গাধার চোখে যা দেখি

ম্যানিলা থেকে ফিরছি। পথে ব্যাংকক এয়ারপোর্টে ফ্লাইট বদলাতে হলো। ম্যানিলা আর ব্যাংককের আলিশান এয়ারপোর্টে আগে এসেছি অনেকবার। আগের মতো এবারও বসে বসে ভাবি নিজের দেশের কথা। ভাবি এমন সুবিশাল, সুশৃঙ্খল আর পরিচ্ছন্ন এয়ারপোর্ট কবে হবে আমাদের! কবে আমাদের এয়ারপোর্ট হবে নির্ঝঞ্ঝাট আর নির্ভাবনাময়!

ঢাকার এয়ারপোর্টে লাগেজের জন্য অপেক্ষা করতে হয় অনেকক্ষণ, দুবার আমার লাগেজ পেয়েছি ভাঙা অবস্থায়। এসব ভয়ে ছোট লাগেজ নিয়ে চলাফেরা করি, রাখি নিজের সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু এবার ওজন বেশি হয়েছে বলে লাগেজ চেক-ইন করিয়েছি। প্লেনে বসে ভাবি, কতক্ষণে পাব লাগেজ! তার চেয়ে বড় কথা, কখন ফিরতে পারব এয়ারপোর্ট থেকে বাসায়!

প্লেন থেকে ছেড়ে আসা শহরের আলো দেখি, দেখি প্লেন নামতে থাকা শহরের আলো। ইউরোপের শহর বাদ থাক, ম্যানিলা আর ব্যাংককের আলোর পাশেই বড় বেশি ম্লান, টিমটিমে আর অনুজ্জ্বল লাগে নিজের শহরকে। তবু এই আলো দেখেই আগে চোখ ভিজে যেত আমার। তেইশ বছর আগে লন্ডন থেকে সাত মাস পর ফিরছিলাম দেশে। ঢাকার আকাশে প্লেনের নাক নিচু হওয়া মাত্র কেঁদে উঠেছিলাম ফুঁপিয়ে। গরিব হোক, হোক অনুজ্জ্বল, তবু নিজের মা-ই সবচেয়ে প্রিয় আমার, সবচেয়ে প্রিয় নিজের দেশই।

অথচ এই দেশে, এই শহরে প্লেন নামতে থাকামাত্র এখন দুর্ভাবনা হয় বাড়ি ফেরার কথা ভেবে। ম্যানিলা থেকে ব্যাংককে আসতে লাগে তিন ঘণ্টা, ব্যাংকক থেকে ঢাকায় আড়াই ঘণ্টা। ঢাকার এয়ারপোর্ট থেকে ফুলার রোডে আমার বাসার দূরত্ব গাড়িতে আধা ঘণ্টার। কিন্তু সেখানে আসলে কত ঘণ্টা লাগবে, কেউ জানি না আমরা। কতক্ষণে এয়ারপোর্ট থেকে বের হতে পারব, তা-ও আন্দাজ করা যায় না এ দেশে।

ঢাকার এয়ারপোর্টে নামলে তাই দৌড়াতে শুরু করেন বহু যাত্রী। ইমিগ্রেশনে অনন্ত অপেক্ষা, বের হওয়ার সময় ক্রুদ্ধ মুখের পুলিশের আরেক দফা পাসপোর্ট পরীক্ষা। ইমিগ্রেশন পার হলে ট্রলি খোঁজার জন্য আবার উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটতে থাকে তারা। ট্রলি পাওয়া মানুষ রাজ্যজয়ের তৃপ্তি নিয়ে আসে কনভেয়ার বেল্টের কাছে। সেখানে এসে অপেক্ষা করতে করতে কোমর ভেঙে যায় অনেকের, লাগেজের খোঁজে তাকিয়ে থাকা স্থির চোখে নামে ক্লান্তি। একসময় স্যুটকেস পেলে গ্রিন চ্যানেল, কিন্তু সেখান দিয়ে যাওয়ার সময়ও কারও কারও অগ্নিপরীক্ষা হয় স্যুটকেস উল্টে-পাল্টে।

ইমিগ্রেশনের পুলিশ, কাস্টমসের অনেকে চেনে আমার চেহারা। এসব ঝক্কি পোহাতে হয় না আমাকে সাধারণত। তবু আমি গাধার মতো অন্য মানুষের এসব দুর্ভোগ দেখি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। দুবাই থেকে ফেরার পথে একবার বড় পোঁটলা বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে সৌদি আরব থেকে ঠকে ফিরেছিল এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারী। এয়ারপোর্টে নাকি কেউ থাকবে না তার জন্য, ময়মনসিংহে যাওয়ার টাকাও নেই তার। ঢাকা এয়ারপোর্টে এলে তার মতো মানুষদের খুঁজে দেখি। এমন সম্বলহীন, সহায়হীন প্রত্যাবর্তন আর কোথায় হয় পৃথিবীতে?

