সর্বোচ্চ নেতা কে হবেন?

নতুন বছরের শুরুতে ইরানে ২০০৯ সালের পর সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ আন্দোলন হলো। তবে এই আন্দোলনে ইসলামিক রিপাবলিকটি একটু কেঁপে উঠলেও তাতে বড় পরিবর্তন আসেনি। নেতৃত্ব ও লক্ষ্যবিহীন এই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা প্রাথমিক ধাক্কার বাইরে বেশি কিছু করতে পারেনি। রাজনৈতিক অভিজাতরা এই আন্দোলনে সমর্থন দেননি। এমনকি সংস্কারপন্থীরাও এই ভয়ে হাত গুটিয়ে ছিলেন যে এতে ইরানের অবস্থা ‘সিরিয়ার’ মতো হতে পারে এবং তাঁরা ক্ষমতার ভাগ হারাতে পারেন। ইরানের নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রযন্ত্র আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হয়ে নিজেদের কাজ সেরে নিয়েছে। ব্যাপারটা হলো ইরানে কট্টরপন্থীরা যত দিন ক্ষমতায় আছেন, তত দিন সেখানে আন্দোলনকারীরা লড়াইয়ে জিততে পারবেন না। তা সত্ত্বেও দেশটির শীর্ষ পর্যায়ে শিগগিরই কিছু পরিবর্তন আসতে পারে। ইরানে রাজনৈতিক সংস্কার ও পরিবর্তনের পথে প্রধান বাধা হচ্ছেন দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি। তিনি সব সময় কট্টরপন্থীদের পেছনে দাঁড়িয়ে রক্ষণশীল রাজনীতির প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। কিন্তু তাঁর বয়স এখন ৭৮। নানা সূত্রের তথ্যানুসারে, তাঁর শারীরিক অবস্থাও ভালো নয়। তাহলে তাঁর মৃত্যুর পর কী হবে?

খোমেনির যদি মৃত্যু হয় বা তিনি কার্যক্রম পরিচালনায় অক্ষম হয়ে পড়েন, তাহলে তিন সদস্যের একটি পরিষদ তাঁর কাজ করবে, যেখানে আছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট, বিচার বিভাগের প্রধান ও গার্ডিয়ান কাউন্সিলের একজন ধর্মতাত্ত্বিক। ৮৮ সদস্যের উচ্চপর্যায়ের ইসলামি ধর্মবেত্তা যত দিন তাঁদের উত্তরসূরি নির্বাচন না করছেন, তত দিন এই পরিষদ দায়িত্ব পালন করে যাবে। এই বিশেষজ্ঞ পরিষদ আট বছরের জন্য জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়। তবে তার আগে গার্ডিয়ান কাউন্সিলের অনুমোদন পেতে হয় তাদের।

এই পরিষদ কীভাবে ও কাকে সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা নির্বাচন করবে, তা অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে পরিষদের আদর্শিক গঠন। এই পরিষদের সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল ২০১৬ সালে। অনেকেই তখন ফলাফল বিশ্লেষণে বলেছিলেন, নির্বাচনে মধ্যপন্থীদের জয় হয়েছে। তাঁদের দাবি ছিল, নির্বাচনে তারা ৫৯ শতাংশ ভোট পেয়েছে এবং এরপর তারা কট্টরপন্থীদের হটিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু অনেকে আবার একে কট্টরপন্থীদের বিজয় আখ্যা দিয়েছিলেন। ওই পরিষদ অন্যতম কট্টরপন্থী আয়াতুল্লাহ আহমেদ জানাতিকে চেয়ারম্যান হিসেবে বেছে নিয়েছিল। তিনি ৫১ ভোট পেয়েছিলেন। ফলে পরিষদ তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে: বাস্তববাদী, কট্টরপন্থী ও স্বাধীন গোষ্ঠী। স্বাধীন গোষ্ঠীটি এ ব্যাপারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ, তাদের দোদুল্যমান ভোট ফলাফল বদলে দিতে পারে। এর বাইরে বিভিন্ন রাজনৈতিক খেলোয়াড়েরা পরিষদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব বিস্তার করবে, এর মধ্যে আছে ইসলামি বিপ্লবী বাহিনী, আয়াতুল্লাহ খোমেনির কার্যালয়, বিভিন্ন মুসলিম ধর্মবেত্তা ও সরকার। অন্যদিকে আয়াতুল্লাহ খোমেনি ঘোষণা দিয়েছেন, তাঁর উত্তরসূরিকে অবশ্যই বিপ্লবী হতে হবে। এ ছাড়া তিনি বিশেষজ্ঞ পরিষদকে উত্তরসূরি নির্বাচনে ‘ভিতু’ না হতে অনুরোধ জানিয়েছেন। খোমেনির কার্যালয় হচ্ছে ইরানের রাষ্ট্রের ভেতরের রাষ্ট্র।

অন্যদিকে ইরানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট, জ্যেষ্ঠ মুসলিম নেতা ও বাস্তববাদী হাসান রুহানিরও সর্বোচ্চ নেতা হওয়ার সম্ভাবনা আছে। রুহানির জমানায় খোমেনি মারা গেলে বা দায়িত্ব ছেড়ে দিলে তাঁরই স্থলাভিষিক্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্য হিসেবে নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা তাঁরই সবচেয়ে বেশি। ১৯৮৯ সালে খোমেনির নেতা নির্বাচিত হওয়ার যে ভিডিও ফুটেজ ফাঁস হয়েছে তাতে দেখা যায়, ছোট একটি গোষ্ঠীও নেতা নির্বাচনে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। পরিষদের সদস্যদের মধ্যে রুহানি সবচেয়ে ক্ষমতাবান। প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা ব্যবহার করে তিনি বিভিন্ন গোষ্ঠী ও ক্ষমতা কেন্দ্রের সঙ্গে জোট গঠন করতে পারেন।

আন্তর্জাতিক পরিসরেও তিনি সবচেয়ে পরিচিত ও শ্রদ্ধেয় রাজনীতিক। অন্যদের তুলনায় তিনি অতটা আদর্শিক নন। বাস্তববাদী হিসেবে তিনি ইরানের আমলা ও টেকনোক্র্যাটদের সমর্থন পাবেন। এ ছাড়া পুরোনো ঘরানার মুসলিম ধর্মবেত্তাদের সমর্থনও তিনি পাবেন, যাঁরা ধর্ম ও রাজনীতি আলাদা রাখতে চান। যদিও ইসলামি বিপ্লবী বাহিনীর কমান্ডাররা মূলত কট্টরপন্থীদের সমর্থক, এই বাহিনী একমুখী নয়। বাহিনীর উচ্চপর্যায়ে বেশ কিছু বাস্তববাদী মানুষ আছেন, এর মধ্যে আছেন রিয়ার অ্যাডমিরাল আলি শামখানি, যিনি সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সচিব। আবার ইরানের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা যন্ত্রের ব্যাপারে রুহানির ব্যাপক অভিজ্ঞতা আছে। তিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট আকবর হাশেমি রাফসানজানি ও মোহাম্মদ খাতামির নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন।

যদিও ইরানিরা চান, দেশটি ধর্মতাত্ত্বিক থেকে গণতান্ত্রিক হোক, তাঁরা জানেন, রুহানি অত বৈপ্লবিক পরিবর্তনের চেষ্টা করবেন না। তাঁরা রুহানিকে বরং সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে দেখতে চাইবেন, কট্টরপন্থী নয়। তিনি যদি তা হন, তাহলে কট্টরপন্থীরা কোণঠাসা এবং অরাজনৈতিক মুসলিম ধর্মবেত্তারা ক্ষমতায়িত হবেন। রুহানি তো ইরানের উন্নয়নে পরামর্শদাতা রাফসানজানির মডেল অনুসরণ করেন। তিনি দেশকে চীনের ‘ইসলামি রূপ’ বানাতে চান, যার শক্তিশালী অর্থনীতি ও সামরিক শক্তি আছে। তিনি চান ইরানের সঙ্গে পশ্চিমের ভালো সম্পর্ক থাকুক, কিন্তু সে স্বাধীনভাবে পরিচালিত হোক।

রুহানি যদি সর্বোচ্চ নেতার পদে অধিষ্ঠিত হন, তাহলে তিনি বৈপ্লবিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের দিকে যাবেন না। তবে তিনি ইরানের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সাধারণ মানুষের নাগরিক অধিকারের সীমা বাড়াবেন। সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে তিনি নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর লাগাম দেবেন এবং তাদের নির্মমতার রাশ টেনে ধরবেন। এতে ইরানের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে এবং আর্থসামাজিক উদারীকরণ ঘটবে, যা মানুষও ভালোভাবে নেবে। কারণ, তারা যেমন একদিকে বিদেশি হস্তক্ষেপ দেখতে চায় না, তেমনি অন্যদিকে আরেকটি বিপ্লবও দেখতে চায় না। তবে রুহানির সামনে অনেক চ্যালেঞ্জও আছে। ১৯৮৯ সালের খোমেনির শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না, কিন্তু তাঁর সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। সম্ভবত তিনি ব্যাপক বিরোধিতার মুখে পড়বেন। তিনি জয়ী হলে ইরানে বড় পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা আছে।

অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, আল-জাজিরা থেকে নেওয়া।

সাইদ গোলকার: ইউনিভার্সিটি অব টেনেসির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক।