লোহিতসাগরের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা

লোহিতসাগর নিয়ে চলমান রাজনৈতিক ও সামরিক তৎপরতার বিষয়ে যাঁরা নিয়মিত খোঁজখবর রাখেন, নিশ্চিতভাবেই তাঁরা একটি বিষয়ে আতঙ্কে আছেন। তাঁরা বুঝতে পারছেন, এই সাগরের উপকূল যেসব আরব ও অনারব দেশের সীমানা ছুঁয়ে গেছে, তাদের মধ্যে আজ হোক কাল হোক, বড় একটা দাঙ্গা-ফ্যাসাদ বাধতে যাচ্ছে।

পর্যবেক্ষকদের আশঙ্কা, ইয়েমেন ও সোমালিয়ায় চলমান গৃহযুদ্ধের আঁচ নীল নদের দখল এবং লোহিতসাগরে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে কোন্দলরত উপসাগরীয় আরব দেশগুলোতে গিয়ে পড়বে। বিশেষত, পূর্ব সুদান এবং দক্ষিণ মিসরের মধ্যকার লোহিতসাগরের হিস্যাসংক্রান্ত দ্বন্দ্ব আরও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।

বিশ্বজোড়া বাণিজ্যের ১৩ শতাংশ পণ্য এবং দিনে ১ কোটি ৮০ লাখ ব্যারেল তেল এই সাগরের মধ্য দিয়ে আসা-যাওয়া করে। মোটামুটি নির্ঝঞ্ঝাট পরিবেশ থাকায় এই কিছুদিন আগে পর্যন্তও বিশেষজ্ঞরা লোহিতসাগরকে শান্ত আরব সাগর বলে অভিহিত করতেন। কিন্তু সম্প্রতি পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। সম্প্রতি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান সুদানে সফর করার পর মিসর ও সুদানের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে গেছে। এর কারণ হলো, এরদোয়ানের সফরের সময় আঙ্কারা ও খার্তুমের মধ্যে বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষাবিষয়ক ১৩টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর মধ্যে একটি চুক্তির আওতায় আঙ্কারাকে ৯৯ বছরের জন্য সুয়াকিন দ্বীপ ইজারা দিয়েছে খার্তুম।

সামরিক ঘাঁটি হিসেবে লোহিতসাগরের পারের তিন দেশ জিবুতি, ইরিত্রিয়া ও ইয়েমেন সম্প্রতি বিদেশিদের নজরে পড়েছে। বিশেষ করে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদেশ রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের লোভাতুর দৃষ্টি এখন এই তিন দেশের ওপর। জাপান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইসরায়েলের পাশাপাশি ইতালিও এখানকার ব্যাপারে আগে থেকেই আগ্রহী ছিল। শেষ পর্যন্ত তুরস্কও সোমালিয়ার পর এবার সুদানের দিকে ঝুঁকল।

দক্ষিণ দিকের প্রতিবেশী সুদানের সঙ্গে মিসরের বেশ ভ্রাতৃপ্রতিম সম্পর্ক ছিল। কিন্তু তুরস্ক যেভাবে সোমালিয়ার পর কাতার এবং সেখান থেকে একবারে মিসরের গায়ে ঘেঁষা সুদানে ঢুকে সেখানকার সুয়াকিন দ্বীপে সামরিক ঘাঁটি গড়ে তুলছে, তা দেখে সুদানকে মিসরের সন্দেহের নজরেই দেখার কথা। মিসরের সিসি সরকার যে ইসলামপন্থী সংগঠনকে নিষিদ্ধ করেছে, সেই মুসলিম ব্রাদারহুডের সমর্থক হলো তুরস্কের বর্তমান এরদোয়ান সরকার। ফলে সুদানে তুরস্কের ঘাঁটি মিসর ও তুরস্কের মধ্যে বৈরিতা বাড়াবে। অন্যদিকে সুদান ও কাতারের নেতারাও মুসলিম ব্রাদারহুডের সমর্থক।

তুরস্ক-কাতার-সুদান-এই ত্রিদেশীয় জোটের মুখে পড়ে মিসর লোহিতসাগরের উপকূলবর্তী অপর দেশ ইরিত্রিয়াকে নিয়ে একটি পাল্টা দ্বিপক্ষীয় ‘জোট’ গড়তে চাইছে। তাদের সমর্থন দিচ্ছে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। কাতারে সামরিক ঘাঁটি গড়ে সেখানে তুরস্ক ৩০ হাজার সেনা মোতায়েন করে আছে। একই কায়দায় তুরস্ক যাতে সুদানে ঘাঁটি গাড়তে না পারে, সে জন্য সৌদি ও আমিরাত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

খবর ছড়ানো শুরু হয়েছে, সুদানের বিরুদ্ধে ইরিত্রিয়ার জনগণ বিক্ষোভ করছে এবং আসমারা (ইরিত্রিয়ার রাজধানী) ও কায়রোর মদদ নিয়ে সুদান সরকারকে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। এর জের ধরে ইরিত্রিয়ার সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় সুদান সরকার জরুরি অবস্থা জারি করে রেখেছে। সুদানের প্রেসিডেন্ট বশির অভিযোগ করেছেন, দারফুরকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য মিসর সেখানকার বিদ্রোহীদের অস্ত্র দিচ্ছে। অবশ্য মিসর এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।

কাতারের সমর্থন নিয়ে তুরস্ক ধীরে ধীরে মিসরের দক্ষিণ সীমান্ত, সোমালিয়া ও সুদানে সামরিক উপস্থিতি বাড়াচ্ছে বলেই যে মিসর বিচলিত হয়ে পড়েছে, তা নয়। এ ছাড়া নীল নদের পানি ধরে রাখার জন্য ইথিওপিয়া যে বিশাল বাঁধ তৈরি করছে, তা নিয়ে ইথিওপিয়ার সঙ্গে সৃষ্ট উত্তেজনাও কায়রোকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। মিসর মনে করে, ক্ষমতাসীন সিসি সরকারের বিরোধী দেশগুলোর পরিকল্পনায় এই বাঁধ তৈরি করা হচ্ছে এবং এটি তৈরি হলে তাদের নীল নদের পানি পাওয়ার পুরো ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে।

লোহিতসাগরের হালায়েব ও সালাতিন-এই দুটি দ্বীপকে সৌদির সীমানাভুক্ত বলে সম্প্রতি মিসর ঘোষণা করার পর খার্তুমের সঙ্গে কায়রোর টানাপোড়েন বেড়ে যায়। এই দুটি দ্বীপকে সুদানের বলে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য মিসরকে অনুরোধ জানাচ্ছে সুদান। সুদান ও মিসরের এই মৌলিক সীমান্তসংকটকে ব্যবহার করে লোহিতসাগরের তীরবর্তী দেশগুলোর মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে দেওয়ার ঘোরতর চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এর মাধ্যমে আরবের ঐতিহাসিক শত্রু ইসরায়েল লাভবান হবে সবচেয়ে বেশি। এর মাধ্যমে নীল নদের পানির ওপর নির্ভরশীল দেশগুলোকে, বিশেষ করে মিসরকে ব্ল্যাকমেল করা ইসরায়েলের পক্ষে সহজ হবে।

অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

কামাল গাবালা: মিসরের সাংবাদিক ও আল আহরাম পত্রিকার কলাম লেখক