খুব বেশি মানুষ ফিরবে না

বিল রিচার্ডসন
বিল রিচার্ডসন

গত দুই মাস রাখাইন রাজ্যের দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিরসনে গঠিত এক আন্তর্জাতিক প্যানেলে আমি কাজ করেছি, যার লক্ষ্য ছিল মিয়ানমার সরকারকে এ বিষয়ে এক যুক্তিসংগত ও ন্যায্য নীতি প্রণয়নে সাহায্য করা। কিন্তু এ সপ্তাহে আমি পদত্যাগ করেছি। কারণটা হলো এই অঞ্চল ও দেশের গুরুতর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এই প্যানেলের সামর্থ্য কতটুকু, তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।

অং সান সু চিই মূলত মিয়ানমারের নেতা, কিন্তু তিনি একদিকে যেমন বিচ্ছিন্ন, তেমনি অন্যদিকে গঠনমূলক সমালোচনা তিনি নিতে চান না। তাঁর সরকার তাড়াহুড়ো করে সবকিছু করতে চায়। সঠিকভাবে কিছু করার চেয়ে তারা তাড়াহুড়ো করতেই বেশি আগ্রহী। মিয়ানমার সরকার যদি সংকট আরও ঘনীভূত হতে দিতে না চায় বা আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করতে চায়, তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে নাটকীয় কিছু ঘটাতে হবে। মিয়ানমারের বর্তমান মনোভঙ্গি বজায় থাকলে সহিংসতার চক্র আরও দীর্ঘায়ত হবে এবং শান্তি ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আশা ধূলিসাৎ হবে। একই সঙ্গে বৃহত্তর অর্থে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার আশাও দূরীভূত হবে।

নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, রাখাইন প্রদেশে মিয়ানমার এক ভয়াবহ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। এক নতুন মুসলিম জঙ্গিগোষ্ঠী মিয়ানমারের পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ওপর সমন্বিত হামলা চালালে দেশটির সেনাবাহিনী এক দীর্ঘ ও নৃশংস অভিযান শুরু করে। এই প্রক্রিয়ায় গত ১৫ মাসে আট লাখ মানুষকে তারা বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে। রাখাইন প্রদেশে মুসলমান ও বৌদ্ধদের মধ্যে যে গভীর অবিশ্বাসের সম্পর্ক, তা আরও ঘনীভূত হয়েছে। তেমনি সরকারের সঙ্গে তাদের সম্পর্কেও অনাস্থা বেড়েছে। সংখ্যালঘু গোষ্ঠী, বিশেষ করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্টভাবে বৈষম্যের নীতি এখনো জারি আছে। বড় বড় মাদক ও মানব পাচারকারী গোষ্ঠী এখনো এই অঞ্চলটা ছিঁড়েখুঁড়ে খাচ্ছে। আর স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অর্থনীতিতে অনেক দিন ধরেই যে অপর্যাপ্ত বিনিয়োগ হচ্ছে তাতে সমস্যা আরও ঘনীভূত হয়েছে।

আবার এসব সমস্যা মোকাবিলায় মিয়ানমার যেসব প্রচেষ্টা নিয়েছে, তা যথোপযুক্ত না হওয়ায় সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। কফি আনানের নেতৃত্বাধীন রাখাইন অ্যাডভাইজরি কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এই সমস্যা মোকাবিলার রূপরেখা দেওয়া হলেও দেশটির সরকার এখন পর্যন্ত রাখাইনের জন্য সুস্পষ্ট কৌশল প্রণয়ন করতে পারেনি। সরকার শুধু ফল চায়, তার প্রভাব কেমন হবে, সেটা নিয়ে তারা ভাবিত নয়। তারা দ্রুততার সঙ্গে সবকিছু করে পৃথিবীকে দেখাতে চায়; তারা এমন কোনো প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে চায় না, যার মাধ্যমে আস্থা ও আত্মবিশ্বাস তৈরি করা সম্ভব। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অং সান সু চির নৈতিক নেতৃত্ব না থাকায় ব্যাপারটা আরও সমস্যাজনক হয়ে উঠছে, যে রাজনীতি ক্রমে জাতীয়তাবাদী, মুসলিমবিরোধী ও পরিবর্তনবিমুখ হয়ে উঠছে। আবার তারা যে নতুন করে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করছে, তাতেও পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। সম্প্রতি তারা রয়টার্সের দুই সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করেছে।