আমার চোখ গাধার চোখ। এই চোখ দুঃখ দেখে বেশি, দেখে মানুষের কষ্ট। এই চোখে দেখে দেখে ভাবি, পৃথিবীর কোন দেশের মানুষকে উত্তাল সাগর ঠুনকো নৌকায় পাড়ি দিয়ে চাকরি খুঁজতে গিয়ে জীবন দিতে হয়? কোন দেশের মানুষকে জঙ্গলে, পর্বতে, মরুভূমিতে দাসশ্রমিকের কাজ করতে হয়? কোন দেশের মানুষকে ঠকে সব হারিয়ে দেশে ফিরতে হয়? কোন দেশের পাসপোর্ট হাতে নিয়ে হেলাফেলায় তাকায় ইউরোপ, আমেরিকা কিংবা আরব দেশের ইমিগ্রেশনের মানুষ?

এয়ারপোর্ট থেকে রাস্তায় নেমেও নিস্তার হয় না আমার মতো মানুষদের। এই রাস্তায় বহুদিন আমাকে, আমার মতো অজস্র মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। আমাদের সবাইকে থামিয়ে রেখে কোনো না কোনো দিন ভিআইপিরা চলে যান সাইরেন বাজানো গাড়িবহর নিয়ে, কোনো না কোনো দিন নেতা-নেত্রীদের ‘গুণমুগ্ধ’ মানুষের মিছিলের ঢল নামে রাস্তায় অথবা কোনো না কোনো দিন সেই রাস্তায় চলে অনন্ত উন্নয়নের খোঁড়াখুঁড়ি। এসব দেখে কিংবা আশপাশে মুখ ঘুরিয়ে উঁচু কিছু ভবন আর উড়ালসড়ক দেখে তৃপ্ত হওয়া উচিত আমার। কিন্তু আমার গাধার চোখ শুধু দেখে রাস্তায় নিশ্চল বাসের খোপে ক্লান্ত, অবশ মানুষের মুখ। দেখে তাদের ভিড়ে ভিড়ে ছুটতে থাকা ভিখারির থালা, ফুটপাতে-উড়ালসড়কের নিচে কিংবা রোড ডিভাইডারের ছিন্নমূল মানুষ।

গাধার চোখ না হলে কেন এড়িয়ে যাই না এসব!

২.
আমি অবশ্য পত্রিকা পড়ে পড়ে উন্নয়ন বোঝার চেষ্টা করি। দেশে জিডিপি বেড়েছে, ফরেন কারেন্সি রিজার্ভ বেড়েছে, অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমেছে, মানুষের ব্যয়ক্ষমতা বেড়েছে। কিছুটা তো উন্নতি হয়েছে এসবে। কিন্তু আমার গাধার চোখ তবু গুণমুগ্ধ হতে পারে না এতে। এই চোখ দেখে গার্মেন্টস শ্রমিক, বিদেশের মানুষ, কৃষক আর ÿক্ষুদ্র উদ্যোক্তার প্রাণপাত পরিশ্রমের খবর। আমি তাই ভাবি, উন্নয়ন যদি হয়, কিছু জিডিপি আর ফরেন কারেন্সি যদি বাড়ে, যদি বাড়ে কর্মসংস্থান, এটা তো গরিব আর সাধারণ মানুষের প্রাণপাত পরিশ্রমের কারণে। এই উন্নয়নে কীভাবে যৌক্তিক হয় তাদেরই গণতন্ত্র কেড়ে নেওয়ার আয়োজন?

