প্রচলিত আইনে ভূমি সমস্যার সমাধান চাই

পার্বত্য এলাকার দুর্গম অঞ্চলের একমাত্র বাতিঘর হলো ইউনিসেফ পরিচালিত পাড়াকেন্দ্রগুলো। দুর্গম পাহাড়ে যেখানে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার আধুনিক সুযোগ-সুবিধার আলো পৌঁছায় না, সেখানে এ পাড়াকেন্দ্রগুলোর মাধ্যমেই পাহাড়ের সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক মানুষেরা, বিশেষ করে নারী ও শিশুরা বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও শিক্ষার পাঠ গ্রহণ করে থাকে। তাই পাড়াকেন্দ্র নামক এ বাতিঘরই পাহাড়ে বেঁচে থাকার ন্যূনতম সুযোগকে মিটমিট করে জ্বালিয়ে রেখেছে। অন্ধকারাচ্ছন্ন পাহাড়ে জোনাকি পোকারা যেমন আলোর দিশা দেখায়, তেমনি পাড়া কর্মীরা বাংলা না জানা পাহাড়ি শিশুদের বিভিন্ন উপকরণ ও ছবির মাধ্যমে তাদের অক্ষরজ্ঞানের হাতেখড়ি দেন এবং নারীদের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা ও সচেতনতা সৃষ্টি করেন। পাড়া কর্মীদের ভাতা খুবই সামান্য। তবু পাড়া কর্মীরা একাগ্র মনে তাঁদের সেবা প্রদান করে যাচ্ছেন সেই ১৯৮০ সাল থেকে। উল্লেখ্য, ১৯৮০ সাল থেকে ইউনিসেফের সহায়তায় বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে ইন্টিগ্রেটেড কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (আইসিডিপি) চালু করেছে।

২১ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী রাজধানী থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে পাহাড়ের ৪০০০ তম পাড়াকেন্দ্রের উদ্বোধন করেন। এ অনুষ্ঠানে পাহাড় থেকে দুই শতাধিক পাড়া কর্মীকে ঢাকায় আনা হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী আবারও পার্বত্য চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। একই সঙ্গে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমির মালিকানা স্থানীয় জনগণের কাছেই থাকবে বলে আশ্বস্ত করেছেন। তিনি ভূমি কমিশনের নানা সমস্যার কথাও উল্লেখ করেন।

আমরা পেছনে ফিরে তাকালে দেখতে পাই, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন-২০০১-এর বিরোধাত্মক ধারা সংশোধনীর জন্যই সময় লেগেছিল ১৬ বছর। এরপর বহু ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে ২০১৬ সালের ১ আগস্ট মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর ৯ আগস্ট জাতীয় সংসদে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধনী) আইন-২০১৬’ আইনটি পাস করা হয়। আইনটি পাস হলেও এর বিধিমালা প্রণয়নের কাজ কত দূর, সেটি আমরা জানি না। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী স্থানীয়দের ভূমির মালিকানা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে ঔপনিবেশিক আইন সংশোধন করে নতুন আইন করার কথাও বলেছেন। আমাদের কথা হলো, ভূমির মালিকানা নিশ্চিত করতে আইন সংশোধন বা নতুন আইন প্রণয়নের প্রয়োজন নেই। পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য প্রযোজ্য ও প্রচলিত যে আইনগুলো [যথা পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০, পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ইত্যাদি] আছে, সেগুলো যথাযথভাবে প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করলেই পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যার সমাধান অনেকখানি এগিয়ে যাবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য বর্ডার গার্ডের বিওপি তৈরি হচ্ছে। দেশের যেকোনো সীমান্তকে সুরক্ষিত রাখতে বিজিবির বিওপি স্থাপন সরকার করতেই পারে। কিন্তু প্রশ্ন জাগে তখন, যখন আন্তর্জাতিক সীমানা থেকে যথেষ্ট দূরে হওয়া সত্ত্বেও নিরাপত্তার নামে দীঘিনালার বাবুছড়ায় জনবসতিপূর্ণ স্থানে বিজিবির দপ্তর স্থাপন করার সিদ্ধান্ত হয়। পাহাড়ের নিরাপত্তাব্যবস্থা তখনই প্রশ্নবিদ্ধ হয়, যখন দেখা যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও লংগদু, বগাছড়ি, বাঘাইছড়ি, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, তাইন্দংয়ের মতো ঘটনায় পাহাড়িদের গ্রাম আগুনে পুড়ে যায়, কলেজছাত্র রমেল চাকমাদের যখন পিটিয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়, স্কুলছাত্রী তুমাচিং মারমারা যখন বাড়ির পাশে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়, মিঠুন চাকমাদের যখন দিনদুপুরে গুলি করে হত্যা করা হয়। অথবা বিলাইছড়ির দুর্গম ফারুয়ার মতো জায়গায় মারমা কিশোরী যখন ধর্ষণের শিকার হয়, তখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, এই নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাব্যবস্থা পাহাড়িদের কতটা নিরাপত্তা দেবে?
বিশ বছর ধরে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের আশ্বাসের কথা শুনতে শুনতে পাহাড়ের মানুষেরা আর কোনো আশ্বাসে ভরসা খুঁজে পায় না। চুক্তির পরও একের পর এক সাম্প্রদায়িক হামলা, বিনা উসকানিতে নারীদের মিছিলে হামলা, নারী-শিশু নির্যাতন ও হত্যা বেড়ে যাওয়া, সভা-সমাবেশের ওপর প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা, জেল-জুলুম, মিথ্যা মামলা-এসব পরিস্থিতির মধ্যে পাহাড়ের মানুষের মনে আস্থার জায়গাটি ক্রমে সংকীর্ণ হয়ে আসে।

