দুই কর্মকর্তা আটক ও দুটি বিষয়ে উদ্বেগ

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুজন কর্মকর্তা এখন গণমাধ্যম ও সামাজিক মিডিয়ার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছেন। শিক্ষামন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মোতালেব হোসেন এবং মন্ত্রণালয়ের উচ্চমান সহকারী নাসিরউদ্দিন সরকারি ভাষ্য মোতাবেক রোববার আটক হয়েছেন। এই ঘটনার পর গণমাধ্যমের আলোচনা লক্ষ করে আমি দুটি বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন।

এই দুই সরকারি কর্মচারীর আটকের খবরের সঙ্গে সঙ্গে গণমাধ্যমে জানা গেছে যে তাঁদের সম্পদের পরিমাণ ‘পাহাড়সমান’। বলা হচ্ছে, অভিযোগ রয়েছে যে তাঁদের ঢাকায় নিজস্ব বাড়ি-গাড়িসহ বিপুল সম্পদ রয়েছে (চ্যানেল আই অনলাইন, ২২ জানুয়ারি ২০১৮)। তাঁদের ‘আটকের’ পর শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ‘নিশ্চয়ই কোনো অপরাধের অভিযোগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁদের গ্রেপ্তার করেছে। অপরাধের প্রমাণ পেলে মন্ত্রণালয় থেকেও চাকরিবিধি মেনে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে’ (দেশ টিভি, ২২ জানুয়ারি ২০১৮)। কী অভিযোগ আনা হয়েছে গ্রেপ্তার করা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে-এর জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, এখনো এ নিয়ে তদন্ত চলছে, পুলিশ কাজ করছে। আগামী দু-এক দিনের মধ্যে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হবে (ইত্তেফাক, ২৩ জানুয়ারি ২০১৮)।

কিছু কিছু গণমাধ্যমে অভিযোগের একটি তালিকা প্রকাশিত হয়েছে এবং সেই তালিকা মোটেই ছোট নয় বা এককালীন কোনো কাজের বিষয় নয়। ‘আটক দুজনের বিরুদ্ধে অভিযোগের মধ্যে রয়েছে-প্রশ্নপত্র ফাঁস, জিপিএ-৫ বিক্রি, লেকহেড গ্রামার স্কুল চালুর ব্যবস্থা করা, মন্ত্রণালয় থেকে ভুয়া সনদ সত্যায়িত করা, দুর্নীতিগ্রস্ত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের অনুমতি পাইয়ে দেওয়া এবং টাকার বিনিময়ে সরকারি কলেজ ও স্কুলশিক্ষকদের পদোন্নতি ও বদলির ব্যবস্থা করা’ (চ্যানেল আই অনলাইন)।

বাংলাদেশের কোনো মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতিপরায়ণ কর্মচারী বা কর্মকর্তা থাকার খবর নতুন কিছু নয়; এমনকি দেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে, এমন খবরও নতুন মনে করার কারণ নেই। প্রশ্নপত্র ফাঁস থেকে শুরু করে কথিত ‘নিয়োগ-বাণিজ্য’ নিয়ে অহরহ খবর শোনা যায়। ২০১২ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন পিয়ন এবং চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী সমিতির একাংশের এক নেতা মোহাম্মদ আলীকে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে আটক করা হয়েছিল (প্রথম আলো, ২২ জানুয়ারি ২০১৮)। গত বছরের মে মাসে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী শিক্ষা পরিদর্শক মোস্তাফিজুর রহমানকে ঘুষ নেওয়ার সময় হাতেনাতে আটক করে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদকের একটি দল।

গত বছরের শেষ নাগাদ শিক্ষামন্ত্রী ‘সহনীয় মাত্রায় ঘুষ খাওয়ার’ কথা বলে আলোচিত হয়েছিলেন, পরে মন্ত্রণালয় তাঁর এই বক্তব্যের একটি ব্যাখ্যাও দিয়েছিল, যার গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধই থেকেছে। ১৭ ডিসেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে শিক্ষা খাতে দুর্নীতি নিয়ে মতবিনিময় সভা হয়েছিল। সেই সভায় শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি প্রতিরোধের লক্ষ্যে দুদকের গঠিত একটি টিম একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়কে দেয়, যাতে ৩৯টি সুপারিশ আছে। এগুলো মনে করিয়ে দেওয়ার কারণ একটাই-অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো অবাস্তব নয়, একমাত্র তাঁরাই এ ধরনের কাজ করতে পারেন, তা-ও নয়।

মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ইতিমধ্যেই সাংবাদিকদের বলেছেন যে কারও ব্যক্তিগত দুর্নীতির দায় নেবে না শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা অধিদপ্তর (চ্যানেল আই অনলাইন, ২২ জানুয়ারি ২০১৮)। যদিও আমরা সঠিকভাবে জানি না কোন কর্মকর্তা এ কথা বলেছেন। কিন্তু এই বক্তব্যকে বেশ চমকপ্রদ বলেই মনে হয়েছে এই কারণে যে এতে এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে দাঁড় করানোর চেষ্টাটি স্পষ্ট। সংবাদপত্রে প্রকাশিত অভিযোগের তালিকা যদি সত্যি হয়, তবে তা বিশ্বাসযোগ্য নয় যে দু-একজন মানুষ এসব অপকর্ম নির্দ্বিধায় চালিয়ে গেছেন এবং অন্যরা তাঁর কিছুই টের পাননি। ফলে এই নিয়ে আপাতত যত উচ্চবাচ্যই হোক, আমি উদ্বিগ্ন যে এটাকে কেবল ব্যক্তির বিষয় হিসেবেই দেখা হবে। আমার কাছে এটি একটি উদ্বেগের বিষয়।

আমার দ্বিতীয় উদ্বেগ হচ্ছে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত এই দুই ব্যক্তিকে কীভাবে আটক করা হয়েছে, তার কোনো রকম ব্যাখ্যা না পাওয়া এবং এই আটকের পদ্ধতি নিয়ে গণমাধ্যমে কোনো রকম আলোচনার অনুপস্থিতিতে। তাঁদের রোববার আটক দেখানো হলেও তাঁদের পরিবারের ভাষ্য অনুযায়ী, তাঁদের একজন বৃহস্পতিবার থেকে এবং আরেকজন শনিবার থেকে ‘নিখোঁজ’ ছিলেন। এ ঘটনায় মোতালেব হোসেনের ভাই শাহাবুদ্দিন বাদী হয়ে হাজারীবাগ থানায় যে সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন, তাতে বলা হয়েছে যে গত শনিবার বিকেল চারটার দিকে হাজারীবাগ থানাধীন বছিলা ওয়েস্ট ধানমন্ডি হাউজিং এলাকা থেকে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা মাইক্রোবাসে করে তাঁকে উঠিয়ে নিয়ে যায়।

পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে যে কোনো ব্যক্তিকে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং পরে পুলিশ বা র‍্যাব সেই ব্যক্তিকে ‘আটক’ দেখিয়েছে, এমন অনেক ঘটনাই গত কয়েক বছরে ঘটেছে। এ নিয়ে দেশের এবং দেশের বাইরের মানবাধিকার সংস্থাগুলো অনেক দিন ধরেই উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। যেকোনো সাধারণ মানুষের জন্যই তা উদ্বেগের বিষয় এবং সব ধরনের আইনি ব্যবস্থার বরখেলাপ, এটা সবাই স্বীকার করবেন। গত বছরগুলোতে আমরা দেখতে পেয়েছি যে রাজনৈতিক কর্মী, সরকারের প্রতিপক্ষ, এমনকি জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত থাকা ‘সন্দেহভাজন’ অনেক ব্যক্তির পরিবার অভিযোগ করেছে যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নামে তাঁদের উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। তাঁদের অনেকে এখনো ফিরে আসেননি, কারও কারও ক্ষেত্রে কিছুদিন পরে তাঁদের মৃতদেহ পাওয়া গেছে, ক্ষেত্রবিশেষে তাঁদের ‘আটক’ দেখানো হয়েছে। কেউ কেউ ফিরেও এসেছেন।

