অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না

আসিয়ানের রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদি
আসিয়ানের রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদি

নিজের পিঠ যদি নিজেকেই চাপড়াতে হয়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে তাহলে এই জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয়ার্ধ চমৎকার একটা সময়। এই সময়েই সুইজারল্যান্ডের দাভোসে গিয়ে তিনি ভারতের অর্থনীতির ছবি সুন্দরভাবে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছেন। ফিরে এসেই আশিয়ান সদস্যভুক্ত ১০ দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সঙ্গে সম্পর্কের রজতজয়ন্তী বর্ষ উদ্যাপনের স্মারক শীর্ষ বৈঠক সেরেছেন। ভারতের ৬৯ তম প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে ওই ১০ জনকে একযোগে প্রধান অতিথির মর্যাদা দিয়ে কূটনীতির আঙিনায় অন্য এক ধরনের দাগ তিনি কাটতে পারলেন। শুধু কি তাই? উপলক্ষকে উজ্জ্বল করে তুলতে ওই ১০ দেশের মোট ২৭টি খবরের কাগজ তাদের উপসম্পাদকীয়তে একই দিনে ছাপল নরেন্দ্র মোদির লেখা নিবন্ধ। আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের চিরকালীন সুসম্পর্কের কথা তুলে ধরে সেই নিবন্ধে মোদি লিখেছেন, ‘সূর্যোদয় দেখার জন্য ভারতীয়রা চিরকাল পূর্ব দিকে তাকাতে অভ্যস্ত।’

ভারি সুন্দর এই কথাটা। সূর্যোদয়ের জন্য পুবে তাকানোর এই উপমাটা। সেই নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাও ভারতের ‘লুক ইস্ট’ নীতি গ্রহণ করেছিলেন। চার বছর আগে ক্ষমতায় এসে নরেন্দ্র মোদি ‘লুক ইস্ট’ নীতিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতি গ্রহণ করেন। বাণিজ্য তো বটেই, কূটনৈতিক দিক থেকেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশগুলো ভারতের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ঐতিহাসিকভাবে ভারতের কাছাকাছি হলেও এই দেশগুলোর ওপর চীনের প্রভাব দিন দিন বেড়ে গেছে। চীনই ভারতের প্রধান অঘোষিত প্রতিপক্ষ। বড় মুখ করে না বললেও ভারতের কোনো রাজনৈতিক নেতা অথবা কূটনীতিক এই সত্য অস্বীকার করতে পারবেন না। আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোতে সামুদ্রিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতার মাধ্যমে নিজেদের প্রভাব বাড়াতে মোদির ভারত এই প্রথম উঠেপড়ে নামল। অবশ্যই এটা এক ইতিবাচক পদক্ষেপ।

আসিয়ানের ১০ দেশের যৌথ বার্ষিক আয় (২ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার) মোটামুটিভাবে ভারতের সমান। এই ১০ দেশের সঙ্গে ভারতের বার্ষিক বাণিজ্য প্রায় ততটাই, যতটা চীনের সঙ্গে ভারতের। ৭০ বিলিয়ন ডলারের মতো। কিন্তু ফারাকটা অন্য জায়গায়। চীনের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ৫০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। ভারতে চীন তাদের পণ্যের প্লাবন ঘটিয়ে দিলেও তাদের দেশের বাজার ভারতের কাছে খুলছে না। হরেক রকমের অশুল্ক বাধা খাড়া করে ভারতের বাণিজ্যিক পরিধি ঠেকিয়ে রেখেছে। সেই তুলনায় আসিয়ানভুক্ত ১০ দেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি মাত্র ১৪ বিলিয়ন ডলার। বিনিয়োগের জন্যও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া উত্তম এলাকা। মোদির বড় সাধের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্প বাস্তবায়িত করতে এই দেশগুলো সহায়ক হতে পারে। সিঙ্গাপুর যে কাজটা শুরু করেছে, সেই কাজে বাকি নয় দেশও পা মেলাতে পারে। আজ অথবা কাল।

কিন্তু এগুলো নয়। এই সময়কালে নরেন্দ্র মোদি এমন একটা কাজ করে ফেলেছেন, যা নিতান্তই ‘অ-মোদিচিত’, যে কাজ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গত চার বছরে তিনি করেননি। দেশের দু-দুটো টেলিভিশন চ্যানেলে নরেন্দ্র মোদি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়ে ফেলেছেন! তাতে তাঁর ‘মোদিত্বর’ হানি হলো কি না, সেই বিতর্ক অবশ্য সৃষ্টি হয়নি। যদিও বিস্ময়ের জন্ম হয়েছে অঢেল!

প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মোদি অনেক প্রথা বাতিল করে দেন। এই প্রথাগুলোর একটা ছিল বিদেশ যাত্রায় সাংবাদিকদের সফরসঙ্গী না করা। দেশের প্রধানমন্ত্রী বিদেশ সফরে গেলে সেই বিমানে বাছাই করা সংবাদপত্রের সাংবাদিকদের নিয়ে যাওয়ার একটা রেওয়াজ তৈরি হয়েছিল। যাওয়া-আসাটা বিনে পয়সায় হয়ে যেত। বিদেশে থাকা ও খাওয়া খরচ দিতে হতো সাংবাদিকদের। যাওয়া-আসার মাঝে উড়ন্ত বিমানে প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে মিলিত হতেন। সংবাদ সম্মেলন হতো। অনেক প্রশ্ন, অনেক উত্তর, অনেক ব্যাখ্যা অপেক্ষায় থাকত। এটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল একটা রীতি।

সংবাদ সম্মেলন হতো অন্যভাবেও। বছরে এক-আধবার। সাংবাদিকদের অধিকার ছিল যেমন খুশি প্রশ্ন করার। কিন্তু প্রথম রাতে বিড়াল মারার মতো মোদি সেই সব রীতি খান খান করে ভেঙে দিলেন! কালেভদ্রে দু-একটা টিভি চ্যানেলকে এই চার বছরে ইন্টারভিউ তিনি যে দেননি তা নন। কিন্তু সাংবাদিকদের মঞ্চে এসে তাঁদের মুখোমুখি হওয়ার প্রথার ধারকাছ দিয়েও তিনি হাঁটেননি। কেন হাঁটেননি, কিসের আড়ষ্টতা, তার ব্যাখ্যাও কখনো দেননি! যেমন এবারেও বললেন না, হঠাৎ কেন নিজের তৈরি করা রীতি ভেঙে দাভোস যাত্রার আগে প্রায় একই সঙ্গে দু-দুটো টিভি চ্যানেলকে সাক্ষাৎকার দিলেন!

সেই সাক্ষাৎকারের প্রশ্নাবলির ঢংই বুঝিয়ে দেয় সাংবাদিকদের ‘অ্যাজেন্ডা’ কী ছিল এবং কেনই বা মোদি তাঁদের মুখোমুখি হতে রাজি হলেন। অন্য মিডিয়ায় এ নিয়ে কম ঠাট্টা-তামাশা-কৌতুক চলছে না। একজন তো এক নারী সাংবাদিককে ‘চিয়ারলিডার’ আখ্যা দিয়েছেন। সেই নারীর করা একটা প্রশ্ন ছিল এ রকম, ‘একটা নির্দিষ্ট সমালোচনা, বিরোধীরাই এই সমালোচনায় সরব, তারা বলছে আপনি গব্বর সিং ট্যাক্স (জিএসটি) চালু করেছেন, বেকারি বেড়ে চলেছে হু হু করে, আপনার সরকার চাকরি সৃষ্টি করতে পারছে না, কৃষিক্ষেত্র ধুঁকছে, চাষি মারা যাচ্ছেন। এই সমালোচকদের উদ্দেশে আপনি কী বলবেন?’ আর একটা নমুনা, ‘খুনখারাবির ভয় দেখানো হচ্ছে। এমনকি আপনার পরিবার সম্পর্কে অশালীন সব মন্তব্য করা হচ্ছে। কী বলবেন এসব মানুষকে?’ একজন জনপ্রিয় সাংবাদিক প্রশ্ন তুলেছেন এক পুরুষ সাংবাদিকের ‘নৈতিক চরিত্র’ নিয়ে। তোলাবাজির অভিযোগ উঠেছিল সেই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে। মামলাও। সেই প্রশ্নবিদ্ধ সাংবাদিক, যাঁর চ্যানেলের মালিক বর্তমানে শাসক দল বিজেপির সাংসদ, প্রধানমন্ত্রীকে তিনি প্রশ্নের ছলে মনে করিয়ে দিলেন, ‘আজকের দিনের নতুন ওয়ার্ল্ড অর্ডারের সংক্ষেপিত নাম পিটিএম! পুতিন, ট্রাম্প, মোদি!’ প্রধানমন্ত্রীকে করা তাঁর প্রশ্নে বিস্ময়ও ঝরেছে শ্রাবণের অবিরাম বারিধারার মতো! ‘কূটনীতিকে আপনি কোথায় নিয়ে গেছেন! বিশ্বনেতাদের আপনি বুকে জড়াচ্ছেন! তাঁদের কাঁধে হাত রাখছেন! এই যেমন নেতানিয়াহু। তাঁর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক তো অনন্তকালের নয়, অথচ দেখে মনে হচ্ছে যেন কত কালের পুরোনো সম্পর্কের একটা সিনেমা দেখছি! এত সহজে এতখানি সাবলীলভাবে বিশ্বনেতাদের সঙ্গে কী করে মেলামেশা করেন?’