প্রধানমন্ত্রী এই অনুষ্ঠানে আরেকটি সত্য কথা স্বীকার করেছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সামরিক শাসকেরা পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে আরও প্রকট করে তুলেছিলেন। ‘সমতল ভূমি থেকে বিভিন্ন লোককে নিয়ে ওখানে বসতি করা শুরু করে দেয়। তাদের ক্যাম্পে রাখা হয় এবং সেখানে সংঘাতটা আরও উসকে দেওয়া হয়।’ [সূত্র: বিডিনিউজ]। কাজেই প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য থেকেই এটি স্পষ্ট হয়েছে যে প্রকৃতপক্ষে সেখানে কারা স্থানীয় ও স্থায়ী বাসিন্দা আর কারা বহিরাগত বসতি স্থাপনকারী। আমাদেরও দীর্ঘদিনের দাবি, যাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সমতল থেকে পাহাড়ে নিয়ে বসতি স্থাপন করা হয়েছে এবং সমস্যাকে প্রকট করে তোলা হয়েছে, তাদের যেন সম্মানজনকভাবে সমতলে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়।

কেবল নিরাপত্তা আর উন্নয়ন বাড়ালেই কোনো এলাকার সার্বিক উন্নয়ন-নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। এ জন্য প্রয়োজন আস্থা, বিশ্বাস, আন্তরিকতা, সম্প্রীতি আর অন্য সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। আমরা যদি একটু পাহাড়ের উন্নয়নের দিকে তাকাই, তাহলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে সাজেক, চিম্বুক, রুমা-থানচি কিংবা বগা লেকের পর্যটনের চাকচিক্যের আড়ালে জুমে খেটে খাওয়া গরিব অথচ নির্মল মানুষগুলোর রোদে পোড়া মুখগুলো। উন্নয়নের জোয়ারে গাড়ি চলার রাস্তা যখনই তাদের ঘরের দুয়ারে পৌঁছেছে, তখনই তারা তাদের ‘আমিত্ব’কে হারিয়ে ফেলেছে। জোড়াতালি লাগানো পরনের কাপড়ের মধ্যেও যে সুখ এত দিন লুকিয়ে ছিল, শহুরে নতুন কম্বলের ঘ্রাণ তাদের সেই সুখ চিরতরে কেড়ে নিয়েছে।

তাই পরিশেষে বলতে চাই, উন্নয়নই পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী সমাধানের কোনো পথ নয়। সরকার অবগত আছে যে পাহাড়ের সমস্যাটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। তাই রাজনৈতিকভাবেই এর সমাধানে পৌঁছাতে হবে। ২০ বছর আগে যে শান্তির লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ সরকার চুক্তিটি করেছিল, সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে শুধু কথায় নয়, আন্তরিকতা নিয়ে চুক্তি বাস্তবায়নের কাজকে দ্রুত এগিয়ে নিতে হবে। একই সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য প্রচলিত ও প্রযোজ্য আইনগুলোর যথাযথ প্রয়োগ করে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনকে কার্যকর করে তুলতে হবে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দাদের নিজ নিজ ভূমি ফিরিয়ে দিতে হবে।

ইলিরা দেওয়ান: হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক।
[email protected]