'পুত বাড়ি যাইতে পারল না'

আল আমিনদের পিতারা এর চেয়ে বেশি আর কী বলতে পারেন। বাসাবাড়িতে কাজের মানুষ বা গৃহকর্মীর অভাব যত বাড়ছে, তাদের ওপর নির্মমতা আর নিষ্ঠুরতার মাত্রা এবং তার প্রক্রিয়া যেন ততই ভয়ানক হয়ে উঠছে।

আল আমিনকে তার পরিবার ঢাকায় কাজে পাঠিয়েছিল। ১০-১২ বছরের একটা ছেলে মাসে তিন হাজার টাকা রোজগার করবে, থাকা-খাওয়ার খরচ লাগবে না, ভূমিহীন খেটে খাওয়া মানুষ যাদের এখন ৬০ টাকা কেজির চাল কিনতে জান বেরিয়ে যাচ্ছে, বাবা রুহুল আমিন কী করে এ রকম প্রস্তাব ফিরিয়ে দেবেন? রুহুল আমিনের ঢাকাপ্রবাসী জ্ঞাতি ভাই মানিক হোসেন এই প্রস্তাব করলে তাঁর কাছে খারাপ ঠেকেনি কোনো বিবেচনায়। কোনো আরবি শেখ আল আমিনকে কাজে নেননি, ঢাকার আদাবর অঞ্চলে শেখেরটেকের জনৈক জোবায়ের শেখ তাকে নিয়েছিলেন। পাঁচ-ছয় মাস নানা নির্যাতন সহ্য করে খেয়ে না-খেয়ে টিকে ছিল আল আমিন। তারপর গত মাসের ২৩ বা ২৪ তারিখে শেখ জোবায়ের আর তাঁর স্ত্রী সাইয়েদা শেখ তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। আরবের শেখরা মারলে যখন কিছু হয় না, তখন আদাবরের শেখ মারলে আর কী হবে? কী হয়েছে?

গত দুই বছরে আরও নয়টি শিশু গৃহকর্মীর মৃত্যুর খবর ছাপা হয়েছিল পত্রিকায়। পত্রিকায় না ছাপা শিশুদের খবর তো আমাদের জানা নেই। এ ছাড়া তথাকথিত রহস্যজনক মৃত্যুও আছে। তার সংখ্যা খবরের কাগজের হিসাবে গত দুই বছরে ২৩। এই ২৩ জনের মৃত্যুর বিষয়ে গৃহস্বামীরা শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা বা অজানা কারণে মৃত্যু বলেছেন। মৃত্যু বা হত্যা ছাড়া পিটিয়ে সোজা করতে গিয়ে হাসপাতালে বা চিকিৎসকের কাছে পাঠানো শিশু গৃহকর্মীর সংখ্যা ছিল ২২। জানাজানি হয়ে যাওয়া ধর্ষণের সংখ্যা ছিল ১১। এই হিসাব প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম।

তাদের এই হিসাব প্রকাশ অনুষ্ঠানে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেছেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতির জন্যই এ রকমটি ঘটছে। তাঁর সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করার অবকাশ নেই। কিন্তু কেন এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি? কার অক্ষমতা? আইনের, বিচারব্যবস্থার, পুলিশের, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির না অদৃষ্টের? এ দায় আমরা কার কাঁধে চাপাব? এখন পর্যন্ত কোনো শিশু গৃহকর্মী হত্যার কোনো বিচার হয়েছে কি? ধরপাকড়, রিমান্ড, হাজত, চার্জশিট হয়তো হয়েছে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত নটেগাছটি মুড়িয়ে দিয়ে মিটমাট হয়ে গেছে। কিংবা তারিখের পর তারিখ পড়তে পড়তে একেবারে ক্যালেন্ডারই শেষ হয়ে গেছে।

বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী পরিষদের প্রধান একবার প্রস্তাব রেখেছিলেন, গৃহকর্মী নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ-সম্পর্কিত সব মামলার দ্রুত বিচার নিষ্পত্তি–প্রক্রিয়ায় যেন নিবন্ধন ও পরিচালনা করা হয়। অন্যান্য মানবাধিকার ও আইনি সহায়তাদানকারী প্রতিষ্ঠানও চায় এসব মামলার দ্রুত ও সহজ নিষ্পত্তি হোক। কিন্তু আসামিরা যখন পয়সাওয়ালা আর বাদীরা গরিব, তখন যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদছে। তবে কোনো কোনো ঘটনা সংবাদমাধ্যমের অবিরাম চাপের কারণে কখনো ওইসব ঘটনার মামলা অগ্রগতির মুখ দেখে। তবে শেষ পর্যন্ত আদালতে দোষী ব্যক্তিদের চূড়ান্ত শাস্তি হওয়ার ঘটনা এক আদুরী ছাড়া আর কোনো ক্ষেত্রে ঘটেছে কি? আদালতে গিয়ে বেশির ভাগ শিশু গৃহকর্মী হ্যাপি হয়ে যায় (মাহফুজা আক্তার হ্যাপি, ক্রিকেটার শাহাদাত দম্পতির বাসায় আহত হওয়া শিশু)। আদালতে তোতাপাখির মতো বলে দেয়, ‘কেউ নির্যাতন করেনি, নিজে নিজে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছি।’