মোতালেব হোসেন ও নাসিরউদ্দিনের সঙ্গে একই সময়ে লেকহেড গ্রামার স্কুলের মালিক খালেদ হাসানকেও পুলিশ আটক দেখিয়েছে। খালেদকে রোববার আটক করা হয়েছে বলে পুলিশের ভাষ্য। কিন্তু গুলশান থানায় করা ডায়েরিতে বলা হয়েছে, ‘শনিবার বিকেল চারটার দিকে সাদাপোশাকে ৭-৮ জন লোক গুলশান-১ সেকশনস্থ লেকহেড গ্রামার স্কুলের সামনে থেকে খালেদকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে চলে যায়।’ এই বিষয়ে গুলশান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. সালাউদ্দিন একটি গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘সাদা মাইক্রোবাসে করে কে বা কারা তাঁকে নিয়ে গেছে, তা এখনো জানা যায়নি। কিংবা তিনি স্বেচ্ছায় গেছেন কি না, তা-ও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।’ (আমাদের সময় ডটকম, ২০ জানুয়ারি ২০১৮)। গত বছরগুলোতে যাঁরা গুমের শিকার হয়েছেন, তাঁদের প্রায় প্রত্যেকের ক্ষেত্রে নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা একই রকমের, তাঁদের হয় পথ থেকে অথবা বাসা থেকে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা গাড়িতে করে তুলে নিয়ে গেছে।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ কিংবা রহস্যজনক নিখোঁজ হয়েছেন মোট ৯১ জন। এর মধ্যে ফিরে এসেছেন বা খোঁজ পাওয়া গেছে মাত্র ২৬ জনের। তারা বলেছে, এই ৯১ জনের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়েই অপহরণ, গুম ও গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন ৬০ জন। এর মধ্যে পরিবার ফেরত পেয়েছে সাতজনকে। আর বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে ‘রহস্যজনক নিখোঁজ’ হয়েছেন আরও ৩১ জন। এর মধ্যে ফেরত এসেছেন নয়জন আর গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে ছয়জনকে (বিবিসি বাংলা, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭)।

আমরা লক্ষ করেছি যে গত বছর গুম ও নিখোঁজের শিকার হওয়ার তালিকায় রাজনৈতিক কর্মীদের পাশাপাশি যুক্ত হয়েছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, প্রকাশক, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। তাঁদের কেউ কেউ বছরের শেষ দিকে ফিরে এলেও অনেকেই এখনো কোথায় আছেন, আমাদের জানা নেই। এ ধরনের ঘটনার কারণ কী এবং কারা সংশ্লিষ্ট-এ নিয়ে তদন্তে সরকারের আগ্রহও লক্ষ করা যায়নি। তদুপরি এসব ঘটনাকে স্বাভাবিক বলেই ধারণা দেওয়া হয়েছে। পুলিশের প্রধান বলেছেন, ব্রিটিশ আমল থেকেই দেশে গুম হচ্ছে; প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাজ্যে নিখোঁজ ব্যক্তিদের গুম হয়ে যাওয়া মানুষ বলেই বর্ণনা করেছেন। এ ধরনের ঘটনাকে যখন স্বাভাবিক বলে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, তখন দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের এভাবে আটকের পর এদিকে সামান্যও মনোনিবেশ না করা আমার কাছে উদ্বেগজনক বলেই মনে হয়।

দুর্নীতি মোকাবিলার ব্যাপারে কারোরই ভিন্নমত নেই; উপরন্তু বড় ধরনের দুর্নীতির ঘটনার বিষয়ে দুদক ও সরকারের আচরণ অনেক ক্ষেত্রেই বিস্ময়কর। এখন তার সঙ্গে কথিত দুর্নীতিবাজদের আটকের এই পদ্ধতি যুক্ত হচ্ছে কি না এবং এই বিষয়ে নজর না দিয়ে গণমাধ্যমগুলো এ ধরনের ব্যবস্থাকে স্বাভাবিক রূপ দেওয়ার কাজেই সাহায্য করছে কি না, সেটা ভাবা দরকার।

আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।