মা ও মাতৃভূমি গৌরবের

নোয়াম চমস্কি কোনো চাট্টিখানি মানুষ নন। তাঁর নিজের বিষয় ভাষাবিজ্ঞানেই তিনি যে তুলনাহীন, তা-ই নন, বিশ্ব বুদ্ধিজীবীদের যদি কোনো রোল নম্বর থাকে তা হলে তিনি বর্তমানে এক নম্বরে। বার্ট্রান্ড রাসেল, জাঁ-পল সার্তে গত হওয়ার পর নয়া সাম্রাজ্যবাদ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী দুষ্কর্মের যাঁরা জোরালো প্রতিবাদ করেছেন, তিনি তাঁদের মধ্যে প্রথম সারির একজন।

কার্ল মার্ক্সের পরে পশ্চিমাদের মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশ সম্পর্কে চমস্কির পর্যবেক্ষণ আমার মতো কম বিদ্বান বাঙালির বিবেচনায় সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ও সঠিক। তাঁর কোনো লেখায় বাংলাদেশের উল্লেখ থাকলে বুঝতে হবে তা অর্থহীন নয় এবং তার গুরুত্ব অসামান্য। সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে আলোচনায় তাঁর এক সাম্প্রতিক গ্রন্থে বাংলাদেশের প্রসঙ্গ আছে। সে প্রসঙ্গের আক্ষরিক অনুবাদ এ রকম:

‘সাম্রাজ্যবাদী শাসন যে একটি বিপর্যয় তাতে সন্দেহের লেশমাত্র নেই। দেখুন ভারতবর্ষ। যখন ব্রিটিশরা বাংলায় প্রথম প্রবেশ করে তখন তা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বিত্তশালী জায়গাগুলোর একটি। প্রথম ব্রিটিশ বেনিয়া-যোদ্ধারা বাংলাকে বেহেশত (প্যারাডাইস) বলে বর্ণনা করেছে। সেই এলাকাটি এখন বাংলাদেশ ও কলকাতা, যা অত্যন্ত হতাশা ও আশাহীনতার প্রতীক।’

আমরা যাকে বলছি তামাম দুনিয়ার রোল মডেল-অনুকরণীয় ও আদর্শস্থানীয়, চমস্কি তাকে আখ্যায়িত করছেন অত্যন্ত হতাশা ও আশাহীনতার দৃষ্টান্ত হিসেবে। সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ও অপশাসনে একটি স্বর্গতুল্য ভূখণ্ডের কী পরিণতি হতে পারে, সে কথাই বলেছেন। তিনি শুধু বাংলাদেশের কথা বলেননি, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ দুই বাংলার কথাই বলেছেন।

আমাদের জ্ঞানী পূর্বপুরুষেরা শত শত বছর আগে বলে গেছেন, ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী’-মা ও মাতৃভূমি গৌরবের বা মর্যাদাপূর্ণ। পৃথিবীর যেখানেই যত সুন্দর জায়গা থাকুক, তার তুলনা জন্মভূমি বা স্বদেশের সঙ্গে হয় না। সেই স্বদেশ থেকে পালিয়ে যখন কেউ অন্য দেশে চলে যেতে চায়, তখন বুঝতে হবে জননী-জন্মভূমির অবস্থা শোচনীয়, শান্তিতে জীবনযাপনের জন্য স্থানটি উপযুক্ত নয়।

তরুণেরাই যেকোনো সমাজের মেরুদণ্ড। উন্নত সমাজ বিনির্মাণে তারাই জাতির শক্তি। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ছয়টি দেশের তরুণদের মধ্যে মতামত জরিপ থেকে দেখা গেছে ৮২ ভাগ তরুণই নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে চলে যেতে চান; থাকতে চান মাত্র ১৮ শতাংশ। যাঁরা দেশ ছেড়ে যেতে চান তাঁরা কেউই জিম্বাবুয়ে বা নাইজেরিয়ায় পাড়ি জমাতে চান না। তাঁদের আগ্রহ যুক্তরাষ্ট্র (২৪ %), কানাডা (১১ %), যুক্তরাজ্য (১১ %), জার্মানি (৯.৯ %), অস্ট্রেলিয়া (৭.৪)। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম বা ডব্লিউইএফ এই জরিপ পরিচালনা করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ছয়টি হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা।

