'উপমন্ত্রী' আইভীর ওপর হামলা, সংসদে বিবৃতি চাই

হামলার সময় সড়কে বসে পড়েন মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী
হামলার সময় সড়কে বসে পড়েন মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী

সাত খুনের জন্য আলোচিত নারায়ণগঞ্জের রাজপথ দীর্ঘ বিরতিতে আবারও রক্তাক্ত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে জরুরি পদক্ষেপ নেবেন, সেটাই প্রত্যাশিত। অতীতে আমরা যখন নারায়ণগঞ্জ-প্রশ্নে শঙ্কিত হয়েছি, তখন তাঁর উদ্যোগের কারণেই শেষ পর্যন্ত আশ্বস্ত হয়েছি। তার প্রমাণ আওয়ামী লীগের টিকিটেই মেয়র আইভী এখন উপমন্ত্রীর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত আছেন।

তবে অতীতে কখনো এমনভাবে তিনি প্রতিহিংসার শিকার হননি, তিনি প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন, যখন তিনি উপমন্ত্রীর মর্যাদালাভের ৭০তম দিবসে রাজপথে নেমেছিলেন। তাই এই আঘাত শুধু মেয়রের ওপরে নয়, এটা মন্ত্রিসভা নয়, ‘মন্ত্রিসভার মর্যাদার’ ওপরও একটি আঘাত হিসেবে দেখার সুযোগ আছে বললে হয়তো অতিরঞ্জিত হবে না। গত ৭ নভেম্বর তিনি উপমন্ত্রীর মর্যাদা পান, মঙ্গলবারের হামলায় এই উপমন্ত্রীর গানম্যান আহত হলেও গানম্যানকে ছুঁতেও পুলিশ আসেনি বলে অভিযোগ উঠেছে। শান্তিপূর্ণ মিছিলে দৃশ্যত পুলিশি প্রহরায় বা নীরবতায় ক্যাডারদের গুলি হয়েছে। মেয়র আইভীর সঙ্গে শামীম ওসমান পরিবারের দ্বন্দ্ব-সংঘাত কোনো নতুন ঘটনা নয়, এর ইতিবৃত্ত দেশবাসীর কাছে পরিষ্কার।

প্রকাশ্যে পুলিশের চোখের সামনে মেয়র আইভীর ওপর হামলা সুশাসন বা আইনের শাসন পরিমাপ করার একটি উদ্বেগজনক সূচক হিসেবে আমরা দেখতে পারি। আইভী এক নন্দিত আওয়ামী লীগারের নন্দিত কন্যা। তাঁর মনে এই আশঙ্কা যেখানে ভর করেছে, যেখানে তিনি রাস্তায় পড়ে থাকেন, সেই শহরের পুলিশ সুপার মঙ্গল ও বুধবার তাঁকে দেখতে যান না। এমনকি টেলিফোনেও খোঁজ নেননি। ডেপুটি কমিশনারও আক্রান্ত উপমন্ত্রীর সাক্ষাৎ প্রার্থনা করেননি। শুধু একটিবার টেলিফোন করে সৌজন্য রক্ষা করেছেন।

আমরা সরকারের তরফে একটি লিখিত ব্যাখ্যা আশা করি। এতকাল জেনে এসেছি, ব্যুরোক্রেসির কতগুলো নিজস্ব ধর্ম আছে। তারা শাঁসে-মূলে খায় না। কিন্তু এখন তারা যেন কোনো ধরনের রীতিনীতির ধার ধরছে না। মন্ত্রিসভা বিভাগ গত ৭ নভেম্বর বলেছিল, আইভী একজন উপমন্ত্রীর পদমর্যাদায় সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন। মন্ত্রিসভার অন্য কোনো সদস্য যদি এমনভাবে আক্রান্ত হতেন, তাহলে কি ডিসি-এসপিরা এ রকম মনোভাব দেখাতেন? মর্যাদায় উপমন্ত্রী, কিন্তু বিএনপির মেয়রের ভাগ্যে এমন বৈষম্য বা অবহেলা এর আগে আমরা দেখেছি।

