ভিটেয় ফেরার সময় হয়েছে?

সিরিয়ার লাখ লাখ শরণার্থীকে তাদের যুদ্ধবিধ্বস্ত বসতভিটায় কোন কায়দায় ফেরত নেওয়া হবে, তা নিয়ে এখন ইউরোপ আর মধ্যপ্রাচ্যের সরকারি অফিস-আদালতে জোর বিতর্ক চলছে। অন্যদিকে, আশ্রয় তাঁবুর তলে বসে উদ্বিগ্ন ও বিষণ্নচিত্তে ভাগ্যহত শরণার্থীরা এখনই ঘরে ফেরা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ হবে, তা আন্দাজ করার চেষ্টা করছে। তাদের মাথায় এখন নতুন এই চিন্তার বোঝা চেপে বসেছে।

যে শরণার্থীদের দেশে ফেরত পাঠানোর চিন্তাভাবনা চলছে, তাদের সঙ্গে ভালোভাবে কথা না বলে এবং তাদের সম্ভাব্য বিপদের বিষয়টি আমলে না নিয়ে সরকারি আমলাদের হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না। এগুলো ভালোভাবে বিবেচনা না করলে আবার বিভ্রান্তির সূত্রপাত হবে। আবার ধারাবাহিক ভুল সিদ্ধান্ত আসবে। এতে সংঘাত এবং দুর্দশা আবার ভয়াবহ রূপ নেওয়ার বড় ঝুঁকি তৈরি হবে। টানা সাত বছরের বহুপক্ষীয় লড়াইয়ে সিরিয়ায় বহু রক্ত ঝরেছে। লাশ পড়েছে অগণিত। দেশের অর্ধেক লোকই যুদ্ধের কারণে ভিটেছাড়া হয়েছে। ৬০ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে এক শহর ছেড়ে অন্য এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে। আরও ৫ লাখ লোক প্রতিবেশী দেশে পালিয়েছে। এই ৫ লাখের মধ্য থেকে ১ লাখের মতো লোক ইউরোপে চলে গেছে।

আমার সংগঠন নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিল ভিটেমাটি ছেড়ে শরণার্থী হওয়া লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছে। তারা আমাদের বলেছে, দেশ ছেড়ে ইউরোপ-আমেরিকায় তারা যেতে চায় না। এমনকি স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই শরণার্থীদের যারা জায়গা দিয়েছে, সেই প্রতিবেশী দেশ জর্ডান, লেবানন কিংবা তুরস্কেও তারা যেতে চায় না। তারা চায় দেশে ফিরতে। অনেকে এ বছরই ফেরার আশা করছে।

কিন্তু কথা হলো, সিরিয়ার বেশ কয়েকটি অংশ এখনো প্রতিদিন লড়াই-সংঘাতে ছিন্নভিন্ন হচ্ছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় ইদলিব শহরে প্রচণ্ড লড়াই এখনো চলছে। যুদ্ধের কারণে ওই শহর থেকে আড়াই লাখ লোক পালিয়ে চলে গেছে। সিরিয়ার সাম্প্রতিক অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির ঘটনাগুলোর মধ্যে এটাই সবচেয়ে বড়। আর একেবারে দক্ষিণ এলাকায় চারদিক থেকে ঘিরে রাখা পূর্ব ঘৌতা এলাকায় ৪ লাখের মতো মানুষ এখনো খেতে না পেয়ে মরতে বসেছে।

সিরিয়ায় কম যুদ্ধপ্রবণ ‘ডি-এসকেলেশন এরিয়াস’ভুক্ত যে চারটি এলাকা আছে, সেই এলাকার মধ্যেই এই দুটি রণক্ষেত্র পড়েছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ডি-এসকেলেশন এরিয়াসভুক্ত এলাকায় কম সহিংসতা হয়, পর্যাপ্ত ত্রাণ মেলে এবং যেখানে ক্রমান্বয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা বসতবাড়িতে ফিরছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই ‘সুরক্ষিত’ এলাকাতেও প্রতিনিয়ত মানুষ মরছে। সেখানে প্রতিনিয়ত মৃত্যু আর ধ্বংসের ছবি দেখা যাচ্ছে। সিরিয়ার এই অমানবিক পরিস্থিতি এবং মানুষের তিল তিল করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার খবর এখন বৈশ্বিক দৃষ্টির আওতায় আসছে খুবই কম। আইএসের কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করা এলাকায় লোকজন ফিরছে বটে; সেখানে প্রতিদিনই বিস্ফোরণে প্রাণহানি ঘটছে। সবচেয়ে বড় কথা, এসব এলাকায় ফিরে আসা এবং সাহায্য সংস্থার লোকজনের চলাচল খুবই সীমিত রাখা হয়েছে। কোনো কোনো এলাকা জনগণের জন্য নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

গত বছর যতজন সিরীয় লোক দেশে ফিরেছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি লোক পালিয়েছে। যারা বাস্তুচ্যুত হয়ে নিজ এলাকা ছেড়ে দেশের অভ্যন্তরের অন্য এলাকায় গিয়েছিল এবং পরিস্থিতি অপেক্ষাকৃত অনুকূলে মনে করে আবার ফেরত এসেছে, তাদেরও একটা বিরাট অংশকে বিপদে পড়তে হয়েছে।
২০১৭ সালে ৬৬ হাজার সিরীয় শরণার্থী নিজ দেশে ফিরে গেছে। অন্যদিকে, দেশ থেকে পলায়ন-ইচ্ছুক ৩ লাখের বেশি শরণার্থীর মুখের ওপর প্রতিবেশী দেশগুলো সীমান্তের দরজা বন্ধ করে রেখেছে। যারা দেশে ফিরেছে, তাদের সবাই স্বেচ্ছায় ফিরেছে, এমন নয়। অনেককে দেশে ফিরতে বাধ্য করা হয়েছে বলেও প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া অনেকে শরণার্থী জীবনের হতাশাজনক অবস্থা থেকে উত্তরণের আশা ছেড়ে দিয়ে এবং এর চেয়ে নিজ দেশে মরা ভালো মনে করে দেশে ফিরে গেছে।

সিরিয়ার যেসব এলাকা থেকে লোকজন পালিয়েছে, সেসব এলাকার বেশির ভাগই বলতে গেলে গুঁড়িয়ে গেছে। এক-তৃতীয়াংশ স্কুল-কলেজ, ঘরবাড়ি এবং প্রায় অর্ধেক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবমতো, এগুলো ঠিকঠাক করতে ১৮ হাজার কোটি ডলারের বেশি খরচ হবে। সেখানকার নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত না করা পর্যন্ত এই পুনর্গঠন কাজে হাত দেওয়া সম্ভব নয়। আর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পূর্বশর্ত হিসেবে বিবদমান পক্ষগুলো এবং দাতাদের মধ্যে বহুপক্ষীয় চুক্তি সইয়ের ব্যাপার রয়েছে। এটা নিশ্চিতভাবেই সময়সাপেক্ষ। অনেকে আশা করছে, হয়তো এ বছরই বিবদমান পক্ষগুলো চূড়ান্ত সমঝোতায় পৌঁছাতে পারে। আর সেটা হলে হতভাগ্য শরণার্থীরা নিজ ভিটেয় ফিরতে পারবে।

আল-জাজিরা থেকে নেওয়া। অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

জ্যান এজল্যান্ড: নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিলের মহাসচিব