হুমকির মুখে গণতন্ত্র

আলোর পাশেই অন্ধকার৷ বৈষম্যপূর্ণ ভারতীয় সমাজের চিত্র
আলোর পাশেই অন্ধকার৷ বৈষম্যপূর্ণ ভারতীয় সমাজের চিত্র

ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি হিন্দুজা ভাইদের ব্রিটেনের কোটিপতিদের তালিকায় শীর্ষ দশে উঠে আসাকে ভারতের মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলো অতি গুরুত্বসহকারে প্রচার করেছে বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন। তাঁদের ব্যবসা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। অথচ এই সংবাদমাধ্যমগুলো ভারতের সমাজে ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য ও আয়বৈষম্য নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাচ্ছে না।
ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্য এখন দুনিয়াজুড়ে অর্থনীতিবিদদের আলোচনার মূল বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিক কালের গবেষণায় দেখা গেছে, সব শিল্পায়িত দেশ (অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) ও উঠতি দেশ যেমন চীন ও ভারতে আয়বৈষম্য ক্রমেই বাড়ছে। গত এক দশকে এশিয়ার ১২টি উন্নয়নশীল দেশে আয়বৈষম্য বেড়েছে। এশিয়ার ৮০ ভাগ মানুষের বসবাস এই অঞ্চলে।
১৯৯১–পরবর্তীকালে ভারতের রেকর্ড লজ্জাকর। ওইসিডি বলছে, ভারতে আয়বৈষম্য গত দুই দশকে দ্বিগুণ হারে বেড়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে এটা সর্বোচ্চ। বর্তমানে ভারতের শীর্ষ ১০ ভাগ উপার্জনকারী মানুষের আয় সর্বনিম্ন ১০ ভাগ উপার্জনকারী মানুষের তুলনায় ১২ গুণ বেশি, ১৯৯০-এর দশকে এটা ছিল ছয় গুণ।
এমনকি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) সতর্ক করে দিয়েছে, এই আয়বৈষম্যের ফল ভালো হবে না। আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টিন ল্যাগার্ড বলেছেন, ভারতে কোটিপতি মানুষের মোট আয় গত ১৫ বছরে ১২ গুণ বেড়েছে। এটা দিয়ে এ দেশের চরম দারিদ্র্য দুবার দূর করা যায়। ভারতের স্যাম্পল সার্ভের তথ্যেও বিষয়টি উঠে এসেছে।
এসব প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ায় ‘চুইয়ে পড়া’ তত্ত্ব খারিজ হয়ে যায়। যে তত্ত্ব বলে, ধনীদের কাছ থেকে ছিটেফোঁটা পেয়েই দরিদ্র মানুষের জীবনমান উন্নত হবে।
গত দুই দশকে ভারতে এমনটা হয়নি, অথচ এ দুই দশকেই ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ছিল সবচেয়ে বেশি। থমাস পিকেটির সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থ ক্যাপিটাল ইন দ্য টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরিতে এ তত্ত্বের তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক সমালোচনা করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের গবেষক ও অর্থনীতিবিদ ব্রানকো মিলানোভিচ এ বইকে ‘অর্থনৈতিক চিন্তায় একটি যুগান্তকারী গ্রন্থ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। প্যারিস স্কুল অব ইকোনমিকসের অধ্যাপক পিকেটি গবেষণা করে দেখিয়েছেন, ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্য মুক্তবাজার অর্থনীতির অবশ্যম্ভাবী পরিণতি।
পুঁজি বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ উৎপাদন বৃদ্ধির হারকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। কারণ, যেসব মানুষের শ্রম ছাড়া অন্য কোনো পুঁজি নেই, সেই সব মানুষের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে বসে আছেন উদ্যোক্তারা।
ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকে বোঝা যায়, বাজারের যেভাবে কাজ করার কথা, তা ঠিক সেভাবেই করছে। ‘বাজারের ত্রুটি–বিচ্যুতির সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই’। বাজারব্যবস্থা যত ত্রুটিহীন হবে, পুঁজি বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশও প্রবৃদ্ধির হারের চেয়ে তত বেশি হবে। পিকেটি বলেন, এই প্রবণতা ১৯১৪ থেকে ১৯৭৪ সময়কালে কিছুটা হ্রাস পেয়েছিল। অসমতা কমেছিল, তবে সেটা পুঁজিবাদের কারণে নয়। দুটি বিশ্বযুদ্ধ, মহামন্দা, পুঁজির আক্ষরিক