তাই নারায়ণগঞ্জে যা ঘটে গেল, তাকে শুধু হকার উচ্ছেদসংক্রান্ত চিরচেনা বাদানুবাদ, যেখানে সাধারণত আমরা সংগত কারণেই দরিদ্র হকারদের পুনর্বাসনের পক্ষে সহানুভূতিশীল থাকি, তার আলোকে দেখলে চলবে না। আমরা বিশ্বাস করি, বামপন্থী যেসব দল ঐতিহ্যগতভাবে প্রলেতারিয়েতের পক্ষে সোচ্চার থাকে, তারা নারায়ণগঞ্জের বঙ্গবন্ধু সড়কটিতে হকার উচ্ছেদ ঠেকাতে শামীম ওসমানের নেতৃত্বাধীন সহিংস আন্দোলনে কীভাবে কী সমর্থন ব্যক্ত করেছে ও করবে বলে প্রতীয়মান হবে, সেটা একটা দেখার বিষয় থাকবে।

যে অশুভ রাজনৈতিক শক্তি আইভীর নেতৃত্বাধীন শুভ শক্তির রাজনীতিকে পর্যুদস্ত করতে দীর্ঘকাল অবিরাম চেষ্টা করেছে, দেশবাসী যাদের শক্তির উৎস ও তাদের সীমাবদ্ধতার কথা সম্যক অবহিত, তারা ত্বকী হত্যার অভিযোগপত্র অনন্তের পথে ঝুলন্ত থাকা অবস্থায়, সর্বশেষ কতটা শক্তিশালী বা দুর্বল, সেসব মূল্যায়নের একটা সুযোগ এনে দিয়েছে এই ঘটনা।

আগামী সাধারণ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনী প্রচারণার সম্ভাব্য চেহারাটা কী হতে পারে, সেটা নারায়ণগঞ্জের এই ‘কালো মঙ্গলবার’-এর রূপ সন্দর্শনে নির্বাচন কমিশন বিবেচনা করতে পারে। প্রশ্ন উঠবে শুধু গরিব হকারদের পক্ষে ‘অতি মানবিকতার’ স্বার্থে নারায়ণগঞ্জে পুলিশের সহযোগিতায় সুপরিকল্পিতভাবে সশস্ত্র হামলার বিস্ময়কর ঘটনাটি ঘটেছে কি না। ভেবেছিলাম, প্রধানমন্ত্রী কড়া নির্দেশ দিয়েছিলেন, মানে খামোশ বলেছিলেন, তাতে বেশ কাজ হয়েছে। উপরন্তু সাত খুনের ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডের রায় যেকোনো অশুভ শক্তিকে বিচলিত করবে, তাকে দমিয়ে দেবে, তা ভেবেও আমরা একটু আশ্বস্ত হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু জনপ্রশাসন দৃশ্যত যে শোডাউন করেছে, সেটা শামীম ওসমানের ক্যাডারদের অপতৎপরতাকেও যেন কিছুটা ম্লান করে দিয়েছে। পুলিশ কী করেছে, তার সচিত্র প্রমাণ বুধবারের সংবাদপত্র ও টিভি ফুটেজ।

আমরা পাঁচটি নির্দিষ্ট অভিযোগের তদন্ত ও তার দ্রুত ফলাফল আশা করি। প্রথমত, আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় নেত্রী ও নারায়ণগঞ্জের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ে অভিযোগ করা হয়েছে যে তিনি মঙ্গলবার ‘বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীদের’ নিয়ে মিছিল করেছিলেন। এটা সত্য কি না?