পরিবর্তন বাস্তবায়নে মিয়ানমারের ওপর ব্যাপক আন্তর্জাতিক চাপ রয়েছে, ব্যাপারটা ঠিকই আছে। কিন্তু তাতে সরকারের সবকিছু কুক্ষিগত করে রাখার মানসিকতা জায়েজ হয় না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের গঠনমূলক সমালোচনা গ্রহণ না করার মানসিকতা প্রসঙ্গেও একই কথা প্রযোজ্য। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় চায়, মিয়ানমার সরকার রাখাইন প্রদেশে শান্তি ও উন্নয়ন নিশ্চিত করুক। তারা সেখানে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি প্রতিষ্ঠা করুক।

পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দিতে দেশটির সরকারের অনতিবিলম্বে তিনটি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। প্রথমত, রাখাইন প্রদেশের প্রসঙ্গে অং সান সু চিকে নৈতিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দুই বছর আগে নির্বাচিত হওয়ার সময় তাঁর দলের যে জনপ্রিয়তা ছিল, এখন সেটা কমে গেলেও তিনি এখনো দেশটিতে শ্রদ্ধার পাত্র, বিশেষ করে সংখ্যাগুরু বর্মি নাগরিকদের মধ্যে তিনি জনপ্রিয়। নিজের অবস্থান কাজে লাগিয়ে তাঁর উচিত দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘৃণা ছড়ানোর সমালোচনা করা। তেমনি বক্তৃতায় তাঁর এমন কিছু বলা উচিত নয়, যাতে মানুষের কাছে মনে হয় যে তিনি বৈষম্য সৃষ্টি করছেন। মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম রাখাইনের মুসলমানদের মানব-মাছি আখ্যা দিয়েছে, এখন সু চি যদি এটা নিশ্চিত করেন যে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম সংঘাতের আশঙ্কা উসকে দেবে না, তাহলে সেটা কাজের কিছু হবে।

দ্বিতীয়ত, মিয়ানমারের উচিত সহিংসতার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের জবাবদিহি নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করা। দায়মুক্তির সংস্কৃতি থাকলে সু চি যে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কথা বারবার বলেছেন, তা হুমকির মুখে পড়বে। রাখাইনে গণকবরের সন্ধানে মিয়ানমার সরকার যে দৃশ্যত স্বাধীন ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত কমিশন গঠনের কথা বলেছে, তাতে আমি উৎসাহিত হয়েছি। আশা করি, এই সূত্র ধরে তারা আরও অগ্রসর হবে।

শেষমেশ রাখাইন অ্যাডভাইজরি কমিশনের সুপারিশমালায় গুরুত্ব দিয়ে রাখাইন প্রদেশের ব্যাপারে কী করা যায়, মিয়ানমারকে সে কৌশল প্রণয়ন করতে হবে। সরকার যে অবকাঠামো ও উন্নয়নের ওপর জোর দিচ্ছে, তা গুরুত্বপূর্ণ হলেও কাঠামোগত পরিবর্তন সমাধানের জন্য উপযুক্ত নয়। চলাচলের স্বাধীনতা, নাগরিকত্ব ও বাস্তুচ্যুত মানুষের শিবির বন্ধ করার মতো বিষয়গুলো নিশ্চিত করার জন্য মিয়ানমার সরকারকে আন্তর্জাতিক সহযোগীদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করতে হবে। ধাপে ধাপে এই বিষয়গুলোর সমাধানে পরিকল্পনা করতে হবে।
কিন্তু এই ব্যাপারগুলো গুরুত্ব না দিয়ে ফেলে রাখা হলে এগুলো মিয়ানমার, এই অঞ্চল ও পৃথিবীর জন্য আরও বড় মাথাব্যথার কারণ হতে পারে। স্বল্প মেয়াদের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, মিয়ানমার যে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দ্রুত বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে, তা বড়জোর প্রতীকী ব্যাপার হবে। তাদের প্রত্যাবাসন যদি নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়, তাহলে খুব কম শরণাগত মানুষই নিজ দেশে ফিরে যাবে, যেখানে তাদের ওপর সহিংসতা চালানো হয়েছিল।

যে দেশে তাদের মৌলিক অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা নেই, যেখানে তাদের প্রতি যে অন্যায় হয়েছে তার প্রতিকারের ব্যবস্থা নেই-সেখানে কজনই বা স্বেচ্ছায় ফিরবে। ফলে বিপুলসংখ্যক দরিদ্র মানুষ সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশে থেকে যাবে, যাদের আবার চরমপন্থায় জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে। নিজের ও আঞ্চলিক স্বার্থের জন্য মিয়ানমারকে এই মুহূর্তে অবশ্যই সঠিক পথ অবলম্বন করতে হবে। আর তাকে স্বীকার করতে হবে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাকে এই কাজে সহায়তা করতে চায়।

অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে নেওয়া।

বিল রিচার্ডসন: রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে অং সান সু চর গঠিত আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্যানেল থেকে ২৫ জানুয়ারি পদত্যাগ করেন। জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত।