ক্যানসার চিকিৎসায় বাংলাদেশ

২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, ইউনাইটেড হাসপাতাল লিমিটেডের সহযোগিতায় ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘ক্যানসার চিকিৎসায় বাংলাদেশ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।

গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা
গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা

আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম:
২০০৫ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতায় ক্যানসারের ওপর জরিপ হয়। এরপর আর কোনো পরিসংখ্যান আমাদের নেই। এটা দরকার। সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমস-এর একটি প্রতিবেদনে দেখলাম, বেশি সিটি স্ক্যানের ব্যবহার ক্যানসার রোগের একটি কারণ। এক্স-রে থেকে সিটি স্ক্যানে এক হাজার গুণ বেশি রেডিয়েশন হয়। এটা ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই এসব বিষয়ে একটি জাতীয় নীতিমালা দরকার। আলোচনায় এসব বিষয় আসবে। এখন আলোচনা করবেন মোহম্মদ নাসিম।

মোহাম্মদ নাসিম: অনুষ্ঠানে উপস্থিত চিকিৎসক, বিশেষজ্ঞ সবাইকে ধন্যবাদ জানাই। ক্যানসারের কিছু নতুন তথ্য আমারও জানা হলো। যেমন অতিরিক্ত সিটি স্ক্যান ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। ক্যানসার হওয়ার আগে প্রতিরোধকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। দায়িত্ব গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই কাজ শুরু করেছি। মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মান ও অনিয়ম নিয়ে কথা বলছি। সরকারের অন্য কর্মকর্তারা যদি গ্রামে থাকতে পারেন, তাহলে চিকিৎসকেরাও থাকতে পারবেন বলে আশা করি। এসব ক্ষেত্রে কাজ করা শুরু করছি। গ্রামে বিদ্যুৎ আছে। অবকাঠামো ভালো। শহরের থেকে গ্রামের পরিবেশ ভালো। যেসব চিকিৎসক গ্রামে থাকবেন, তাঁদের সুযোগ-সুবিধার বিষয়টি বিবেচনা করব। এখন চিকিৎসকদের গ্রামে থাকার সময় এসেছে। আপনাদের মতামত নিয়ে সামনের দিকে কাজ করার উদ্যোগ নেব।


মতিউর রহমান:
আমরা সবাই দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির কথা ভাবি। এ জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সামাজিক খাতগুলো গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক খাতে বাংলাদেশের অগ্রগতি অনেক হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারতের চেয়েও এগিয়ে আছি আমরা। বর্তমান সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে এনেছেন। এক. বেসরকারি মেডিকেল কলেজের অনিয়ম। দুই. চিকিৎসকদের গ্রামে থাকার বিষয়টি। অনেকটা দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, গত সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অনেক অনিয়ম ছিল। স্বাস্থ্যমন্ত্রী এদিকেও নজর দেবেন।
দেশে ১৬ কোটি মানুষ। সরকারের একার পক্ষে সবার সব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ। সরকারির চেয়ে বেসরকারি খাতে ব্যয় বেশি। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে কাজ করলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। এখানে গণমাধ্যমের ভূমিকা রয়েছে। দেশে অনেক চ্যানেল, রেডিও, পত্রিকা। সবার এ বিষয়ে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। শিশুদের ক্যানসার নিয়ে একটি গোলটেবিল করেছিলাম। সেখানে আলোচনায় এসেছিল, উন্নত দেশে ৮০ শতাংশ ক্যানসারে আক্রান্ত শিশু বেঁচে যায়।
আমাদের দেশে এই হার ১০ থেকে ২০ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে সচেতনতা খুবই প্রয়োজন। সরকারের বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা আমরা করি। কিন্তু কতগুলো বিষয় যেমন: শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক খাত, শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন ইত্যাদি ক্ষেত্রে একমত হওয়া প্রয়োজন। আমরা হরতাল-অবরোধ চাই না। ধ্বংস-মৃত্যু চাই না। স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল বন্ধ চাই না। এ ক্ষেত্রে সবার একমত হওয়া উচিত। আমরা সব সময় ভালো কাজের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করি। ভবিষ্যতেও আমাদের এ চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।


ফরিদুর রহমান খান:
আমরা ইউনাইটেড গ্রুপ স্বাস্থ্যসেবায় অবদান রাখার জন্য হাসপাতাল নির্মাণ করেছি। সততায় বিশ্বাস করি বলে কাউকে কোনো কমিশন দিই না। রোগীকে সব রকম সুবিধাদিতে চেষ্টা করি। ক্যানসার রোগীদের যাতে কষ্ট করে বিদেশ যেতে না হয়, সে জন্য ক্যানসার চিকিৎসার সব সুযোগ-সুবিধাসহ একটি সমন্বিত ক্যানসার কেয়ার সেন্টার গড়ে তুলেছি। আমরা বাংলাদেশে একমাত্র মেডিকেল সাইক্লোট্রন মেশিন ও প্রথম পেট সিটি স্ক্যানিং মেশিন স্থাপন করেছি। এর সাহায্যে প্রাথমিক অবস্থায় ও সঠিকভাবে ক্যানসার শনাক্ত করা হয়। এখানে আছে সর্বাধুনিক স্পেকট-সিটি ও ডিজিটাল মেমোগ্রাফির সঙ্গে স্টেরিওট্যাকটিক বায়োপসি এবং একটি সমন্বিত ব্রাকিথেরাপি ইউনিট। সম্প্রতি আমরা সংযুক্ত করেছি বিশ্বের সর্বাধুনিক ও দ্রুতগতিসম্পন্ন লিনিয়ার এসকালেটর ট্রু-বিম।
বাংলাদেশে প্যালিয়েটিভ রোগীর সংখ্যাই বেশি। কিন্তু অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিসংবলিত চিকিৎসাব্যবস্থা শুরু হওয়ার ফলে অনেক স্বাভাবিক ক্যানসার রোগীই এখন আরোগ্য লাভ করছে। যেমন ২০১২ সালে আমরা প্রায় পাঁচ হাজার রোগীর চিকিৎসা করেছি। এর ৩০ ভাগ ছিল কিউরেটিভ (আরোগ্যযোগ্য)। আবার ২০১৩ সালে ১০ হাজার রোগীর চিকিৎসা করেছি। এর ৪০ ভাগ আরোগ্যযোগ্য। কেমোথেরাপি দিতে হলে নার্সকে সিরিঞ্জ পাম্প অপারেশন বুঝতে হবে। আমাদের কেমোথেরাপি ইউনিটে সবাই বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তা ছাড়া হাসপাতালের নার্সিং কলেজে বেসিক ও পোস্ট বেসিক কোর্সে নিয়মিত হাতে-কলমে নার্সরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ হলে ক্যানসার চিকিৎসায় আমরা ভালো অবদান রাখতে পারব।


শেখ গোলাম মোস্তফা:
দেশের আটটি সরকারি হাসপাতালে রেডিওথেরাপির সুযোগ আছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিগগির একটি রেডিওথেরাপি ও লিনিয়ার মেশিন কাজ করবে। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, সিলেট, রংপুর, বরিশাল মেডিকেল কলেজে কোবাল্ট মেশিন আছে। মেশিনগুলো পুরোনো, ভালো কাজ করে না। ঢাকা ও বগুড়া মেডিকেল কলেজে লিনিয়ার এসকালেটর ও কোবাল্ট মেশিন আছে। দেশে ১৬ কোটি মানুষ। ক্যানসার রোগীর সংখ্যা ১২ থেকে ১৩ লাখ। এখানে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। প্রতিবছর ১৫ হাজার নতুন রোগী ও ৭৫ হাজার পুরোনো রোগী আসে। এত বিশাল পরিমাণ রোগীকে সীমিত সুযোগ-সুবিধার মাধ্যমে সেবা দেওয়া সম্ভব নয়। নতুন-পুরোনো মিলিয়ে প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ রোগী আসে। এদের প্রায় সবাই বাইরে থেকে সেবা নেয়। ক্যানসারের বিভিন্ন কারণের মধ্যে ধূমপান অন্যতম। ৪০ শতাংশ ক্যানসার হয় ধূমপান থেকে। ধূমপানে ৩৪ প্রকার কারসেনোজেন থাকে। বিশেষ করে ফুসফুস, মুখগহ্বর, গলা, পাকস্থলী, কিডনি, যকৃৎ ইত্যাদি ক্যানসারের বিভিন্ন কারণের মধ্যে ধূমপান অন্যতম। ধূমপায়ীদের চেয়ে অধূমপায়ীদের ফুসফুস ১০ গুণ বেশি ক্ষতি হয়। কারণ, তাদের ফুসফুসের ধূমপানের সহ্যক্ষমতা গড়ে ওঠেনি। এটা হলো পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতি। ইউনাইটেড হাসপাতালে ক্যানসার চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা উন্নত বিশ্বের মতো।


মোয়াররফ হোসেন:
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক হিসাবমতে, প্রতি ১০ লাখ রোগীর জন্য একটি করে ক্যানসার হাসপাতাল প্রয়োজন। সে অনুযায়ী দেশে ১৬০টি ক্যানসার হাসপাতাল প্রয়োজন। কিন্তু দেশে আছে মাত্র ২০টি হাসপাতাল। আমাদের ৭২টি বেড আছে। প্রতিদিন প্রায় ২৭৫ জন রোগীকে রেডিওথেরাপি দেওয়া হয়। ১০ থেকে ১৫ জনকে স্বল্প সময়ের কেমো দেওয়া হয়। একটি লিনিয়ার ও দুটি কোবাল্ট মেশিন আছে। কিছুদিন আগেও তিন মাস পর পর একজন রোগীকে পুনরায় আসার সময় দেওয়া হতো। ফলে কেউ প্রাথমিক পর্যায়ে এলেও তিন মাস পর পর তার অবস্থা হতো অনেক খারাপ। এখন কাজের উন্নতি হওয়ায় এক মাসের মধ্যে সময় দিতে পারি। কিন্তু যে রোগী আজ আসবে, তার কাল চিকিৎসা নেওয়া প্রয়োজন। গরিব লোকেরা দুঃখ করে বলেন, ‘আমাদের টাকা থাকলে বাঁচতে পারতাম। বিদেশে যেতে পারতাম।’ কিন্তু ক্যানসারের চিকিৎসা সারা বিশ্বে একই পদ্ধতির।

শান্তনু চৌধুরী: ইউনাইটেড হাসপাতাল ক্যানসার রোগীর নিবন্ধন শুরু করেছে। এখানে ফুসফুস, স্তন, জরায়ুমুখ, গলা, মুখগহ্বর ও গ্যাস্ট্রিক ইসোফোজিয়াল ক্যানসার বেশি। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে হলে ক্যানসার রোগীদের পরিসংখ্যান প্রয়োজন। তাই আমাদের জাতীয়ভাবে ক্যানসার রোগীদের নিবন্ধন প্রয়োজন। ক্যানসার চিকিৎসা একটা মাল্টিডিসিপ্লিনারি অ্যাপ্রোচ। এ জন্য টেকনিশিয়ান, মেডিকেল ফিজিসিস্ট, অনকোলজি, নার্স সবাইকে প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার।
এখানে প্রায় ৬২ শতাংশ প্যালিয়েটিভ রোগী। এরা তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যায়ের রোগী। এদের কিউরেটিভ ট্রিটমেন্ট দেওয়া যায় না। তাই হাসপাতালগুলোকে প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। বেসিক বা প্রাইমারি হাসপাতালগুলোয় দামি মেশিন না বসিয়ে কম দামি কোবাল্ট মেশিন বসালেই চলে। রেফারেল হাসপাতালে লিনিয়ার মেশিন থাকতে পারে।
গ্রামের রোগীদের টেলিমেডিসিন তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসাসেবা দেওয়া যেতে পারে। দরিদ্র রোগীদের সেবা দিতে তৃতীয় পক্ষ ইনস্যুরেন্স কোম্পানিকে উৎসাহিত করা যেতে পারে। ইনস্যুরেন্স কোম্পানির কার্ড দেখালে সরকারি চিকিৎসা ফ্রি হবে। সরকার তা পরবর্তী সময়ে কিস্তিভিত্তিক কম টাকায় পরিশোধ করবে। আমি বিশ্বাস করি, উচ্চপ্রযুক্তিতে চিকিৎসা খরচ বর্তমানে একটু বেশি হলেও ভবিষ্যতে কমে আসবে। এখন সরকারিভাবে বড় আকারে প্যালিয়েটিভ কেয়ার করা প্রয়োজন। ইউনাইটেড হাসপাতাল এ লক্ষ্যে কাজ করছে। আমার বিভিন্ন দেশে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু ইউনাইটেড হাসপাতালের অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ও সুযোগ-সুবিধা উন্নত বিশ্বের মতো।


পারভীন শাহিদা আখতার:
ক্যানসারের চিকিৎসা সরকারি-বেসরকারি সব জায়গায় একই রকম। সরকারিভাবে খরচ কম। আমরা প্রায় বিনা মূল্যে কেমো দিয়ে থাকি। ক্যানসারের চিকিৎসা ব্যয়বহুল ও দীর্ঘমেয়াদি। আমাদের কাছে প্রায় শেষ পর্যায়ে রোগী আসে। চিকিৎসার জন্য রোগীকে শারীরিক, মানসিক ও আত্মিকভাবে প্রস্তুত করতে হয়। এর জন্য পর্যাপ্ত জনবল সরকারের নেই। ক্যানসার রোগীদের রক্তসহ বিভিন্ন পরীক্ষা অধিকাংশ সময় হাসপাতালের বাইরে থেকে করতে হয়। সরকারের একার পক্ষে সবকিছু করা সম্ভব নয়। সামাজিক সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। বছরে প্রায় এক লাখ রোগী আসে।
ক্যানসার চিকিৎসার প্রধান প্রয়োজন নার্স। আমাদের নার্সের সংখ্যা কম। ভালো চিকিৎসার জন্য দিবাযত্ন ও জরুরি সেবা বাড়াতে পারলে ইনডোরে রোগীর চাপ কমবে। সার্জিক্যাল, রেডিয়েশন, কেমো—এসব বিষয়ের ওপর তিন থেকে ছয় মাসের প্রশিক্ষণ দিয়ে ঢাকার বাইরে পাঠালে আমাদের ওপর চাপ কমবে। এবং সেবার মান বাড়বে। ছোট ছোট পরীক্ষা যেমন: রক্ত, এক্স-রে ইত্যাদির ক্ষেত্রে মাত্র ৫ শতাংশ সরকারি হাসপাতাল সেবা দিতে পারে। জেলায় জেলায় কোবাল্ট মেশিন দেওয়া যায়। একটা কোবাল্ট মেশিনে ২০০ রোগী দেখা সম্ভব। তিন থেকে পাঁচ কোটি টাকা খরচ করে প্রতিটি জেলায় এ সুবিধা দেওয়া যায়। রক্ষণাবেক্ষণ খরচ কম। প্রতিদিন ২০০ রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া যায়। এতে সরকার ও ক্যানসার রোগীদের খরচ অনেক কম হবে।


মো. আবদুস সালাম:
পরিবেশদূষণের জন্য ক্যানসার রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তাদের চিকিৎসা দুরূহ। বেশির ভাগ ক্যানসারের নিরাময় সম্ভব। ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমা—এসব রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। কিন্তু সারা জীবন নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। এখন দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় বেশির ভাগ ক্যানসার নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। কিছু ক্যানসার একেবারে নির্মূল করা যায়। যাদের আর চিকিৎসা সম্ভব নয়, তাদের জন্য প্যালিয়েটিভ কেয়ারের ব্যবস্থা আছে। তবে দেশব্যাপী এর বিস্তৃতি নেই। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের মধ্যে বিশেষজ্ঞ বিনিময় করতে পারেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার জানামতে অনেক বিশেষজ্ঞ আছেন, যাঁরা রংপুর, দিনাজপুর, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে সপ্তাহে, মাসে একটা নির্দিষ্ট সময় দিতে পারেন। ইংল্যান্ডের সব হাসপাতালে সব বিষয়ের বিশেষজ্ঞ নেই। কিন্তু তারা বিশেষজ্ঞের সহযোগিতা পায়। কারণ, এক প্রতিষ্ঠান অন্য প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় থাকে। বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ এনে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দিলে ব্যয় অনেক কম হবে। এসব করতে পারলে সরকারের চিকিৎসাব্যবস্থায় আর একটা উন্নয়ন ঘটবে।


