ডজন ডজন সৌদি টিভি

আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বিদেশ যাই সেমিনার-কনফারেন্সে। বিদেশে গেলে হাতে অনেক সময় থাকে। আমি এই সময়টা টেলিভিশন দেখার কাজেই বেশি ব্যয় করি। বিবিসি, আল-জাজিরা আর সিএনএন তো দেখিই, সাংবাদিকতার আজন্ম কৌতূহল থেকে অন্যান্য দেশের চ্যানেলও খুঁজে খুঁজে দেখি।

শেষবার বিদেশ সফরে এভাবেই একটা চ্যানেলে আটকে যাই। আরবি ভাষার চ্যানেল। অবাক চোখে সেটাই দেখি কিছুক্ষণ। সেখানে খবর শুধু এক ধাঁচের। সৌদি বাদশাহ বড় আসনে মাঝখানে বসে একটু পরপর কিছু বলছেন। তাঁর সামনে দুই কাতারে বসা মানুষ হেলেদুলে মাথা নেড়ে তা সমর্থন করছেন। আবার তিনি, আবার মাথা দোলানো বিগলিত মানুষ। তাঁর পর্ব শেষ হলে যুবরাজ সালমানের খবর। তিনিও কিছু বলেন আর অন্যরা সমানতালে মাথা নাড়েন।

আমি কিছুক্ষণ দেখি এসব। মিনিট পনেরো পর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলে টিভিই বন্ধ করে দিই। সৌদি আরবের এই দুর্বোধ্য চ্যানেলই আমাকে বলে দেয় গণতন্ত্র আর বাক্স্বাধীনতার কী অবস্থা সে দেশে।

মনে পড়ে নিজের দেশের কথাও। এরশাদের আমলে অনেকটা এমন সরকারি টিভিই দেখতাম না আমরা। বিটিভির তখন নাম দেওয়া হয়েছিল সাহেব-বিবি-গোলামের বাক্স। অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি পরে। তবে বেসরকারি টিভি চ্যানেল আসায় বিটিভির খবর নিয়ে আমার মাথা ঘামাতে হয়নি তেমন। সৌদি আরবে পে টিভি, স্যাটেলাইট টিভি থাকলেও সেখানকার মাটিতে বেসরকারি টিভি নেই। কাজেই আর যা-ই হোক, সৌদি টিভির সংবাদে বন্দী হয়ে থাকার মতো অবস্থা হবে না আমার দেশে। মনে মনে একটা ছোট তৃপ্তির ঢেকুরও আসে এসব ভেবে।

কিন্তু সেই তৃপ্তি আর থাকে না বেশি দিন। দেশে ফিরে দেখি ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট নামের আইনটি অনুমোদিত হয়ে গেছে মন্ত্রিসভায়। এই আইনটি ভালো করে পড়ে আক্কেল গুড়ুম হওয়ার অবস্থা। এটি অবিকলভাবে সংসদে পাস হলে এবং সরকার তা কঠোরভাবে প্রয়োগ করলে মানুষের বাক্স্বাধীনতা আরও বহুলাংশে খর্ব হবে। সরকারের লোকজন ব্যাংক লোপাট করলে, বড় বড় প্রকল্পের টাকা মেরে দিলে, মানুষজনকে অত্যাচার-নির্যাতন করলে তা নিয়ে আর অনুসন্ধানী রিপোর্ট করা যাবে না। অবস্থা এমনও হতে পারে যে বাংলাদেশের বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো একপর্যায়ে হয়ে যেতে পারে সৌদি টিভির মতো কিছু। সংবাদের নামে সেখানে রথী-মহারথীরা বাণী দেবেন, মোসাহেবরা স্মিত হেসে মাথা নাড়বেন। প্রটোকল জার্নালিজম ছাড়া আর কিছুই হবে না টিভি বা সংবাদপত্রে।

২.
নতুন আইনটির মাধ্যমে আইসিটি আইনের চরম নিবর্তনমূলক ৫৭ ধারা বাতিল হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এটিতে আসলে ৫৭ ধারার সব কটি খারাপ বিধান বিভিন্ন ধারায় ভাগ করে ঢোকানো হয়েছে। নতুন করে ৩২ ধারা ঢুকিয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পথ রুদ্ধ করা হয়েছে।