আদুরীর মামলার প্রথম রায় হতে সময় লাগে প্রায় চার বছর। ২০১৩ সালে মারধরের পর তাকে মৃত ভেবে আবর্জনার স্তূপে ফেলে গিয়েছিল গৃহকর্তাদের দলবল। এই চার বছরে তার শরীরে আর মুখের আঘাতের চিহ্নগুলো মিলিয়ে যায়নি।

বলা বাহুল্য, প্রধান অভিযুক্ত গৃহকর্মী উচ্চ আদালতে যাবেন তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আপিলের আবেদন নিয়ে, হয়তো বিচারাধীন আসামি হিসেবে তাঁর জামিনও হবে একদিন। আদুরীর পরিবার অনেক জোরাজুরির পরেও আপস করেনি। আদুরী তোতাপাখি হয়নি। পটুয়াখালীতে আদুরীর বাড়ি দেখলে কবি জসীমউদ্‌দীনের কবিতার আসমানীদের ঘরের কথা মনে হবে। জেলা সদরের খুব কাছেই আদুরীদের গ্রাম। দুই বেলা খাবার জোটে কি জোটে না। বছর দুয়েক আগে তাকে দেখতে গিয়ে জানতে চেয়েছিলাম তার ভালো লাগা, খারাপ লাগার কথা। খুব স্পষ্ট করেই বলেছিল, ‘আপনারা যখন এসে আমার ছবি ওঠান, তখন আমার খুব খারাপ লাগে। আপনারা শুধু আমার শরীরের ছবি তোলেন, এটা ভালো না।’ কোনো তথাকথিত পুরস্কার পাওয়া প্রগতিশীল স্কুলে তার ঠাঁই হয়নি। এক মাদ্রাসার শিক্ষক তাকে আর তার ছোট বোনকে নিজের আগ্রহে ভর্তি করে নিয়েছিলেন, নিজের হাতে বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন তার বইখাতা।

যাঁদের আমরা আলোকিত বলি, তাঁদের মধ্যেই যেন বেশি অন্ধকার। গত বছরের জানুয়ারি মাসে পাকিস্তানের এক নামজাদা বিচারকের বাড়িতে ১০ বছরের এক বালিকা গৃহকর্মীর বীভৎস নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে। ঘটনাটা পাকিস্তানের হওয়ায় এখানে উল্লেখ করতে কোনো অসুবিধা নেই। ইসলামাবাদের বিচারপতি রাজা খুররম আলী খানের বাসায় মেয়েটি দুই বছর যাবৎ কাজ করছিল। তার মানে মাত্র আট বছর বয়সে তিনি তাকে কাজে বহাল করেছিলেন। পাকিস্তানে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ শিশু প্রতিনিয়ত এ রকম নির্যাতনের ঝুঁকির মধ্যে শিশুশ্রম বিক্রি করছে।

বাংলাদেশের হিসাবটা কী? কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। ২০১৩ সালে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এক হিসাবে দেখা যায়, ২০০৬ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত ১ হাজার ৭০টি গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা আদালত পর্যন্ত গড়ায়। সে সময়ের মধ্যে প্রায় ৫৬৫ জন গৃহকর্মীর মৃত্যু হয় গৃহকর্তাদের নির্যাতনে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এই হিসাবের গড় করলে বছরে কমবেশি ৫০ জন গৃহকর্মীর মৃত্যু হয় নির্যাতনে। নির্যাতনকারীরা সবাই ওপরতলার মানুষ। ভারতে গৃহকর্মী সরবরাহে বেশি নাম করেছে মুম্বাইয়ের পোর্টাল বুকমাইবাই। সম্প্রতি এই প্রতিষ্ঠানটি বলিউডের তারকাদের বাড়িতে আর গৃহকর্মী সরবরাহ করছে না। তাদের মতে, এই আলো–ঝলমল ব্যক্তিরাই নিষ্ঠুরতায় সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন। তিন কোটি রুপির গাড়িতে চড়া এক অভিনেত্রী নাকি তাঁর গৃহকর্মীকে না খাইয়ে রাখতেন, বড়জোর চা-বিস্কুট খেতে দিতেন। যে প্রতিষ্ঠান তাদের বিজ্ঞাপনে বলে: ‘হীরা তুচ্ছ, বউকে একটা গৃহকর্মী উপহার দাও’, এমন আগ্রাসী বিজ্ঞাপনদাতারাও তারকাদের বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নির্যাতনের মাত্রা কোন পর্যায়ে পৌঁছালে গৃহকর্মীর ব্যবসায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত নাখোশ হয়।

সব গৃহকর্মী, বিশেষ করে শিশু গৃহকর্মীদের স্বার্থে সমন্বিতভাবে কাজ করা খুবই জরুরি। শিশুরা থাকবে স্কুলে, বাড়িতে, খেলার মাঠে—আমাদের স্বাধীনতার ৫০ বছরের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আমরা কি একটা শিশুশ্রমমুক্ত বাংলাদেশের প্রত্যাশা করতে পারি না?

গওহার নঈম ওয়ারা: ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মী। শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।