আহমেদ সাঈদ:
ক্যানসার একটি সমন্বিত চিকিৎসাব্যবস্থা। অনেক বিভাগ এর সঙ্গে জড়িত। ক্যানসার চিকিৎসায় সার্জারির ভূমিকা অন্যতম। কোনো রোগী সমন্বিত সেবা পেলে সে ভালো সেবা পেয়েছে বলা যাবে। ক্যানসার ইনস্টিটিউটে সমন্বিত চিকিৎসার সুবিধা আছে। এ ধরনের চিকিৎসাব্যবস্থা বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে হবে। ক্যানসার পরিবার সমাজ ও দেশকে প্রভাবিত করে। ক্যানসার যাতে না হয়, সে জন্য দেশব্যাপী সবাইকে সচেতন করতে হবে। ক্যানসার হওয়ার কারণগুলোর ব্যাপক প্রচার করতে হবে। গণমাধ্যমকে এ ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে রোগ শনাক্ত হলে চিকিৎসার মাধ্যমে রোগী ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ভালো হয়। সঠিক সময়ে রোগনির্ণয় ও সঠিক জায়গায় পাঠাতে হলে চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। পত্রপত্রিকায় দেখা যায়, পিপির (পাবলিক-প্রাইভেট অংশীদারির ভিত্তিতে) অর্থ বিনিয়োগ করা যায় না। কিন্তু ক্যানসার চিকিৎসায় এ অর্থ ব্যয় করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।


ফেরদৌস শাহরিয়ার:
ইউনাইটেড হাসপাতাল ক্যানসার চিকিৎসার জন্য একটা রেফারাল সেন্টার। এখানে চিকিৎসক-নার্স-টেকনিশিয়ান—সবাই নিজ নিজ পেশায় বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। এখানে ক্যানসার চিকিৎসার অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিসহ সব সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান।
রোগীকে কেমোথেরাপি দিতে হলে খুবই সতর্কভাবে ও নিয়মমতো দিতে হয়। তাই অনকোলজি নার্সদের দক্ষ ও আন্তরিক হতে হয়। ইনজেকশনের পাশ দিয়ে কেমোথেরাপির ওষুধ বেরিয়ে যেতে পারে, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। আমরা আন্তর্জাতিক প্রটোকল মেনে এখানে কেমোথেরাপি দিই। আমাদের পর্যাপ্ত সংখ্যায়, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স আছে। স্ট্যান্ডার্ড প্রটোকল মেনেই কেমোথেরাপি দিতে হয়। বিদেশে যারা চিকিৎসা করাতে যায়, তারা পুনরায় আমাদের কাছে আসে। আমরা রোগীদের আস্থা অর্জন করতে পারছি।

মো. গোলাম মোস্তফা: আমরা পর্দার আড়ালে থাকি। রোগীদের সঙ্গে দেখা হয় না। ২০ বছর আগে চিকিৎসার অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। হয়তো রোগীর ক্যানসার ছিল। কিন্তু ঠিকমতো রোগনির্ণয় সম্ভব হয়নি। বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে। এখন এ ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। পুরুষদের বেশি হয় ফুসফুস ক্যানসার। মেয়েদের স্তন ক্যানসার। ক্যানসার নির্ণয় থেকে শুরু করে যা কিছু দরকার, তার সবই দেশে সফলতার সঙ্গে হচ্ছে। নারীরা অনেক ক্ষেত্রে সময়মতো চিকিৎসকের কাছে আসে না। যাঁদের দেখায়, তাঁরাও কিছু বলেন না যে এটা পরীক্ষা করতে হবে। বিশেষজ্ঞ দেখাতে হবে। ঠিক সময় রোগনির্ণয় হলে ক্যানসার এখন আতঙ্কের কারণ নয়। গরিবদের ক্যানসারের অন্যতম কারণ হলো ধূমপান ও আর্সেনিকযুক্ত পানি। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৯৫ সালের আগে টিউবওয়েলের পানি যারা খায়, তাদের ক্যানসারের ঝুঁকি ১০ গুণ বেশি। ফুসফুস ক্যানসারের বেশির ভাগ রোগীই গরিব। গরিব মানুষের চিকিৎসার ব্যবস্থা আমাদের করতেই হবে।