নেতারা কবে ব্যর্থতা স্বীকার করবেন

ব্যাপারটা হলো, আপনার কৌশল ব্যর্থ হলে বা রাজনৈতিক চাল অচলাবস্থায় পতিত হলে কি আপনাকে গতিপথ পরিবর্তন করতে হবে না? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিল এক মাস আগে, যেটাকে এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতার অবসান বলা যায়। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের অনেকেই ভেবে পাচ্ছেন না, ফিলিস্তিনের রাষ্ট্র ও জনগণের ন্যায্যতা নিশ্চিতকরণে ‘প্যালেস্টাইন অথরিটি’ কেন নিজের অবস্থান পরিবর্তনে বড় ঘোষণা দিচ্ছে না। বিকল্প কৌশলের ব্যাপারে ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের দূরদৃষ্টি না থাকার কারণে তারা একই পথে থাকার ওপর জোর দিয়ে যাচ্ছে, যদিও এর পেছনে আরও কিছু কারণ আছে বৈকি। আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, বিদ্যমান অবস্থা বজায় রাখার পেছনে ক্ষমতাসীনদের স্বার্থ আছে। এই স্থিতাবস্থা বজায় থাকলে শুধু ইসরায়েলই লাভবান হবে না, তার সঙ্গে ফিলিস্তিনের ছোট একটি সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণিও অধিকৃত ভূমিতে একচেটিয়া অর্থনীতি ও ক্ষমতাকাঠামো থেকে লাভবান হবে না।

প্যালেস্টিনিয়ান অথরিটি রাজনৈতিক সমর্থন লাভে মানুষকে ধনসম্পদ করার সুযোগ দিচ্ছে, অথচ জাতীয় স্বার্থ নিশ্চিতকরণে তারা কর্মসূচি দিচ্ছে না। এই লক্ষ্যে তারা বিবদমান গোষ্ঠী ও অনুগতদের মধ্যে সরকারি সম্পদ বণ্টনের যে নীতি গ্রহণ করেছে, তার বদৌলতে এই সুবিধাভোগী ফিলিস্তিনি শ্রেণি লাভবান হচ্ছে। ফলে ক্ষমতাসীন অভিজাতদের পক্ষে বিদ্যমান ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পদের ওপর প্রভুত্ব বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে। আর তাই প্যালেস্টিনিয়ান অথরিটি ও প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) মরিয়া হয়ে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের আলোচনা টিকিয়ে রাখতে চাইছে।

তারা এটা স্বীকার করতে চাইছে না যে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আগেই এই দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেছে। ইসরায়েল কোনো রকম ‘শান্তি প্রক্রিয়ায়’ আগ্রহী নয়। সাধারণভাবে ইসরায়েলের সমাজ জর্ডান উপত্যকা এবং মালে আদুমিন ও অ্যারিয়েলের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্লকে বসতি স্থাপনে আগ্রহী নয়। তারা যেন স্বেচ্ছায় এই জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে, যাতে ভবিষ্যতে সেখানে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গড়ে উঠতে পারে।

বসতি স্থাপনকারীরা বিনা বাধায় ঘরবাড়ি তুলছে, উচ্ছেদ ও ভূমি গ্রাসের গতি কমেনি। ফলে বাস্তবতা এমন দাঁড়িয়ে গেছে যে পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি সংযুক্ত ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন অসম্ভব হয়ে পড়েছে। কিন্তু ডুবন্ত মানুষ যেমন খড়কুটো আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়, তেমনি পিএলও ট্রাম্পের ঘোষণা স্থগিত করে আলোচনা শুরু করতে চায়। তারা এখনো আশা করছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন তার সাহায্যে এগিয়ে আসবে এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেবে। কিন্তু এ ধরনের প্রাণহীন সমাধান তরিকায় ইউনিয়ন সমর্থন দিতে ইচ্ছুক নয়।

এখন শান্তি-প্রক্রিয়ার প্রতি প্যালেস্টিনিয়ান অথরিটির নিরবচ্ছিন্ন সমর্থন থাকা সত্ত্বেও তার ভূমি ইসরায়েলি সরকার দ্রুত আনুষ্ঠানিকভাবে দখলে নেবে না-তা ভাবার কারণ নেই। সম্প্রতি ইসরায়েলের সংসদে যেসব আইন পাস হয়েছে তার আলোকে এটা হতে পারে। আর আন্তর্জাতিক সমর্থন যদি না পাওয়া যায় এবং আলোচনা চালিয়ে যাওয়া নিরর্থক হয়, তাহলে প্যালেস্টিনিয়ান অথরিটির (পিএ) উচিত হবে তার কৌশলগত ব্যর্থতা মেনে নেওয়া। ফিলিস্তিনি নেতৃত্বকে এখন জনগণের সামনে সাফসুতরা হতে হবে। ‘হ্যাঁ, আমরা ব্যর্থ হয়েছি’-ফিলিস্তিনের অনেক মানুষ এখন এ কথাটি শুনতে চায়। সেটা ঘটার জন্য বাতিল নেতৃত্বকে সরে দাঁড়াতে হবে। এই মুহূর্তে একগুঁয়েমি ও আত্মনিষ্ঠা কাম্য নয়। ইসরায়েল অনেক দিন ধরেই ফিলিস্তিনকে নিরাশ করে যাচ্ছে। আর ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব যেন একই সময়ে আলোচনার অস্ত্র নিঃশেষ করে দিয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘আপস’।

ইতিহাসের এই ক্রান্তিলগ্নে ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের অখণ্ড সততা আমাদের তেমন একটা আশার আলো দেখাবে না। তবে সমাধান খোঁজায় এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক কৌশল প্রণয়নে এটি আমাদের সহায়তা করতে পারে। আর ফিলিস্তিনি নাগরিকদের দাবি করতে হবে, নেতারা যেন কৌশলে হঠাৎ ও নাটকীয় পরিবর্তন নিয়ে আসেন। জনগণকে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত করতে হবে। সম্ভবত এর জন্য পুরোনো এক কাউন্সিলের পুনরুত্থান ঘটাতে হবে, যেটি দেশে ও দেশের বাইরে সমগ্র ফিলিস্তিনি জনতার প্রতিনিধিত্ব করতে পারে।

১৯৯৮ সালে লিখিত এক প্রবন্ধে এডওয়ার্ড সাইদ দুঃখ নিয়ে বলেছিলেন, ‘যতক্ষণ আমরা সমালোচনার অস্ত্রে বলীয়ান বা নিবেদিতপ্রাণ চেতনার অধিকারী হচ্ছি না, ততক্ষণ আমরা নিজেদের অধিকার, ইতিহাস ও ভবিষ্যতের জন্য লড়াই করতে পারি না।’ কথা হলো, অধিকৃত ফিলিস্তিনে বসবাসরত মানুষের পক্ষে পরিস্থিতি অসহনীয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু নিজের প্রতি সৎ না হলে এবং আত্মসমালোচনা না করলে ফিলিস্তিনিরা পূর্ণ শক্তি নিয়ে এই দখলদারির বিরুদ্ধে নামতে পারবে না। সেটা হলেই কেবল আমরা দখলদারি প্রতিরোধ এবং তা পরাজিত করতে নতুন কৌশল প্রণয়ন করতে পারব।

অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, আল-জাজিরা থেকে নেওয়া।

জালাল আবুখাতের: ডানডি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাজনীতির অধ্যাপক।