আইভীর মানবঢালে আবারও ঠেকলেন শামীম ওসমান

গডফাদারদের বিরুদ্ধে মানবঢাল তৈরির পথ দেখাল নারায়ণগঞ্জ
গডফাদারদের বিরুদ্ধে মানবঢাল তৈরির পথ দেখাল নারায়ণগঞ্জ

মাত্র তিন দিন আগের কথা। সেলিনা হায়াৎ আইভী গর্ব করে বললেন, ‘নারায়ণগঞ্জ এখন আর সন্ত্রাসের জনপদ নয়’ (সাক্ষাৎকার, প্রথম আলো, ১৪ জানুয়ারি)। নারায়ণগঞ্জের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর শামীম ওসমান দেখলেন বিপদ। সন্ত্রাসই যদি না থাকে, তাহলে তিনি থাকেন কী করে, সন্ত্রাসের ব্র্যান্ড টেকে কী করে? আইভীর দাবিটা শামীম ওসমানের অস্তিত্বের জন্য সত্যই এক চ্যালেঞ্জ। আইভীর দাবি সত্য হলে ওসমান মিথ্যা হয়ে যান, পরাজিত হয়ে যান, না-ই হয়ে যান। বাধ্য হয়ে তাঁকে জানান দিতেই হলো যে ‘টাইগার জিন্দা হ্যায়’। আইভীর মিছিলে হামলা-গুলি হলো, জনপ্রিয় এই নেত্রীসহ পঞ্চাশাধিক মানুষ আহত হলেন। উঁচানো পিস্তল হাতে নায়ক জসীমের মতো দৃশ্যের মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে পড়লেন শামীম ওসমানের ক্যাডার বলে পরিচিত নিয়াজুল। এবং গণপিটুনিতে ফাটা বেলুনের মতো চুপসেও গেলেন।

কে এই নিয়াজুল? প্রথম আলো জানাচ্ছে, জনাব নিয়াজুল ইসলাম খান যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি এলাকায় নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের আওয়ামী লীগের সাংসদ এ কে এম শামীম ওসমানের ক্যাডার হিসেবে পরিচিত। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি এলজিইডির ঠিকাদারি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, ১৯৮৬ সালে এরশাদের সময় নাসিম ওসমান সাংসদ হলে নিয়াজুলের উত্থান হয়। ১৯৮৮ সালে সংঘটিত জোড়া খুনের মামলার আসামি তিনি। ১৯৯৬ সালে শামীম ওসমান সাংসদ নির্বাচিত হলে নিয়াজুল অস্ত্রের লাইসেন্স পান। বস্তির বখরা ছিল তাঁর অন্যতম আয়ের উৎস। বৃক্ষের পরিচয় ফলে, নেতার পরিচয় ক্যাডারের বীরত্বে।

নারায়ণগঞ্জের ফুটপাত পথচারীদের জন্য মুক্ত করায় নেমেছেন নারায়ণগঞ্জের মেয়র। হকাররা না ওঠার জন্য আন্দোলনে গেল। শামীম ওসমান দেখলেন মওকা। এর আগে তিনি কিশোর ত্বকী হত্যার বিচারপ্রার্থী পিতা রাফিউর রাব্বীর বিরুদ্ধে হেফাজতের নেতা হয়েছিলেন। এবার হলেন হকারদের নেতা। সিটি করপোরেশন তাদের জন্য বিকল্প জায়গার বন্দোবস্ত করলেও ওসমান সাহেব কোনো বিকল্প-টিকল্প মানেন না। মানবেন কীভাবে? হকারদের থেকে চাঁদা ওঠানোর অভিযোগ তো তাঁরই সমর্থকদের বিরুদ্ধে। তা ছাড়া আইভীকে বাগে পাওয়ার এই মওকা তিনি ছাড়বেন কেন?

আইনপ্রণেতা সমর্থকদের নিয়ে নিজেই নেমেছেন আইভীর সমর্থকদের ঠেকাতে
আইনপ্রণেতা সমর্থকদের নিয়ে নিজেই নেমেছেন আইভীর সমর্থকদের ঠেকাতে

অতএব, প্রথমে হুমকি তারপর হামলা। পেটমোটা নিয়াজুলের পিস্তলবাজি দিয়ে শামীম ওসমান জানিয়ে দিলেন, তিনি ‘অহনতরি বাঁইচা আছেন’। তাঁর এই থাকা ঢাকাই সিনেমার সেই রোমান্টিক গানের মতো, ‘তুমি আছ সবই আছে; তুমি নেই কিছু নেই’। তিনি নেই তো সন্ত্রাস নেই, তিনি আছেন তো নারায়ণগঞ্জের বিপদাপদ সবই আছে। অন্যদিকে, হামলা হওয়ামাত্রই জনতা আইভীকে ঘিরে মানবঢাল তৈরি করে। মুহুর্মুহু ইটবৃষ্টির মধ্যে তাঁরা শরীর দিয়ে আইভীকে আগলে রাখেন। পিস্তল-বন্দুক বনাম মানবঢাল আগামী দিনের রাজনীতির দারুণ এক ইশারা হয়ে থাকল।

