শরণার্থীর না-বলা কথা

‘চিনলা না?’

মাঝি আমিন হাজির সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল দমদমিয়া শরণার্থী শিবিরে ১৯৯২ সালের অক্টোবর- নভেম্বরে। আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগে তখন তিনি চল্লিশের কাছাকাছি (কার্ডে বয়স লেখা ছিলো ৩৫), এখন বয়স প্রায় ৬৫। কুতুপালং শিবিরে একটা পা লম্বা করে রোদে পিঠ দিয়ে বসে ছিলেন আমিন। চুল-দাড়ি সব সাদা। আমিন মাঝির সামনে দিয়ে বার দুয়েক হাঁটাহাঁটি করেছি, তৃতীয়বারের সময় তিনি তাঁর হাতের লাঠিটা দিয়ে আমাকে ঠেকালেন। ক্ষীণ কণ্ঠে কিছু একটা বলার চেষ্টা। আমি যেন শুনলাম ‘চিনলা না’। ঘন করে দেখি, নিবিড় হয় চাহনি, ‘আই হৌদ্দে আমিননা’। উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করেন, পারেন না। ১৯৯২ সালে ঊরুতে গুলি লেগেছিল। নভেম্বর বা ডিসেম্বরের শুরুতে ক্যাম্পের পাহারায় থাকা আনসারদের সঙ্গে শরণার্থীদের বাগ্‌বিতণ্ডা শেষ পর্যন্ত গুলিবর্ষণ দিয়ে শেষ হয়। তিনজন নিহত হয়েছিল সেবার, আহত অনেক। আমিন তাদের একজন। হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলাম সে সময়। এর কয়েক মাস পর দমদমিয়ার শিবির থেকে অন্যান্য শিবিরে শরণার্থীদের সরিয়ে ফেলা হয়। আমিন হারিয়ে যান মানুষের ভিড়ে। ’ ৯৩-এর মাঝামাঝি ফেরত যায় হাতিপাড়া, নাগফুরা, বুচিডং। আমি তাঁকে মাঝি বলে ডুকরে ডাকি। ‘ আই তো আর মাঝি নাই, এনহ আই হৌদ্দে আমিন না’! ’ ৯২-এর গুলির ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন এখনো। আমিনকে লাঠি নিয়ে হাঁটতে হয়। ছেলে আর জামাই বাঁশের মাঝে ঝুড়ি ঝুলিয়ে তাঁকে নিয়ে এসেছেন। তাঁর ছেলের বয়োসীরা এখন শিবিরে মাঝির দায়িত্ব পেয়েছেন। শরণার্থীদের সেসব নিয়েųকোনো আফসোস নেই। হুকুমত যাঁদের পছন্দ করে তাঁরাই মাঝি হন। এই সত্য ওপারে যেমন এপারেও তেমন। আমিন মাঝির সামনেই বসে পড়ি। আমিন আমার কাঁধে হাত দিয়ে উঠে দাঁড়ান। আমরা একটু ফাঁকা জায়গা খুঁজি। দুই সারি ছাউনির মাঝে বসি আমরা। যোগ দেন হামিদুল, কাশেম, বরকত, আলী, জয়নাল, অলি, রশিদ আরও অনেকে। আমিন আর জয়নাল ছাড়া অন্যরা এই প্রথম এসেছেন বাংলাদেশে শরণার্থী হয়ে। বাজারহাট করতে এক-দেড়দিনের সীমান্ত ভিসা নিয়ে আগেও এসেছেন প্রায় সবাই। দমদমিয়ার রক্তাত ঘটনার স্মৃতি কাটিয়ে আমাদের কথা এগোতে থাকে। এর মধ্যে কোথা থেকে যেন উড়ে আসে নতুন মাঝি আকরাম। গায়ে মাঝির জ্যাকেট। মাঝি লেখা ছেপে দেওয়া হয়েছে সেই উর্দিতে। দুই পকেট থেকে দুটি মুঠোফোন বের করে কোলের ওপর মেলে ধরে। আমাদের সমাজে যার যতটা মোবাইল ফোন, তার তত সম্মান, তার তত বাহাদুরি। শরণার্থীরা কত সহজে মিলেমিশে যাচ্ছে আমাদের অহংকার ফুটানি আর দম্ভের জমিনে।

কেমন চলছে তাদের দিনকাল?
কথা আগায়-আগে যেমন বলতেন তেমনই বলেন-গম আছি ( ভালো আছি) । রাতে ঘুমাতে পারি। মশা-মাছি, খিদে যা-ই থাকুক, ভয়টা নেই। মতামত জানাতে পারেন কি ক্যাম্প হুকুমতের কাছে? হুকুমত কি শোনে? আমিন বলে যান। মনে করিয়ে দেন, এটা ’ ৯২ সাল নয়। ২০১৭ সালে যত মানুষ এসেছে, ’ ৯২-এ সেটা ছিল কল্পনার বাইরে। কাজেই এবারের চ্যালেঞ্জটা অনেক অনেক বেশি। আমিন বলেন, এবার চাপ বেশি, কিন্তু কষ্ট কম। আমি বুঝতে পারি না, ভেঙে বলতে বলি। ’৯২-এ আমাদের কোনো সাহারা ছিলো না, আমরা বুঝতে পারিনি কোথায় যাব কার কাছে যাব। এবার আগের বছরগুলোতে চলে আসা আর’ ৯২-এ থেকে যাওয়া লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা তাদের পথ দেখিয়েছে। জানিয়েছে কোথা দিয়ে কখন কীভাবে আসতে হবে। কোথায় খাবার, কোথায় পানি। এপারের হুকুমতের মতামত তাদের মনমানসিকতায়। এই সহযোগিতা আগে ছিল না। একেই কি বলে ডিজিটাল যোগাযোগ!