আমরা জেনেছি, মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে আওয়ামী লীগের একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী আইভীকে ফোন করে এমন ধরনের বিস্ময়কর ইঙ্গিত দিয়েছেন। অবশ্য আইভীর বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ আওয়ামী লীগের শান্তিকামী নেতা-কর্মী যেমন, তেমনি দেশবাসীর কাছে মোটেই নতুন ঠেকবে না। কারণ, তাঁকে ঘায়েল করতে হলে এই একটি অস্ত্র আছে, যা হয়তো কারও কারও সন্ত্রাসী তৎপরতাকে আড়াল করতে ব্যবহৃত হতে পারে। আইভী ওই মন্ত্রী এবং দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতার কাছে ওই অভিযোগ তাৎক্ষণিক নাকচ করেছেন।

আইভীর সমর্থকেরা দাবি করেছেন, ৩৬ কাউন্সিলরের কাউকেই তিনি আমন্ত্রণ জানাননি। তবে তিন কাউন্সিলরকে নিয়ে একটি সভা করেছিলেন ১০-১২ দিন আগে। বঙ্গবন্ধু সড়কটি ১৩, ১৪ ও ১৫ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে বিস্তৃত, এই ওয়ার্ডগুলোর অংশেই সবচেয়ে বেশি হকার বসেন। এর মধ্যে হকার্স মার্কেট এবং অধিকতর বেশি হকারের আনাগোনা ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে। এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর খোরশেদ ২০০৩ সাল থেকে একাদিক্রমে তিনবারের নির্বাচিত কাউন্সিলর। তিনি বিএনপির স্থানীয় নেতা। সুতরাং তাঁকে সক্রিয় দেখা গেলে তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হওয়ার কথা নয়; বরং সেটাই স্বাভাবিক। প্রশ্ন হলো, যদি না তাঁর বিরুদ্ধে অপরাধমূলক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ থাকে, শুধু বিএনপির নেতা হওয়া অপরাধ কি না?

আমরা বুঝতে পারি, আইভী নিজেকে কিছুটা কোণঠাসা ভাবতে পারেন এটা দেখে যে, কয়েকজন শ্রদ্ধাভাজন বাম নেতার বৈধ সমর্থন দুর্ঘটনাক্রমে শামীম ওসমানের অসৎ উদ্দেশ্যকে বৈধতা দিচ্ছিল। তাই তিনি সরাসরি জনগণের প্রাণস্পন্দন টের পেতে রাজপথে নেমেছিলেন। অশুভ শক্তি হয়তো ভেবেছিল, তাঁকে শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করতে দিলে তিনি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ‘ভুল সিদ্ধান্ত’ হলেও তা বাস্তবায়ন করতে পারবেন। কিন্তু কোনো ফৌজদারি অপরাধ সংঘটন এবং তাতে প্রশাসনের সমর্থন দেওয়ার পক্ষে কোনো যুক্তি বা কোনো বৈধতা নেই।

আইভী ২০০৭ সালে হকারদের জন্য ৬০০ দোকান করে দিয়েছিলেন, এর মধ্যে মাত্র ২৫৫ জন তা ধরে রেখেছেন। আর সবাই বাকিটা বিক্রি করে পুনরায় অবৈধ ফুটপাতে নেমে এসেছেন। এখন তাঁদেরও কেউ কেউ হকার স্বার্থ রক্ষায় নেতা সেজেছেন।

দ্বিতীয়ত, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদকের মাথা ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়েছে। তাঁর প্রায় ১০টি সেলাই লেগেছে। জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, যুবলীগের সভাপতি, মহানগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক জখমপ্রাপ্ত। ‘চিনে চিনে’ এঁদের (এঁরা আইভীর আত্মীয়) আহত করেছে কারা? এই ঘটনার রেশ না মেলাতেই সংসদ অধিবেশন বসেছে। কিন্তু সেখানে কেউ এসব নিয়ে উচ্চবাচ্য করেননি। বিএনপির ক্যাডাররা করলে কী হতো?