শামীম ওসমান বনাম আইভী-রাব্বীদের গল্পটা চমৎকার টেরর স্টোরি হতে পারত। গডফাদার সিরিজের বাংলাদেশি সংস্করণ হতে পারত। এক বহুরূপী চরিত্রকে ঘিরে গা ছমছম করা রহস্য কাহিনি হতে পারত। নাগরিক সমাজের রাফিউর রাব্বী এবং মেয়র আইভী বনাম ওসমান পরিবারের এই গল্পটা হলিউডের ডেসপারাডো সিনেমার মতোই ছিল এত দিন। কিন্তু গতকাল মঙ্গলবারের হামলার ঘটনাটা মাফিয়া থ্রিলারকে কমেডি বানিয়ে দিল।

এই ব্যর্থতার জন্য দায়ী নিয়াজুল। তাঁর গণপিটুনি খাওয়া উচিত হয়নি। মহান নেতার তুখোড় ক্যাডারের এই পরিণতি দেখে বাংলার ক্যাডারেরা খুব শরমিন্দা হয়েছেন। নিয়াজুল ক্যাডার নামের লজ্জা, শামীম ওসমানের বোঝা। নিয়াজুল নারায়ণগঞ্জে পরিচিত মুখ। তাঁকে ঘিরে আতঙ্কের জাল ছড়ানো। এহেন পিস্তলবাহাদুরের গণপিটুনি খাওয়ার দৃশ্য বিরল। আইভীর মানবঢালের কাছে আবারও ঠেকে গেলেন শামীম ওসমান।

জনতার কাজ জনতা করেছে, কিন্তু পুলিশের কাজটা পুলিশ করবে কি? যতই লাইসেন্স থাকুক, প্রকাশ্যে জনতাকে পিস্তল উঁচিয়ে হুমকি দেওয়া তো খুনের প্রচেষ্টার! জনতা যেটা করেছে, সেটা স্পষ্টতই আত্মরক্ষা। জোড়া খুনের মামলার আসামির অস্ত্রবাজির কী প্রতিকার পুলিশ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করেন, তা দেশবাসী দেখার অপেক্ষায় থাকবেন।

আইভীর ওপর হামলা এবং তা প্রতিরোধের এই ঘটনা আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ অবস্থার মাথার চাঁইমাত্র। সব জায়গাতেই গণমুখী নেতা বনাম পদধারী গডফাদারদের দ্বন্দ্ব আছে। পাশাপাশি নিজেদের হাতে নিজেদের কর্মী খুনের ঘটনাও বাড়ছে। উপযুক্ত পরিবেশ পেলে আওয়ামী লীগের নেতারা কী আনন্দে কোন্দল করবেন, শামীম ওসমানদের মতো ব্যক্তির কার্যকলাপ তার উদাহরণ।

এদিকে আইভী রাজনৈতিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মডেল হয়ে উঠেছেন। তিনি যতটা না আওয়ামী লীগের, তারচেয়ে বেশি তাঁর ভোটারদের। দলের ও সর্বজনের পরিচয়ের কোনোটাই তিনি ছাড়ছেন না। দল থেকে যত বাধাই পান না কেন, নারায়ণগঞ্জের নাগরিক সমাজের ভরসা তিনি। নাগরিক সমাজ বনাম মাফিয়াতন্ত্রের দীর্ঘ সংগ্রাম যেভাবে পরিণত হয়েছে, তার পেছনে শহরটির সাংস্কৃতিক কর্মীদের অবদান ও আত্মদান বিপুল। অধিকার আন্দোলনের এই মডেল থেকে সবারই অনেক কিছু শেখার আছে।

জোড়াখুনের আসামি নিয়াজুলের পিস্তল উঁচিয়ে হুমকিদানের দৃশ্য
জোড়াখুনের আসামি নিয়াজুলের পিস্তল উঁচিয়ে হুমকিদানের দৃশ্য

নারায়ণগঞ্জে এখন আওয়ামী লীগ মানে শামীম ওসমান আর নেত্রী মানে মেয়র আইভী। আওয়ামী লীগ এ থেকে কী শিক্ষা নেবে? তারা কি আইভীদের দল হবে, নাকি শামীম ওসমান, ইয়াবা ব্যবসায় অভিযুক্ত বদি কিংবা নিজ শিক্ষককে পেটানো সাংসদ সাইমুম, কিংবা গুলি করে খুলি ওড়ানোর হুমকিদাতা সাবেক সাংসদ মকবুলদের দলই থাকবে? চয়েস আপনা আপনা। নারায়ণগঞ্জবাসীও কিন্তু বারবার আইভীকেই বেছে নিয়েছেন।

সরকারি দলে থেকেও যদি এমন হামলা-ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হয়, বিরোধী দলের তাহলে কী অবস্থা? তা জানতে বারবার বরখাস্ত ও আটক হওয়া মেয়রদের দিকে তাকাতে হবে। এ রকম পরিস্থিতি যাঁদের, তাঁরা আইভীর মতো মানবঢাল বানানোয় মনোযোগী হতে পারেন। তবে, বিরোধী দলগুলিতে আইভীর যোগ্যতার কেউ থাকলেও নারায়ণগঞ্জের আইভীর মতো টিকতে পারবেন কিনা সন্দেহ।

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]