ধ্বংসসাধন, বিশ্বযুদ্ধের খরচ মেটাতে করের উচ্চহার, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, কেইনসীয় কল্যাণমূলক রাষ্ট্রনীতি ও শক্তিশালী শ্রমিক আন্দোলনের কারণে এ সময়ে মজুরি বেড়েছিল। জন কেনেথ গলব্রেইথের মতে, এ সময়ে একধরনের ‘ক্ষমতার ভারসাম্য’ দেখা গেছে। এর ভিত্তি ছিল এক ‘নতুন বণ্টনব্যবস্থা’ ধাঁচের নীতিগত ঐক্য। এই নীতি ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্যের রাশ টেনে ধরে। কিন্তু এটার পুনরাবৃত্তি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
বাজার–মৌলবাদী থ্যাচার-রিগ্যানের প্রতিবিপ্লবের আঘাতে এই ‘ক্ষমতার ভারসাম্য’ নীতির অপমৃত্যু হয়। ১৯৮০-র দশক থেকেই পুঁজি বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশের হার বাড়তে থাকে, একই সঙ্গে বৈষম্যও বাড়তে থাকে। এই শতকের প্রথম দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিরাজমান বৈষম্যের অবস্থা সে দেশে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগের চরম বৈষম্যের চেয়েও বেশি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি ১৯৭০-এর দশকে এসে স্থবির হয়ে যায়। কিন্তু শীর্ষ ১ শতাংশ মানুষের আয় বেড়েছে ১৬৫ শতাংশ আর শীর্ষ শূন্য দশমিক ১ শতাংশ মানুষের আয় বেড়েছে ৩৬২ শতাংশ। করের সর্বোচ্চ প্রান্তিক হার অর্ধেক কমে ৩৫ শতাংশ হয়েছে।
এই ন্যায়ভ্রষ্ট আয় বিতরণব্যবস্থা দুনিয়াজুড়েই ছড়িয়ে পড়েছে। লাগার্ড বলেছেন, বিশ্বের প্রতি ১০ জনের সাতজন যেসব দেশে বাস করে,
সেখানে গত তিন দশকে বৈষম্য বেড়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ৮৫ জনের সম্পদের পরিমাণ দুনিয়ার তাবৎ দরিদ্র মানুষের নিচের অর্ধেকের সম্পদের সমান।
করব্যবস্থার অপমৃত্যু হলে ধনীদের জন্য তা পোয়াবারো। সে কারণে পিকেটি বলেছেন, বিশ্বব্যাপী সম্পদের ওপর ক্রমবর্ধমান হারে করারোপ করা উচিত। মানে যাঁর সম্পদ যত বেশি, তাঁর কর তত বেশি। এতে যেখানে কর কম, সেখানে পুঁজি স্থানান্তর বন্ধ করা যাবে, সম্পদের কেন্দ্রীভবনও থামানো যাবে। এর জন্য রাষ্ট্রীয় নীতি থাকা প্রয়োজন, কিন্তু রাষ্ট্রই যে এসব ধনী অভিজাতের হাতে বন্দী!
পিকেটির এই সম্পদ–করের ব্যবস্থাপত্রকে ‘অবাস্তব’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সম্পদের কেন্দ্রীভবন কীভাবে থামানো যায়, তা নিয়ে ব্যাপক তর্ক-বিতর্কও চলছে। এটা নাকি একধরনের বর্জনমুখী অর্থনীতি। এটা মানবীয় ক্ষমতার রাশ টেনে ধরে, যা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। ক্রমবর্ধমান বৈষম্য সামাজিকভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত। পরিণামে প্রবৃদ্ধির ধরন ব্যাহত হয় এবং গতি হ্রাস পায়। এর ধারাও অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।
ভারতে আয়বৈষম্য অশ্লীলতার পর্যায়ে চলে গেছে—এ বিতর্ক থেকে ভারতের কিছু শিক্ষা নেওয়া উচিত। ভারতের শীর্ষ ১০ ভাগের এক ভাগ উপার্জনকারী ব্যক্তিদের আয় সে দেশের মধ্য আয়ের মানুষের শীর্ষ ১০ ভাগের ১ ভাগের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি। ভারতের এই বৈষম্যের কারণ হচ্ছে সম্পদের একচোখা বিতরণ—পুঁজি, ভূমিসহ সীমিত পরিসরে শিক্ষার অধিকার ও কর্মসংস্থানের গতি কম হওয়া। ভারত খুব দ্রুতই একটি অন্যায্য সমাজে পরিণত হতে যাচ্ছে৷ যেখানে ‘ধনীরাই সবকিছু নিয়ে যায়’, সেখানে একজন ব্যক্তির শ্রমের চেয়ে তাঁর শ্রেণি ও বর্ণই বিবেচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গণতন্ত্রের জন্য তা এক অশনিসংকেত।
সামাজিক একতা ও অন্তর্ভুক্তিকরণ ছাড়া গণতন্ত্র নিয়ম রক্ষার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। একতার কিছু উপাদান সমাজে থাকা উচিত। সুষম গণতন্ত্রের জন্য সম্মিলিত জাতীয় প্রকল্পে সব নাগরিকের সমান মালিকানার বোধ থাকতে হবে।
জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূচক। কিন্তু অগ্রগতির সেটাই একমাত্র সূচক নয়। ভারত যদি প্রকৃত অর্থে এগোতে চায়, তাহলে ভূমিসহ সব ধরনের সম্পদের বৈপ্লবিক পুনর্বণ্টন করতে হবে; স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, খাদ্যনিরাপত্তা ও সামাজিক সুরক্ষার বিধান করতে হবে।
ভারতে আয়বৈষম্য যে পর্যায়ে গেছে, তাতে মজুরি অবশ্যই বাড়াতে হবে, ধনীদের ওপর আরও করারোপ করতে হবে। ধনীদের মুনাফা ও নির্বাহীদের আয়ের সীমা নির্ধারণ করে দিতে হবে। আর এটা করতে হলে নয়া উদারনৈতিক নীতি পরিহার করতে হবে।
দ্য ডেইলি স্টার থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
প্রফুল বিদওয়াই: ভারতীয় কলাম লেখক।