বুদ্ধিমান মানুষেরা অবশ্য বলেন নীতি-সহায়তার কথা। আমি ভাবি, সরকারের নিজেদের বাস, ব্যাংক, বিমান, কারখানা, অফিস, খামার সেখানেও আছে নীতি-সহায়তা, তাহলে সেখানে কেন নেই উন্নতি? আমি দেখি নিজেদের লোককে মালিকানা দিয়ে, নিজেদের লোক পরিচালনায় রেখে, নিজেদের লোকদের চাকরি দিয়ে খোলা ব্যাংকের দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার খবর। দেখি অন্যদের পরিশ্রমে গড়ে ওঠা ব্যাংকের সাফল্য দখল করে তাকে পকেটে পোরার চেষ্টা। ভাবি, নীতি-সহায়তাটা মুখ্য নয় তাহলে। আমার মতো আরও কিছু গাধা ধরনের মানুষ আছে এ দেশে। তাদের কাছে শুনি, নীতি-সহায়তা বরং বহু ভালো, এমনকি ভারত বা শ্রীলঙ্কার মতো দেশে।

আমার চোখে আরও সমস্যা আছে। সেই চোখ বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির খবর দেখে, দেখে সেই উৎপাদনে দুর্নীতির খবরও। আমি তাই ভাবি, আহা! দুর্নীতিটা না হলে বাড়ত না দেশে বিদ্যুতের দাম, বাড়ত না মানুষের দুর্ভোগ। আমার চোখ রাস্তা নির্মাণের সংবাদ দেখে, দেখে স্কয়ার ফিটের হিসাবে এর অবিশ্বাস্য খরচের বিবরণ। আমি ভাবি, আহা! এই একই টাকায় আরও কত রাস্তা, হাসপাতাল, স্কুল নির্মিত হতে পারত এ দেশে! আমার চোখ গণহারে নিয়োগ, পদোন্নতি আর বেতন বৃদ্ধির খবর দেখে। দেখে সঙ্গে সঙ্গে জিনিসের দাম বাড়ার মিছিল। আমি ভাবি, আহা! শ্রমিক আর দিনমজুর না জানি কী যাতনায় পড়ল আমাদের কিছু মানুষের উন্নয়নে।

৩.
আমি গাধা বলেই হয়তো ভালো কিছু আমার চোখে পড়ে না। আমার চোখ বুড়িগঙ্গার দুই পারের দিগন্তছোঁয়া ইটখোলার উগলে দেওয়া কালো ধোঁয়া আর বুড়িগঙ্গার কালো জল দেখে। এই দেশের বাতাস আর পানিকে বিষাক্ত করা উন্নয়নের মানে বুঝি না তাই আমি। বুঝি না কেন আবার বন বিষাক্ত করে হবে দৈত্যের মতো বিশালকায় কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প।

আমার গাধার চোখ আবু বকরের মায়ের আর্তি দেখে, নারীর উদ্যত হাতে নারীর বস্ত্রহরণ দেখে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে। তাদের সমর্থনের ব্যানারের পেছনে দেখে বড় বড় শিক্ষক আর আইনজীবীর মুখ। আমার গাধার চোখ দেখে বড়লোকের হাজার কোটি টাকা মেরে দেওয়ার খবর, কয়েক শ টাকা বেতন বৃদ্ধির জন্য অনশনে নামা মানুষের হাহাকার। আমি লাখে লাখে জিপিও ফাইভে খুশি হই না, শত শত অধ্যাপক আর সচিবে দেশ সয়লাব হয়েছে দেখে আশাবাদী হই না, গুম-নকল-ব্যাংক লুট আদিমকাল থেকে হচ্ছে শুনে মেনে নিতে পারি না, বড় লুটেরারা আয়োজন করে সমাজসেবা করলে আপ্লুত হয়ে পড়ি না।

ভাগ্য ভালো, এ দেশের ভাগ্যবিধাতারা গাধা নন। তাঁরা আর তাঁদের গুণমুগ্ধরা নিজেদের আমলে সবকিছুতে উন্নয়ন দেখেন। অর্থ, যশ, ক্ষমতা আর ভোগবিলাসের ব্যাপক উন্নয়ন হয় তাঁদেরও জীবনে। জোটে খ্যাতি, পুরস্কার, খেতাব। ভালো ভালো কথা বলে তাঁরা মন কেড়ে নেন সহজ-সরল মানুষের।

ভাগ্য ভালো, তাঁরা আছেন। তাঁরা না থাকলে কীভাবে বুঝতাম কত বড় গাধা আমি! আমার মতো কিছু মানুষ!

আসিফ নজরুল অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।