খুন করা এতই সোজা!

আদনান ইসফার
আদনান ইসফার

পথচারীতে সরব ব্যস্ত সড়ক। রোদেলা দুপুরে জীবনের টাটকা ঘ্রাণ। এরই মধ্যে প্রাণ নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে এক কিশোর। পেছনে পিস্তল আর ছোরা হাতে তাড়া করেছে যমদূত। সংখ্যায় ওরা চার-পাঁচজন। এই তরতাজা কিশোরের উষ্ণ রক্ত না হলে তাদের পিপাসা মিটবে না। কিশোরটি তখন দিব্যি দেখছে তার কম্পমান প্রাণপাখিকে। এখনই যেন উড়াল দেবে পাখি! বাঁচার তাগিদে চিৎকার জুড়ে দিল কিশোর—কে আছো, বাঁচাও! চারদিকে এত মানুষ। কেউ শুনল না তার কথা। কেউ এগোল না।

যমদূতেরা সবার সামনে চড়াও হলো কিশোরের ওপর। তার রক্তে তৃষ্ণা মিটিয়ে তবেই ক্ষান্ত দিল। কোলাহলমুখর সভ্য নগরের বুকে বর্বরতা গভীর চিহ্ন এঁকে দিল কিশোরের শরীরে। নির্জীব হয়ে গেল ছেলেটি।

মা-বাবার একমাত্র ছেলে এই কিশোরের নাম আদনান ইসফার। বাসা থেকে মাত্র ৩০০ গজ দূরে তাকে খুন করা হয়। চট্টগ্রাম নগরের জামালখান মোড়ে অনেক প্রত্যক্ষদর্শীর সামনে এ ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিল আদনান। নবম শ্রেণিতে পড়ত। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেটে জিপিএ-৫ পেয়েছে সে। বাবা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের পদস্থ প্রকৌশলী। মা-বাবা স্বপ্ন দেখতেন, ছেলে বাবার মতোই প্রকৌশলী হবে। সে স্বপ্ন আজ মরীচিকা। চেনাজানা সবাই বলছেন, কারও সঙ্গে আদনানের পরিবারের কোনো রকম বিরোধ নেই। আদনানের সঙ্গে যে কারও কোনো ঝামেলা হয়েছে, এর কোনো আভাস কেউ পায়নি। তাহলে কারা খুন করল আদনানকে?

পুলিশ বলছে, ফুটবল ও ক্রিকেট খেলা নিয়ে বিরোধের জেরে এই খুন হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে পাঁচ যুবককে তারা শনাক্ত করেছে। তা যদি হয়ে থাকে, সেটা তো আরও মর্মান্তিক। ঘটনাটি আসলে মর্মান্তিকের চেয়ে বেশি। এ বুকফাটা যন্ত্রণার কথা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আদনানের মা-বাবা আর একমাত্র বোনটির কলজে চিরে যে দুভাগ হয়েছে, এ চেরা দাগ কখনো মুছবে না। কখনো ঘুচবে না এই গুমরে মরা কষ্ট। ধু ধু মাঠের বাউলা বাতাসের মতো বুকচাপা হাহাকার বয়ে যাবে নিরন্তর। মায়ের স্মৃতিপটে ক্ষণে ক্ষণে ভাসবে ছেলের নানা আবদারের টুকরো দৃশ্য। নীরব রোদনে ভাসবে বুক। অসহায় বাবার স্নেহমাখা হাত হাতড়ে বেড়াবে ছেলেকে নিয়ে সুখ–দুঃখের নানা স্মৃতি। বোনটি চুপি চুপি ভাইয়ের রেখে যাওয়া পোশাক আর জিনিসগুলোতে খুঁজবে তার স্পর্শ। নিভৃত কোটরে কেঁদে আকুল হবে তার দুঃখী মন। কেউ জানবে না, বুঝবে না সেই কষ্টের কথা।

মা-বাবার কল্পনাপটে যখন দাঁড়াবে সেই দৃশ্যপট—তাঁদের অতি আদরের ধন, কলিজার টুকরা ‘বাঁচাও-বাঁচাও’ বলে ছুটছে, সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে, এগিয়ে আসছে না কেউ, তখন তাঁদের বুকের ভেতর কষ্টের ঢেঁকি যে পাড়টা দেবে—এর কাছে হিমালয়ের ধসও নস্যি। সভ্য দুনিয়ায় এটা কীভাবে সম্ভব—একটা বাচ্চা ছেলে চোখের সামনে মরে যাচ্ছে, অথচ কেউ এগিয়ে আসছে না। ‘সভ্যতার প্রতি’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাধে কী আর লিখেছেন—‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর, লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর’।

এ জন্য অবশ্য আমাদের আইনি প্রক্রিয়ার শিথিলতা ও বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা অনেকাংশে দায়ী। বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগ আসামিরা গ্রেপ্তার হলে অনেকেই আদালতে খুব সহজে জামিন পেয়ে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্র সন্দেহভাজন দোষীকে গ্রেপ্তারেই অনেকটা সময় চলে যায়। আসামি ধরা পড়লে বিচারপ্রক্রিয়া চলে ঢিমতেতালায়। সেই যে নারায়ণগঞ্জে কিশোর ত্বকী খুন হলো, সেই মামলার শেষ খবর কী?

আদনান হত্যার সাড়ে তিন মাস আগে চট্টগ্রাম নগরের সদরঘাট থানার নালাপাড়ায় সুদীপ্ত বিশ্বাস নামের এক তরুণকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। সুদীপ্ত নগর ছাত্রলীগের সহসম্পাদক ছিলেন। চলে যাওয়ার সময় খুনিরা ফাঁকা গুলি ছুড়ে এলাকায় আতঙ্ক ছড়ায়। গত বছরের ৬ অক্টোবর এই হত্যাকাণ্ডে সুদীপ্তর বাবা অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক মেঘনাথ বিশ্বাস থানায় মামলা করেন। কিন্তু খুনিরা ধরা না পড়ায় হতাশ তিনি। বাবা মেঘনাথ বিশ্বাস বলেন, সিনেমার দৃশ্যের মতো গাড়িবহর নিয়ে এসে এতগুলো লোক তাঁর ছেলেকে হত্যার পর গুলি ছুড়ে পালিয়ে গেল। আর পুলিশ কিছুই করতে পারছে না।

এসব কারণে বেশির ভাগ মানুষের সহযোগিতামূলক মানসিকতায় টান ধরেছে। হাত বাড়ানোর ইচ্ছেটা মনে মনে তড়পায় ঠিকই, কিন্তু এগিয়ে আসার সাহস করে না। কেউ কেউ ভাবে, যা হওয়ার হোক, আমি তো ভালো আছি। অযথা ঝামেলায় জড়ানো কেন? এতে বরং উটকো আপদ জুটতে পারে।

কিন্তু এ ধরনের মানসিকতা যে ভয়ংকর বুমেরাং হয়ে উঠছে, তা খেয়াল করছি না কেউ। পলায়নপর মানসিকতা মানুষকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। আজ একজনের বাড়িতে ডাকাত পড়লে আপনি যাবেন না, ভালো কথা। এতে ডাকাত কিন্তু সাহস পেয়ে যাবে। দুদিন পর সে আপনার বাড়িতে ডাকাতি করবে। তখন আপনি চিৎকার করলে কেউ এগিয়ে আসবে না। কাজেই পারস্পরিক সৌহার্দ্য, মমত্ববোধ, সহমর্মিতা—এসব মানবিক গুণকে পাশ কাটিয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা আত্মহত্যার বীজ বুনে দেওয়ার মতো। সমস্যার সমাধান না করে এড়িয়ে যাওয়া মানে সমস্যাকেই জিইয়ে রাখা। ক্রমে এটার ডালপালা ছড়াবে। আর সবাই যদি অন্যের বিপদ বা সমস্যায় সম্মিলিতভাবে এগিয়ে যাই, তাহলে শুরুতে ঝড়ঝাপটা এলেও ক্ষতি নেই। এতে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত আরও মজবুত হবে। সাধারণ মানুষের সম্মিলিত শক্তির ওপর আর কোনো শক্তি নেই।

শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
[email protected]