আমাদের সন্তানদের কে বাঁচাবে?

৭ অক্টোবর পত্রিকার পাতায় স্কুলশিক্ষক মেঘনাদ বিশ্বাসের ছবিটা দেখেছিলেন? তাঁর সঙ্গে ১৭ জানুয়ারির পত্রিকায় প্রকাশিত প্রকৌশলী আখতার আজমের ছবিটা মিলিয়ে দেখুন। দুই পিতার একই অভিব্যক্তি। পিতৃহৃদয়ের এই শোক ও হাহাকার আমাদের ব্যথিত করে, উদ্বিগ্ন করে। কিন্তু এর আশু প্রতিকারের কোনো উপায় না দেখে আমরা অসহায়ও বোধ করি।

অপঘাতে মৃত্যুর এই মিছিল থামছে না। নতুন ঘটনার নিচে চাপা পড়ছে আগের ঘটনাটি। বিস্ময় ও বেদনার বিষয়, এই কিশোরেরা খুন হচ্ছে তাদেরই সমবয়সী বা বন্ধুস্থানীয়দের হাতে। ৬ অক্টোবর সিটি কলেজের প্রাক্তন ছাত্র সুদীপ্ত ঘোষকে চট্টগ্রামের নালাপাড়া এলাকার বাসা থেকে ডেকে নিয়ে প্রকাশ্যে রাস্তায় পিটিয়ে হত্যা করেছিল কয়েকজন কিশোর। রাস্তায় লাশ ফেলে ফাঁকা গুলি ছুড়ে চলে গিয়েছিল তারা।

আদনানকেও হত্যা করা হয়েছে প্রকাশ্যে রাস্তায়। জামালখান এলাকায় নিজের বাসার অদূরে একদল কিশোরের তাড়া খেয়ে প্রাণভয়ে ছুটছিল আদনান। তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি কেউ। কারণ, সন্ত্রাসী কিশোরদের একজনের হাতে ছিল পিস্তল, অন্যজনের হাতে ছুরি। তারা চারপাশে অসংখ্য ভীতসন্ত্রস্ত পথচারীকে সাক্ষী রেখে রাস্তায় আদনানকে হত্যা করে চলে যায়। এর আগে হারুন, ইমন, দিয়াজ-একের পর এক সম্ভাবনাময় তরুণের মৃত্যু ঘটেছে তাদের বন্ধুস্থানীয়দের হাতে।

অনেক ক্ষেত্রেই ঘটনার পর খুনিরা ধরা পড়েছে, কারণ তারা এখনো পাকা ও পেশাদার খুনি হয়ে ওঠেনি। ‘হিরো’ হয়ে ওঠার নেশায় বড় ভাইদের হাতের পুতুল হয়ে উঠেছিল তারা। বন্ধুর মতো একজনকে শত্রু বানিয়ে তার জীবনটা যেমন কেড়ে নিয়েছে, তেমনি তাদের নিজের জীবনটাও এখন বিপন্ন। অদৃশ্য কোন বড় ভাইয়ের কাছ থেকে তারা আগ্নেয়াস্ত্র পেয়েছিল, তার মুরব্বি কে-রিমান্ডে গিয়ে এসব কথা পুলিশের কাছে স্বীকারও করেছে তারা। কিন্তু কান টানলে যে মাথা আসে, সেই মাথা পর্যন্ত যাওয়ার সামর্থ্য বোধ হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নেই। তাই একের পর এক খুনের ঘটনা ঘটেই চলেছে।

প্রতিটি খুনের পর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সম্পৃক্ততার সূত্র পাওয়া যাচ্ছে। যেমন, আদনানের সঙ্গে তার বন্ধুরা দ্বন্দ্বে জড়িয়েছিল খেলার মাঠের ঘটনা নিয়ে। তাদের মাথার ওপর কলেজ ছাত্রলীগের মাঝারি গোছের এক নেতার ছায়া ছিল, তারা তাঁর কাছ থেকে পিস্তল ধার করে এনেছিল।

প্রথম দিকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা, দু-একটা দোকান থেকে খাবার বা অন্য কিছু বিনা মূল্যে কেড়ে নেওয়া-এসব করতে করতে সাহস ও ঔদ্ধত্য বাড়তে থাকে তাদের। পরে খুন করার সাহসও সঞ্চয় করে ফেলে। ছাত্রনেতারা কেন তাদের সহযোগিতা করেন? কারণ, এই বয়সী কিশোরেরা অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় থাকে, তাদের যেকোনো কাজে ব্যবহার করা সম্ভব। দলে নিজের প্রভাব বাড়ানোর জন্য এ রকম একটা বাহিনী প্রয়োজন। এই মাঝারি গোছের নেতাটিও হয়তো আরও উঁচু পর্যায়ের কারও পৃষ্ঠপোষকতা পান। এভাবে একটা চেইন (শৃঙ্খল) তৈরি হয়ে যায়।