হিন্দুরা কেন এল?
আলোচনায় ঘুরেফিরে বারবার চলে আসে মুসলমানদের প্রতি বার্মা রাষ্ট্রযন্ত্রের নিগ্রহের কথা-মসজিদ বন্ধ, আজান বন্ধ, মাদ্রাসা বন্ধ, স্কুল বন্ধ, বাতি বন্ধ ( রাতে কেউ আগুন বা আলো জ্বালাতে পারে না) এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রাম বা শহর-গঞ্জে যাওয়া বন্ধ। গরুর সংখ্যা বেড়ে গেলে জবাবদিহি। নির্দিষ্ট সংখ্যার বেশি গবাদি পশু না রাখার ব্যবস্থা ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব আগেও শুনেছি, এসব নতুন কিছু নয়। তাহলে হিন্দুরা কেন এল? তাদের তো নামাজ-রোজা, মসজিদ-মাদ্রাসার বালাই নেই। তাহলে তারা কেন গ্রাম ছাড়ল, Īউদ্বাস্তু হলো? জবাব দেন বরকত-গুলি আর আগুন হিন্দু-মুসলমানদের বাছতে পারে না। পাশাপাশি গ্রাম, কোনো কোনো জায়গায় হিন্দু আর মুসলিম বসতি একেবারে গা ঘেঁষাঘেঁষি, বাঁচার পর না হিন্দু-মুসলমান বাছবিচার। আবার ধর্ম আলাদা হলে সমাজ আর জীবিকার ক্ষেত্রে একে অপরের পরিপূরক। মুসলমানের নৌকায় হিন্দু মাছ ধরে আবার হিন্দুর নৌকা নিয়েও জলে ভাসে মুসলমান জেলে মাঝি। প্রতিবেশীশূন্য বিরান গ্রাম, তারা কীভাবে টিকবে জীবিকার লড়াইয়ে?

হিন্দুরা কি ফিরবে?
এখন তো ওদের ফিরিয়ে নেওয়ার তোড়জোড় চলছে। ওদের ওখানে নিরাপত্তা দেবে বলছে। গত পূজার দিন একসঙ্গে প্রায় ২৭ জন নারীকে ওপারের হুকুমতের দালালেরা গোপনে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। ঠাকুর দেখার নাম করে তাদের হিন্দুপাড়া থেকে বের করে এনে ওপারে নিয়ে যায়। তারপর তাদের ছবিসহ সাক্ষাৎকার রাখাইন রাজ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় (ফেসবুকে) ছড়িয়ে দেওয়া হয়। তরুণ সেলায়মান আগ্রহ নিয়ে তার মোবাইল ফোন থেকে সেই সব ছবি দেখায়। বলে, আপনার মোবাইলে ব্লুটুথ থাকলে এখনই চালান করে দিতে পারি। তারপর মুহূর্তে ছবিগুলো আমার মোবাইলে পাঠিয়ে দেয়। আমি তাকিয়ে থাকি বিস্ময়ে। মোবাইলমুক্ত সমাজে বেড়ে ওঠা এই ১২-১৩ বছরের ছেলে দেখি সব পারে। 

আসলেই কি রাখাইন সমাজ মোবাইলমুক্ত?
রাখাইনে মোবাইলের চল অনেক দিন থেকেই। তারা প্রায় সবাই বাংলাদেশের সেট আর সিম কার্ড ব্যবহার করে। এটা দিয়ে তারা যোগাযোগ রাখে দেশে-বিদেশে (মালয়েশিয়ায়, থাইল্যান্ডে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আর বাংলাদেশে) থাকা তাদের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে। তবে এখনো তারা আইনত সিম-মোবাইল কিনতে পারে না। এই আইন তাদের বাধ্য করছে বেশি দাম দিয়ে মোবাইল-সিম কিনতে, সেটা বেআইনি। এখন যখন বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন হয়ে গেছে, তখন সিম কেনার ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা উচিত। যার যার সিম তার তার নামে থাকলে সেটা তো নিরাপত্তার জন্যই ভালো, পর্যবেক্ষণও করা যায়। সিম রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলে গেলে, জঙ্গল থেকে অন্য শহরে হাওয়া হয়ে গেলে সবই লক্ষ করা যাবে। অন্যের ( দোকানি, বাংলা- দালাল, রঙের ব্যবসায়ী?) বা পাচারীর সিম নিয়ে বেনামে ঘোরাফেরা তো আইনের চোখে ধুলা দেওয়ার শামিল। আইন মেনে চলার সুযোগ মানুষের একটা অধিকার। আইন পাস আর বাস্তবায়নের আগে ( এবং কখনো কখনো পরে) ভেবে দেখা দরকার, আইনটি কতটা বাস্তবসম্মত আর কতটা নিপীড়নমূলক। দেশ ছেড়ে আসা ঠিকানাবিহীন মানুষদের খাওয়া-থাকা ছাড়াও একটা বড় প্রয়োজন যোগাযোগ। ওপারে থেকে যাওয়া আর অন্য প্রা‌ন্তে কি অন্য দেশে চলে যাওয়া আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে নিয়মিত আর সহজ যোগাযোগের মাধ্যম সেলফোন বা মোবাইল ফোন। এটা বন্ধ রাখা কি সম্ভব।

(চলবে)

গওহার নঈম ওয়ারা: ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকর্মী; শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।