এই কিশোরীরা কোথায় গেল?

সাতটি কিশোরী বেমালুম গায়েব হয়ে গেল সেফ হোম থেকে। যদিও বলা হচ্ছে তারা পালিয়েছে, কিন্তু উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত তো নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই তারা স্বেচ্ছায় গেছে, নাকি অন্য কোনো ধরনের ঘটনার শিকার।

চট্টগ্রামের হাটহাজারীর ফরহাদাবাদ এলাকায় অবস্থিত মহিলা ও শিশু-কিশোরী হেফাজতিদের নিরাপদ আবাসনে (সেফ হোম) থাকত এই মেয়েরা। এর পরিচালনার ভার সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তরের। ১০ জানুয়ারি ভোরে সাতটি কিশোরী, যাদের বয়স ১২ থেকে ১৭-এর মধ্যে, নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। এ ঘটনা ‘নিরাপদ’ আশ্রয়কেন্দ্রের নিরাপত্তাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। এমনকি নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মীদেরও এতে যোগসাজশ আছে কি না, সেই প্রশ্নও উঠছে এখন।

বলা দরকার, সেফ হোমে থাকা মেয়েরা কেউ আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়ে এখানে আশ্রয় নেয়নি। বরং নিজেরাই ভুক্তভোগী (ভিকটিম)। এদের কেউ প্রতারণা, কেউ নির্যাতন, এমনকি ধর্ষণের শিকার হয়ে আদালতে এসেছিল। আত্মীয়স্বজন ও পরিবারের কেউ তাদের দায়িত্ব নিতে সম্মত হয়নি কিংবা নিজেরাই পুরোনো ঠিকানায় ফিরে যেতে ভরসা পায়নি। কোনো জিম্মাদার না পেয়ে আদালত তাদের আশ্রয় ও নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব দিয়েছিলেন সরকারকে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের সেফ হোমে ঠাঁই হয়েছিল তাদের। এখন তাদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থতার জন্য আদালতে জবাবদিহি করার দায় কার?

প্রথমেই সেফ হোমের অবস্থান ও নিরাপত্তাব্যবস্থা সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক। চট্টগ্রাম শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে হাটহাজারী উপজেলায় ফরহাদাবাদে সেফ হোমটি অবস্থিত। দেড় একর জায়গার ওপর ২০০৩ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সেফ হোমের নিরাপত্তার দায়িত্বে আছেন পুলিশের একজন সহকারী উপপরিদর্শকের (এএসআই) নেতৃত্বে ছয়জন পুলিশ ও চারজন আনসার সদস্য। তিন পালায় আনসার সদস্যরা সেফ হোমের ভেতরে এবং পুলিশ সদস্যরা ফটকে পাহারায় থাকেন। আপাতদৃষ্টিতে নিরাপত্তাব্যবস্থার তেমন কমতি আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু আটটি সিসি ক্যামেরার মধ্যে চারটি নষ্ট থাকার মতো নিরাপত্তাব্যবস্থার আরও দু-একটা ত্রুটিকে আমলে না নিয়ে কর্তৃপক্ষ নিঃসন্দেহে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে। তা ছাড়া, সেফ হোমের সীমানাদেয়াল মাত্র পাঁচ ফুট উঁচু। দেয়ালের ওপর কাঁটাতারের ঘেরা না থাকায় এখানে ঢোকা ও বেরিয়ে যাওয়া অনেক সহজ। নিরাপত্তার স্বার্থে এই দিকগুলো বিবেচনায় নেওয়া উচিত ছিল।

ঘটনার পর যথারীতি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। কমিটি নিরাপত্তাকর্মীদের দায়িত্বে অবহেলার কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে। সেফ হোমের ভেতরে যে দুজন আনসার সদস্য কর্মরত ছিলেন, তাঁদের একজনের রাত ১০টা থেকে ২টা পর্যন্ত দায়িত্ব পালনের কথা, কিন্তু তিনি এর আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। অন্যজন রাত ২টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত প্রহরায় থাকার কথা থাকলেও তিনি ভোর ৬টা ৫২ মিনিটে এসে মাত্র দুই মিনিট থেকে কর্মক্ষেত্র থেকে চলে যান। হোমের দুই নারী কর্মীও দায়িত্ব পালন না করে ঘুমিয়ে ছিলেন। এ ছাড়া সেফ হোমে পুলিশ ক্যাম্প থাকলেও অজ্ঞাত কারণে পুলিশ সদস্যরা ওই দিন টহলে ছিলেন না বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এই যদি হয় নিরাপত্তাব্যবস্থা, তাহলে তো মনে হয় এ রকম একটি অঘটন ছিল অনিবার্য।

মোট ৫৬ জন কিশোরী থাকত সেফ হোমে। ১০ জানুয়ারি ভোররাতে ৮ জন কিশোরী পুরোনো রান্নাঘরের পেছনের জানালা ভেঙে বেরিয়ে যায়। পরদিন সকাল সাতটার দিকে এদের একজনকে আটক করা হয় সেফ হোমের অদূরে একটি এলাকা থেকে। জিজ্ঞাসাবাদে মেয়েটি জানিয়েছে, সে ছাড়া বাকি সাতটি মেয়ে একই কক্ষে থাকত। তারা সেফ হোম থেকে পালিয়ে গিয়ে চাকরিবাকরি জুটিয়ে নিয়ে অন্য কোথাও একসঙ্গে থাকবে বলে পরিকল্পনা করছিল বেশ কয়েক দিন ধরে। তবে আটক মেয়েটির কথা কতটা সত্য, তা নিশ্চিত হতে পারেনি তদন্ত কমিটি। কেননা, মেয়েটি মানসিক ভারসাম্যহীন। তা ছাড়া, সে সম্ভবত মূল পরিকল্পনার সঙ্গে ছিল না। অন্যদের দেখাদেখি বেরিয়ে পড়েছে উদ্দেশ্যহীনভাবে।

‘পালিয়ে’ যাওয়া সাত কিশোরীকে নিয়ে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, তারা নারী ও শিশু পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ল কি না। সেফ হোম এলাকা থেকে রামগড়ের দিকে চলে যাওয়া এবং দালাল চক্রের সহযোগিতায় সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে প্রবেশ করার সুযোগ আছে বলেই শঙ্কা ও উদ্বেগ ঘনীভূত হচ্ছে আরও। নিরাপত্তাকর্মী ও হোমের অন্যান্য কর্মীর দায়িত্বে অবহেলা ও নিষ্ক্রিয়তা থেকে তাঁদেরই যোগসাজশে কোনো ‘পরিকল্পনা’ বাস্তবায়িত হয়েছে কি না, এ প্রশ্নটি সামনে আসছে। দায়িত্বে অবহেলার জন্য দুজন আনসার সদস্য ও দুজন আয়ার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। আমরা চাই, তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় এনে বিষয়টি খোলাসা করা হোক।

এবার ঘটনার অন্য একটি দিক নিয়ে আলোচনা করতে চাই। সাতটি কিশোরী নিজেরাই সেফ হোম থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। তাদের যে কেউ জোর করে তুলে নিয়ে যায়নি তার প্রমাণ, তারা সঙ্গে করে তাদের কাপড়-চোপড়সহ অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে গেছে। নারী ও শিশু পাচারকারী চক্রের ফাঁদে যদি তারা পড়েও থাকে, তাহলে ভালো থাকা-খাওয়া ও ভালো চাকরি পাইয়ে দেওয়ার টোপ তাদের গেলানো হয়েছে। কথা হচ্ছে, নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র থেকে চলে যাওয়ার ঝুঁকি তারা নিল কেন? তারা কি যথেষ্ট নিরাপদ ছিল না? তাদের জীবনযাপন কি সাধারণ আর দশজনের মতো স্বস্তিকর ছিল না? তারা কি কয়েদি বা বন্দীদের মতো জীবনযাপন করছিল সেফ হোমে?

আগেই বলেছি, এই কিশোরীরা কেউই অপরাধী হিসেবে আসেনি সেফ হোমে। ভাগ্যবিড়ম্বিত জীবনই তাদের এখানে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে। সুতরাং শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরের একটি প্রায় নির্জন ভবনে ‘বন্দিজীবন’ তাদের কাছে বসবাসযোগ্য মনে হবে কি না, তা-ও ভেবে দেখা দরকার।

এ প্রসঙ্গে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আহমেদ হেলাল বলেন, প্রথমে দেখতে হবে সেফ হোমটিতে পারিবারিক আবহ ছিল কি না। যেমন এসওএস শিশুপল্লির মতো মানসম্পন্ন আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে কয়েকটি শিশুর জন্য একজন তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করা হয়, এই শিশুরা তাঁকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করে। এ রকম স্নেহ-প্রীতিময় পরিবেশ খুবই দরকার। দ্বিতীয়ত, সেফ হোমে আশ্রয় নেওয়া বিপর্যস্ত কিশোরীদের মানসিক পরিচর্যা ছাড়াও জীবনের একটি লক্ষ্য বা স্বপ্ন তৈরি করে দেওয়া দরকার ছিল, যাতে ভবিষ্যতে তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। তৃতীয়ত, অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের মতো মৌলিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি তাদের অবসর সময়টাতে কোনো আনন্দ-বিনোদনের ব্যবস্থা আছে কি না, তা-ও দেখতে হবে।

আহমেদ হেলাল খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন তুলেছেন, নিরাপত্তা হেফাজতে আসা মেয়েগুলোর জীবন কি কোনোভাবে পুনরায় নিরাপত্তাহীন হয়ে উঠেছিল? তাদের জন্য সেফ হোমের পরিবেশ বিরূপ ও প্রতিকূল হয়ে উঠেছিল কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার বলেও মত প্রকাশ করেন তিনি।

সাতটি কিশোরী আর কখনো ফিরে আসবে কি না, কিংবা পুলিশ তাদের আদৌ উদ্ধার করতে পারবে কি না, জানি না। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট নিয়ে কয়েক দিন মাতামাতির পর হয়তো ঢাকা পড়ে যাবে সবকিছু। জনসংখ্যাবহুল একটি দেশের অজ্ঞাতকুলশীল সাতটি মেয়ের ভবিষ্যৎ কোন অন্ধকারে হারিয়ে গেল, তার খোঁজ রাখার সময়-সুযোগও হয়তো থাকবে না আমাদের। তবে এ ঘটনার অভিজ্ঞতা থেকে কর্তৃপক্ষ যদি কিছুটা শিক্ষা লাভ করে, সেফ হোমে আশ্রিত যে মেয়েরা এখন আছে, তাদের জীবনমানের যদি কিছুটা উন্নতি হয়, সেটাই হবে একমাত্র সান্ত্বনা।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]