলে জানান। বালাই ষাট, আইনি জটিলতায় আসন্ন নির্বাচন আটকে গেলে ইসিকে দায়িত্বহীনতার একটা দায় নিতে হবে বলেই প্রতীয়মান হয়।

মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
[email protected]