সৃষ্টিশীল বেগম মমতাজ হোসেন

বেগম মমতাজ হোসেন
বেগম মমতাজ হোসেন

বেগম মমতাজ হোসেন একটি নাম, একটি অধ্যায়। তিনি তাঁর মেধা, প্রজ্ঞা ও সৃষ্টিশীলতা নিবেদন করে গেছেন একটি আলোকিত সমাজ গড়ার জন্য। এই সৃষ্টিশীল মানুষটিকে আমরা কখনো ভুলে যেতে পারি না। ষাটের দশক থেকে শিল্পসাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতি অঙ্গনে তিনি একজন পুরোধা হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তা অব্যাহত রাখেন। শুনেছি, শেষের দিকে নিজে লিখতে না পারলেও অন্যের সহযোগিতা নিয়ে লেখার কাজটি সম্পন্ন করতেন। অসুস্থতা, একাকিত্ব তাঁর মনোবল এতটুকু নষ্ট করতে পারেনি।

একজন সফল শিক্ষাবিদ, একজন জননন্দিত নাট্যকার হিসেবে অত্যন্ত সমাদৃত মানুষটি চলে গেলেন নীরবে, নিভৃতে গত ২৮ ডিসেম্বর রাতে। এটা খুবই দুঃখজনক যে এমন একজন মানুষের মৃত্যুর খবরটি গণমাধ্যমে গুরুত্বসহকারে প্রকাশ পেল না। একমাত্র প্রতিভাবান সন্তান চলচ্চিত্রকার ও চিত্রশিল্পী খালিদ মাহমুদ মিঠুর মর্মান্তিক মৃত্যুর শোক তিনি যেন আর বইতে পারছিলেন না। তাই এক বুক কষ্ট ও অভিমান নিয়ে তিনি চলে গেলেন অলক্ষ্যে।

বেগম মমতাজ শিক্ষাজীবন শেষে একটি আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক প্রণোদনামূলক এবং সময়োপযোগী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকে তাঁর দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছিলেন। ঢাকার একমাত্র প্রিপারেটরি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের সঙ্গে ১৯৬০ সালে তিনি যুক্ত হন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্কুলটিকেই বাংলা মাধ্যম করে তিনি এর নামকরণ করেন উদয়ন বিদ্যালয়। সেই থেকে প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষয়িত্রী হিসেবে দীর্ঘ নিরলস প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে একটি আদর্শ আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে একে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়ে দেন। এই বিদ্যালয়ে অনেক অালোকিত তরুণ-তরুণী পড়ালেখা করেছেন, যাঁরা পরবর্তী সময়ে সমাজ, সংস্কৃতি ও শিক্ষাক্ষেত্রে অবদান রেখে বিশিষ্ট হয়েছেন। তিনি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে থাকাকালে বর্তমানের অগ্রণী বিদ্যালয়ের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। জানা গেছে, এই বিদ্যালয়ের অগ্রণী নামটি তাঁরই দেওয়া।

এই সফল শিক্ষাবিদ কচিকণ্ঠ ও আরব মিশন স্কুল এবং অসহায়, সুযোগবঞ্চিত নারী ও শিশুদের জন্য প্রতিষ্ঠিত বোস্টন ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের সঙ্গে যুক্ত থেকে তাদের জন্য উন্নয়নমূলক নানা পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। প্রথা ভেঙে এগিয়ে যেতে যে সাহস ও মেধার পরিচয় তিনি দিয়েছেন, তা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তাঁর প্রগাঢ় উপলব্ধিসম্পন্ন জীবনবোধ এবং চ্যালেঞ্জ গ্রহণের অসাধারণ মানসিকতাই তাঁকে বিভিন্ন সময়ে সমৃদ্ধ করেছে।

সত্তরের দশকে তিনি হয়ে ওঠেন দর্শকনন্দিত এক নাট্যকার। বাংলাদেশ টেলিভিশনে তাঁর রচিত জনপ্রিয় ধারাবাহিক ও সাপ্তাহিক নাটক দেখে দর্শকেরা শুধু মুগ্ধই হতেন না, একধরনের ভালো লাগা ও আগ্রহ তৈরি হতো তাঁদের মধ্যে। ফলে প্রতিদিনই আগেভাগে কাজ শেষ করে টিভির সামনে বসাটা তখন রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। একে একে প্রচারিত হতে থাকে তাঁর ৫৮ পর্বের ধারাবাহিক নাটক সকাল-সন্ধ্যা, ২৬ পর্বের নাটক শুকতারা, যেখানে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের শুকতারার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। শিল্পী ও কলাকুশলীদের নিয়ে একটি পারিবারিক আবহ তৈরি করতে পেরেছিলেন। তাই তাঁর নাটকগুলো অনবদ্য হয়ে উঠেছিল। এর মধ্যে ১৬ পর্বের ধারাবাহিক বড়বাড়ি, বেলা অবেলাসহ জনপ্রিয় সাপ্তাহিক নাটক অতন্দ্রপ্রহরী ও বকুল ঝরা দিন। এই নাটকগুলোর মধ্যে তাঁর নান্দনিক শিল্পীসত্তার প্রকাশ ঘটে।