দল বা রাজনৈতিক পরিচয় ছিল না আদনানের, তার হত্যাকারীদেরও না। কিন্তু সুদীপ্ত বা দিয়াজের রাজনৈতিক পরিচয় ছিল। তারা ছাত্রলীগের কর্মী। নগর ছাত্রলীগের সহসম্পাদক ছিল সুদীপ্ত। কিন্তু রাজনীতির জটিলতা বোঝার বুদ্ধি-বিবেচনা তার পুরোপুরি হয়নি। ফেসবুকের পাতায় মৃত্যুর তিন দিন আগে লিখেছিল, ‘রাজনীতি বড়ই জটিল জিনিস...। একসময়কার কথিত ডাস্টবিন এখন ফুলের বাগানের সৌরভ ছড়াচ্ছে।’ তাকে বোধ হয় হুমকি দেওয়া হচ্ছিল প্রতিপক্ষ গ্রুপ থেকে। বয়সোচিত দুঃসাহসে সে লিখেছিল ‘অপেক্ষায় রইলাম।’ এই স্ট্যাটাস দেওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সে খুন হয়।

এসব দেখেশুনে এ প্রশ্ন জাগে-কোন সমাজে আছি আমরা?

ঢাকার মতো চট্টগ্রামেও কিশোর-তরুণদের একটা অংশের মধ্যে একটা ‘গ্যাংস্টার’ কালচারের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। শুধু ঢাকা-চট্টগ্রাম নয়, এটা যে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে, তার আলামত পাওয়া গেল খুলনায় নবম শ্রেণির ছাত্র ফাওমিদ তানভীর খুনের ঘটনা থেকে। সহপাঠীকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করায় তানভীরকে খুন করেছে তারই বয়সী কয়েকজন কিশোর।

চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের উপকমিশনার শাহ মোহাম্মদ আবদুর রউফ পত্রিকান্তরে বলেছেন, এসবের জন্য শুধু পুলিশকে দায়ী করলে চলবে না। এই বয়সী ছেলেরা অতি আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে। পারিবারিকভাবে দেখভাল ও পরিচর্যা করা তাই জরুরি। তাঁর বক্তব্য অস্বীকার করার উপায় নেই। আদনান হত্যার ঘটনায় যে পাঁচ কিশোরকে আটক করা হয়েছে, তারা পারিবারিক সাহচর্য ও পরিচর্যা পায়নি, তা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে।

যেমন, আটক ব্যক্তিদের মধ্যে মঈনের বাবা দীর্ঘদিন বিদেশে ছিলেন। মাঝখানে কিছুদিনের জন্য একবার দেশে এসেছিলেন, আবার চলে গেছেন। সাব্বিরের বাবা অসুস্থ, তিনি মেয়ের সঙ্গে থাকেন। সাব্বিরের পরিবার চলে দুলাভাইয়ের আয়ে। মুনতাসিরের বাবার একটি কারখানা আছে সাতকানিয়া এলাকায়, দু-তিন সপ্তাহে একবার শহরে নিজের বাসায় আসেন। আরমানের বাবার মুদিদোকান আছে, সকালে গিয়ে রাতে ফিরে আসেন। একইভাবে নিহত আদনানের বাবারও কর্মস্থল খাগড়াছড়িতে। শহরের বাসায় সে থাকত মা ও বোনের সঙ্গে।

পারিবারিক বন্ধন ও অনুশাসনের অভাব এই উঠতি বয়সের ছেলেদের বিপথে যাওয়ার কারণ কি না, ভেবে দেখতে হবে। সন্তানকে সময় দিতে হবে, পরিচর্যা করতে হবে। কিশোরদের মধ্যে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, পাঠ্যসূচির বাইরের বই পড়ার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি বা ভালো পরিবেশে খেলাধুলা করতে পাঠানো গেলে তারা হয়তো এতটা হিংসাত্মক হয়ে উঠবে না। পরীক্ষায় ভালো ফল করার জন্য চাপ আছে, মানসিক বিকাশের তাগিদটা নেই। ফলে এই কিশোরেরা বিপথগামী হচ্ছে।

পুলিশের উপকমিশনার যথার্থ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায় কী করে অস্বীকার করবেন তিনি? চট্টগ্রাম শহরের আন্দরকিল্লা, চেরাগী পাহাড় মোড়, জামালখান, নন্দনকাননসহ বেশ কিছু এলাকায় দফায় দফায় দাঙ্গা-ফ্যাসাদ চালিয়ে যাচ্ছে একশ্রেণির কিশোর-তরুণ। কারণে-অকারণে দল বেঁধে হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনায় এলাকাবাসী আতঙ্কিত। এসব ঘটনার খবর পত্রপত্রিকায় নিয়মিত ছাপা হয়। রাস্তার ওপর আতশবাজি ফুটিয়ে জন্মদিন পালন করা, অতিরিক্ত যন্ত্রাংশ লাগিয়ে বিকট শব্দে গাড়ি বা মোটরসাইকেল চালানোর মহড়া, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা ইত্যাদি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এসব ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছুই করার নেই?

গত এক বছরে নগরে প্রায় ১৬০টি খুন ও অর্ধশতের বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। বেশির ভাগ মামলায় অপরাধী শনাক্ত হয়নি। পুলিশ যদি নিজেদের ব্যর্থতার কারণ খতিয়ে না দেখে, তাহলে ভবিষ্যতে অবস্থার পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]