প্রশ্নের রকমসকম এবং প্রধানমন্ত্রীর উত্তর (কার পাশে দাঁড়াচ্ছি সেটা বড় কথা নয়, কোনো মুহূর্তেই আমি ভুলতে পারি না আমার মুখের পানে দেশের সোয়া শ কোটি মানুষ তাকিয়ে আছে, কিংবা কত কথাই না আমায় শুনতে হচ্ছে, আমি চাই ঈশ্বর যেন সেই সব কথা আমায় স্মরণ করিয়ে না দেন, প্রার্থনা করি ভগবান ওঁদের শুভবুদ্ধি দিন, অথবা নরেন্দ্র মোদিকে শেষ করে দেওয়ার কত চেষ্টাই না বিরোধীরা করেছেন, ওঁদের প্রতি আমার শুভেচ্ছা রইল) দেখেশুনে সাংবাদিক মহলের কেউ কেউ চুপ থাকতে পারেনি। একজন লিখেছেন, ‘প্রশ্ন শুনে আমার মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হচ্ছিল। এই কিনা এ দেশের চতুর্থ স্তম্ভ!’ আর একজন লিখেছেন, ‘প্রশ্নগুলো ঠিক যেন অনুরোধের মতো শোনাচ্ছিল। অভিজ্ঞ সাংবাদিকদের চোখে-মুখে ঝরছিল শিশুসুলভ বিস্ময় ও প্রগলভা। এভাবেই কি প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করতে হয়?’

নরেন্দ্র মোদি সাক্ষাৎকারের জন্য সময় পাচ্ছেন। ভোট আসতে সময় যে আর বেশি নেই। এসব সাক্ষাৎকার ক্রমেই হয়ে উঠবে তাঁর নির্বাচনী ইশতেহার। কঠিন ও অনুসন্ধানী প্রশ্ন না করা এসব সাক্ষাৎকারের প্রধান শর্ত, যাতে সরকার ও তাঁর সাফল্য সাতকাহন করে তুলে ধরা যায়।

নরেন্দ্র মোদি নির্ভাবনায় আছেন। কেননা বাছাই করা প্রশ্নকর্তারা কেউই এ প্রশ্ন তাঁকে করবেন না, কেন ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ থেকে মুসলমান, দলিত ও অনগ্রসররা বাদ যাচ্ছেন, কেন তাঁর আমলে বিভাজনটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে গ্রাম বনাম শহরে, শিল্প বনাম কৃষিতে, হিন্দু বনাম মুসলমানে। কেন বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলো পদ্মাবতকে কেন্দ্র করে হিংস্র হয়ে ওঠে, ভোটে জেতার ক্ষুদ্র মানসিকতার রাজনীতি থামাতে কেন তিনি নীরব, এসব প্রশ্ন তাঁকে কখনো বিদ্ধ করবে না তিনি জানেন। রাজপুত আত্মগরিমার স্বার্থে করণি সেনাপ্রধান লোকেন্দ্র সিং কালভি ভারতের রাজপুত সেনানীদের প্রতিবাদে শামিল হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী হয়েও কেন তিনি কালভিকে জেলে ঢোকালেন না, এই প্রশ্নও কেউ যে তাঁকে করবেন না বিলক্ষণ জানেন তা-ও। করবেন না, কারণ সেই প্রশ্ন করার সুযোগ মোদি তাঁদের কখনো দেবেন না।

নিজের পিঠ নরেন্দ্র মোদি চাপড়াতেই পারেন। সেই অধিকার আরও পাঁচজনের মতো তাঁরও রয়েছে। তাঁর শুধু এটুকু জানা প্রয়োজন, অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না।

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।