এর আগে বাংলাদেশের তরুণদের ওপর গত বছর জুলাইয়ে প্রথম আলো এক জরিপ করেছিল। সেই জরিপে ৮২ শতাংশ তরুণ বলেছিলেন, ‘ভবিষ্যৎ কর্মজীবন নিয়ে তাঁরা অনিশ্চয়তায় থাকেন। আর সবার জন্য সমান সুযোগের অভাবকেই কর্মজীবনের অনিশ্চয়তার বড় কারণ বলে উল্লেখ করেছিলেন তরুণেরা। এ ছাড়া দুর্নীতি ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের কথা জানান ৫০ শতাংশের বেশি তরুণ।’ [ প্রথম আলো, ২ ফেব্রুয়ারি, ’ ১৮ ]

জরিপের ফলাফল উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। বিষয়টি অতি গুরুতর ও উদ্বেগের। সমাজের যাঁরা অধিপতি-শ্রেণি, বিষয়টি নিয়ে ভাববার কথা তাঁদের। যাঁরা বিদেশে পালাতে আগ্রহী, তাঁরা যে সবাই যেতে পারবেন তা নয়। যাঁরা কোনোরকমে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন পার হতে পারবেন, তাঁদের মুখে দেখা দেবে জীবনের সেরা আনন্দের হাসি।

যাঁরা শুধু পাসপোর্ট পকেটে নিয়ে এর-ওর কাছে ঘুরছেন, আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন না, তাঁদের জীবন এখন হতাশাগ্রস্ত, কিছুদিন পরে ছেয়ে যাবে বিষাদে। বিষণ্নতা একটি রোগ, তা কর্মক্ষমতা শেষ করে দেয়। অর্থাৎ জাতি গঠনে অন্তত পঞ্চাশ শতাংশ তরুণ কোনো ভূমিকা রাখতে পারবেন না। কোনোরকমে বেঁচেবর্তে থাকবেন। কেউ কেউ প্রশান্তির খোঁজ করতে সন্ধান করবেন মাদকের।

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের জরিপ মতে, দক্ষিণ এশিয়ার ছয়টি দেশের আশি ভাগের বেশি তরুণ মনে করেন দেশে তাঁদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। এই জরিপের সঙ্গে প্রথম আলোর অনলাইন ভোটারদের প্রায় ৮৮ শতাংশ একমত। ডব্লিউইএফের জরিপের ফলাফল এবং সে ফলাফল সম্পর্কে জনগণের মতামতের থেকে দেশের অবস্থা পরিষ্কার বোঝা যায়।

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার তরুণেরা মনে করেন, নিজের দেশে সবার জন্য সমান সুযোগ নেই। জরিপে প্রশ্ন ছিল, সমাজে কোন কোন ঘাটতি তাঁদের জীবনযাপন ও ব্যক্তিস্বাধীনতায় প্রভাব ফেলছে। তাঁরা এ জন্য পাঁচটি বাধার কথা বলেছেন। অর্ধেক তরুণই বলেছেন, তাঁদের সমাজে অসমতাই বড় প্রতিবন্ধকতা। তা ছাড়া, তরুণেরা মনে করেন, দেশে তাঁরা নির্ভয়ে জীবনযাপন করতে পারছেন না, নিজের জীবন নিয়ে সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারেন না, নিজের পছন্দের জায়গায় কাজ করা যায় না এবং ন্যায্য বিষয়ে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের বিরুদ্ধে-প্রতিবাদ করা সম্ভব হয় না। মূল কথা হলো, দেশে আইনের শাসন, ন্যায়বিচার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভাব। এই সব জিনিস ছাড়া শুধু অবকাঠামো উন্নয়নে একটি দেশ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয় না।