তৃতীয়ত, আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মেয়র আইভী রাস্তায় বসে পড়ার (প্রথম আলোর বুধবারের রিপোর্ট অনুযায়ী হুড়োহুড়িতে তাঁর রাস্তায় পড়ে যাওয়ার তথ্য ঠিক নয়) পরেও কেন পুলিশ তাঁকে উদ্ধারে এগিয়ে যায়নি। ভিডিও ক্লিপ ও আলোকচিত্রগুলো এর জ্বলন্ত প্রমাণ, পুলিশকে তাঁর পাশে নয়, কিছু দৃশ্যে হামলাকারীদের কাছাকাছি দেখা গেছে। অথচ যেভাবে আইভীকে পুরুষ সমর্থকেরা আগলে রেখেছেন, সেটা নারী পুলিশদের করার কথা। কর্মসূচি পূর্বনির্ধারিত এবং মেয়র তা প্রশাসনকে আগের দিন অবহিত করলেও দৃশ্যপটে নারী পুলিশ কেন দেখা যায়নি?

চতুর্থত, জেলা প্রশাসন দাবি করেছে, সংসদ সদস্য যেহেতু হকারদের পক্ষে, তাই তাদের কী করণীয়? বঙ্গবন্ধু সড়কটি সেলিম ওসমানের এলাকায়, মেয়রকে দেওয়া তাঁর চিঠি সাক্ষ্য দেবে, স্থানীয় সাংসদ অন্তত লিখিতভাবে শামীম ওসমানের অবস্থানকে সমর্থন দেননি। কারণ, মাত্র তিন দিন আগে আইভীকে দেওয়া চিঠিতে হকার পুনর্বাসনে চারটি বিকল্প স্থান নির্দিষ্ট করেছিলেন। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু সড়কটি ছিল না, এমনকি তাঁর সুপারিশমতে দুটি স্থান মেনে নিয়ে আইভী তাঁকে চিঠিও দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রক্রিয়া সম্পন্ন না করে তিনি দুবাই চলে গেছেন। সুতরাং এটা তদন্তযোগ্য যে প্রশাসন কী যুক্তিতে বঙ্গবন্ধু সড়কে হকারবান্ধব অবস্থান নিয়েছে?

পঞ্চমত, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশ আছে, প্রতিটি সিটি করপোরেশনের সমন্বয় কমিটিতে ডিসি-এসপির পদাধিকারবলে সদস্য এবং মেয়রের ডাকা সভায় তাঁদের অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক। কিন্তু হকারদের এই বিষয়সহ অতীতে মেয়র যখনই তাঁদের কোনো সভায় আসতে চিঠি দিয়েছেন, তাঁরা তা অবজ্ঞা করেছেন। মেয়রের অফিসের এই একতরফা দাবি যেটা করা হয়েছে, তার সত্যতা তদন্তযোগ্য। যদি প্রমাণিত হয় যে তাঁরা সত্যি মেয়র আইভীর ডাকা কোনো একটি সভাতেও যাননি, তাহলে তা অসদাচরণ বলে গণ্য হওয়ার কথা। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা লঙ্ঘন একটি আলাদা অভিযোগ হিসেবে খতিয়ে দেখার দাবি রাখে। যে অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের বিরুদ্ধে মেয়র মিথ্যাচারের অভিযোগ করেছেন, তাঁকেই কেন তদন্ত কমিটিতে রাখা হলো?

 মেয়রের পদযাত্রায় আমরা নাগরিক শরিকানা দেখেছি। অন্যদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি ও সাংস্কৃতিক জোটের জেলা সভাপতিকে তাঁর সঙ্গে দেখা গিয়েছিল। আমরা বিশ্বাস করি, আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের এখন পর্যন্ত যাঁরা আসুরিক শক্তিকে শুভবুদ্ধি দিয়ে পরাস্ত করেছেন, তাঁরা যথারীতি মেয়র আইভীকে ভুল বুঝবেন না। আইভীকে হারিয়ে দেওয়া হলে অশুভ রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে। তাঁকে সুরক্ষায় পুলিশি ব্যর্থতা ও তাঁকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ বিষয়ে আমরা সংসদে স্থানীয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি চাই।

মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