রেডিওতে প্রচারিত তাঁর নাটকের সংখ্যাও কম নয়। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে দর্শকনন্দিত বেশ কিছু নাটকের মধ্যে সাড়ে তিন বছর চলা রোজ রোজ নাটকের কথা। এ ছাড়া দুই জোনাকি, আপনজন, কাঠবিড়ালি ও লিচু চোর নাটকের নাম উল্লেখ করা যায়। যাঁরা তাঁর নাটকে অভিনয় করেছেন এবং দারুণ জনপ্রিয় ছিলেন, তাঁদের মধ্যে ডলি আনোয়ার, আফরোজা বানু, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, রওশন জামিল, তারানা হালিম, অপি করিমের নাম সহজেই মনে আসে। জেনেছি, শুধু নাটক লেখা আর চিত্রনাট্য করাই নয়, তিনি রিহার্সেলে উপস্থিত থাকা, সেট নির্মাণ, লোকেশন এবং প্রতিভাবান শিল্পী খুঁজে বের করার ব্যাপারে অত্যন্ত সহযোগিতা করতেন। একটা সময় এই অভিনয়শিল্পীরা তাঁর কাছের মানুষ এবং আপনজন হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর নাটকের সংলাপ সহজ এবং কাহিনির চরিত্র খুব চেনা হওয়ায় সবার কাছে খুব গ্রহণযোগ্য হয়েছিল।

শিশুদের জন্য শুধু নাটক রচনা বা তৈরি করাই নয়, বঙ্গবন্ধুর জীবনী অবলম্বনে সোনাভাই নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। পঞ্চাশের দশক থেকে বেগম মমতাজের লেখালেখি শুরু হয়। এই চর্চার মধ্য দিয়ে তিনি অনুভব করেন দেশের শিশুসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করার তাগিদ। সেই চিন্তা এবং অনুভব থেকেই পরবর্তী সময়ে তিনি গড়ে তোলেন ‘শিশুনাট্যম’ নাট্যগোষ্ঠী।

শিশুদের এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি ক্রমেই এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন। উদার, দেশপ্রেমিক মন তার চারপাশকে প্রাণবন্ত করে তুলতে পেরেছিল বলেই মানুষের সঙ্গে তাঁর সব দূরত্ব ঘুচিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অনন্য এবং অসাধারণ এক মানুষ। দেশ ও মানুষকে ভালোবাসার এই তীব্র অনুভবই তাঁকে পরবর্তী সময়ে একজন মানবিক সৃষ্টিশীল লেখক হিসেবে তৈরি করে। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৮। বড়দের জন্য নাটক লিখেছেন পাঁচটি। এর মধ্যে স্বপ্নের বন্ধু এবং রংধনুর রং নামের দুটি গ্রন্থ অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার পাওয়ার গৌরব অর্জন করে। তাঁর প্রতিটি বই সুখপাঠ্য। পত্রপত্রিকায়ও লিখেছেন তিনি।

তিনি বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্যাপ্টেন দেলোয়ারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কাজ করেছেন। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা, ওষুধ, খাদ্য সংগ্রহ, আশ্রয় দেওয়াসহ বহু ধরনের কাজে তিনি অংশ নিয়েছেন। তিনি বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য ছিলেন। এ ছাড়া মূক ও বধির কল্যাণ সমিতি, বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতি, বাংলাদেশ মহিলা সমিতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ঘুরেছেন নরওয়ে, সুইডেন, যুক্তরাজ্য, ফিলিপাইন, জাপান, কেনিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশ।

শিক্ষা ও সমাজকল্যাণে অবদান রাখার জন্য ২০০৯ সালে তিনি ‘বেগম রোকেয়া’ পদক পেয়েছেন। জীবনসংগ্রামে প্রতিনিয়ত নির্ভীক যোদ্ধা হিসেবে সব প্রতিকূলতাকে প্রতিহত করে এগিয়ে গেছেন তিনি। জীবনে হারিয়েছেন অনেক, কিন্তু নিজেকে হারাননি কখনো। তাঁর সারা জীবনের কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে এই সত্যে উপনীত হওয়া সহজ হয়, কাজের মধ্যে সংহতি সৃষ্টি করে এমন কিছু সৃষ্টি করেছেন, যাতে রয়েছে সত্যের আলো। এখানেই তিনি সার্থক, তিনি বেঁচে থাকবেন এ দেশের মানুষের মনে।

দিল মনোয়ারা মনু: সাংবাদিক।