যাঁরা ইউরোপ-আমেরিকায় পাড়ি জমাতে চাইছেন, তাঁদের ভবিষ্যৎ হবে উজ্জ্বলতর-এ নিশ্চয়তা কে দিয়েছে? সেখানে গিয়ে গতর খাটাতে হবে। তাতে যে রোজগার হবে সেই ডলার-পাউন্ডকে ৮০ বা ১১০ দিয়ে গুণ দিলে যে অঙ্কটা দাঁড়াবে তা বাংলাদেশি টাকায় মন্দ নয়। কিন্তু বসিয়ে বসিয়ে কেউ ডলার-পাউন্ড দেবে না। কারখানায় অ্যাপ্রোন পরে কাজ করতে হবে। রাস্তায় গাড়ি মোছার কাজ করতে হবে। বাগান পরিষ্কার করে বা রেস্তোরাঁয় ওয়েটারের কাজ করে মজুরি পাওয়া যাবে। ট্যাক্সি চালালেও ভালো আয় হবে। লন্ডনে আমার নিজের দুই চোখে দেখেছি, মাস্টার্স করা আমাদের এক যুবক টেমস নদীর তীরে ডিসেম্বরের তুষারপাতের মধ্যে কুকুরের গলায় শিকল বেঁধে হাঁটাহাঁটি করছে। জিজ্ঞেস করলাম তার কাজ কী? বলল, প্রতিদিন কুকুরকে হাওয়া খাওয়ায় ও মলত্যাগ করায় নির্দিষ্ট স্থানে।

উন্নত দেশে গিয়ে কেউ কেউ খুব ভালো আছেন। তাদের সংখ্যা খুব কম। খুব কষ্টে বেঁচেবর্তে থাকাদের সংখ্যাই বেশি। একদিন তাঁরা মারা যান। জনা পাঁচেক লোক জানাজা পড়ে কোনো গোরস্থানে নিয়ে যায় বা বৈদ্যুতিক চুল্লির লোকদের কাছে দেহ হস্তান্তর করে।

স্বদেশের ওপর তরুণদের ক্ষোভের আর একটি কারণ তারা মনে করেন, রাষ্ট্র পরিচালক ও নীতিনির্ধারকেরা সিদ্ধান্ত নিতে তরুণদের বিষয়টি বিবেচনায় নেন না। তাঁদের কণ্ঠস্বর নীতিনির্ধারকদের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। তাঁদের চিন্তাভাবনা উপেক্ষিত থাকছে। কুড়ি-পঁচিশ বছর আগেও তরুণেরা শিক্ষাজীবন শেষ করে চাকরি দিয়ে কর্মজীবন শুরু করতে চাইতেন। এখনকার তরুণেরা অনেকেই নিজ উদ্যোগে কিছু করতে চান এবং অপরকেও কাজ করার সুযোগ দিতে চান। কিন্তু তাঁদের সেই স্বপ্ন পূরণের সম্ভাবনা কম।

শিক্ষিত তরুণদের অসন্তুষ্টির আর একটি কারণ চাকরিবাকরিতে বৈষম্যমূলক ও সংবিধান পরিপন্থী কোটা পদ্ধতি। এই পদ্ধতির ফলে জাতি একটি অদক্ষ ও অপদার্থ জাতিতে পরিণত হবে। মেধাবীদের কোনো স্থান থাকবে না। মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিদের বসিয়ে বসিয়ে বড় অঙ্কের ভাতা দিলেও কারও আপত্তি নেই, কিন্তু যোগ্য-মেধাবীর জায়গায় কোটায় অযোগ্য-অমেধাবী স্থান পাবে-সেটা ক্ষমাহীন অবিচার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সম্পূর্ণ পরিপন্থী।

মা ও মাতৃভূমিকে ত্যাগ করা যায় না। তবু নিজের দেশে ভবিষ্যৎ নেই মনে করে অন্য দেশে পালিয়ে যাওয়ার চিন্তাটা খুবই স্বার্থপরতার পরিচয়। তরুণদের কর্তব্য দেশে থেকেই অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটাতে চেষ্টা করা। সে জন্য ঝুঁকি নেওয়া ও ত্যাগ স্বীকার করা। যুগে যুগে সংগ্রামী তরুণেরাই এনেছে জগতে পরিবর্তন। তরুণেরা আত্মত্যাগ করতে জানে, আত্মসমর্পণ নয়।

সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখক ও গবেষক