৩২ ধারা মেনে চললে দুর্নীতি, অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনা তুলে ধরা যাবে কেবল এসব অপরাধের অভিযোগ যাঁর বিরুদ্ধে তিনি নিজেই তথ্য-উপাত্ত ও দলিল দিলে। অথবা সরকার নিজেই এ-সংক্রান্ত কোনো শ্বেতপত্র বা তদন্ত রিপোর্টের তথ্য সাংবাদিকদের জানালে। প্রথমটি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কেউ নিজের দুর্নীতির খবর সাংবাদিকদের জানাবেন না। বাকি থাকে সরকারের উচ্চতর কর্তৃপক্ষ যদি তদন্ত করে কোনো তথ্য প্রকাশ করে। কিন্তু বাংলাদেশের সরকারগুলো এমন তদন্ত করে থাকে কেবল অতীতের প্রতিপক্ষ সরকারের বিরুদ্ধে। নিজেদের আমলে নিজেদের লোকের বিরুদ্ধে বিপাকে পড়লে তদন্ত হয় মাঝে মাঝে, কিন্তু তার রিপোর্ট সরকার গোপন রাখে। ফলে নতুন আইনে তা প্রকাশ করার সাধ্য থাকবে না কারও।

৩২ ধারার অনেক সমালোচনা হচ্ছে এখন। তবে আমার বিবেচনায় সমালোচনা করতে হবে এই আইনের অধিকাংশ পেনাল প্রভিশনের উদ্দেশ্য নিয়ে। কয়েক দিন আগে একটি সেমিনারে অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক এই আইনের প্রকৃতিগত দুষ্ট দিকটি তুলে ধরেন। তিনি জানান, গণতান্ত্রিক বিশ্বে ফৌজদারি অপরাধ হয় দৃশ্যমান ক্ষেত্রে। অর্থাৎ শরীর (যেমন খুন, অপহরণ) বা সম্পত্তির (যেমন চুরি-ডাকাতি) বিরুদ্ধে যেসব অপরাধ, শুধু সেসবের জন্য ফৌজদারি কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়। মানহানির মতো যেসব অপরাধ মূলত মানুষের বোধ ও অনুভূতির বিরুদ্ধে, তা দেওয়ানি অপরাধ। এসব অপরাধের শাস্তি হয় অর্থদণ্ডের মাধ্যমে। অথচ ৫৭ ধারার মতো ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনেও এসব অপরাধকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে দেখানো হয়েছে।

নতুন আইনে শুধু মানহানি নয়, ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ÿক্ষুণ্ন হয় বা কেউ অসৎ বা নীতিভ্রষ্ট হয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে এমন কিছু ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রকাশ করাও ফৌজদারি অপরাধ। এ আইনের অপপ্রয়োগ হলে তা মারাত্মক অবস্থা সৃষ্টি করতে পারে। যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্ট থেকে টাকা পাচারের জঘন্য অপরাধের কথা আমরা জানি। এ-সংক্রান্ত যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, তার রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়নি। অথচ ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনটি অনুসারে কোনো সাংবাদিক এই তদন্ত রিপোর্টের কোনো অংশ ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ করলেই তাঁর শাস্তি হবে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড। স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি এখানে আসলে ÿক্ষুণ্ন করল কে? বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা লোপাটের জন্য দায়ী দুষ্কৃতকারীরা, তদন্ত রিপোর্ট ঝুলিয়ে রেখে বিচার ব্যাহত করার জন্য দায়ী ব্যক্তিরা, নাকি এই রিপোর্ট প্রকাশ করে আইনের শাসনের পথে অবদান রাখা সাংবাদিক?

ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট অনুসারে অপরাধটি করেছেন সাংবাদিক!

৩.
যেসব দেশে বিচার বিভাগের ওপর নানাভাবে সরকারের হস্তক্ষেপের সুযোগ থাকে এবং যেসব দেশে জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানগুলো (সংসদীয় কমিটি) মূলত সরকারের আজ্ঞাবাহী হয়, সেখানে এমন আইনের অপপ্রয়োগের সুযোগ থাকে আরও বেশি। আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারার ক্ষেত্রে বারবার এমন ঘটনা ঘটতে দেখেছি। এই আইনে শুধু ফেসবুকে বিভিন্ন পোস্টের কারণে যেসব মামলা হয়েছে, তার প্রায় সবগুলো সরকারি দলের লোকজনের করা মামলা। বিরোধী দল বা ভিন্নমতের মানুষের বিরুদ্ধে ফেসবুকে নানা মিথ্যা প্রচারণা থাকা সত্ত্বেও এই আইনে তাদের পক্ষে মামলা হয়নি।

৫৭ ধারা হয়ে গিয়েছিল একপক্ষীয় মামলা এবং হয়রানি-ভোগান্তির হাতিয়ার। এই ধারার কতটা অপপ্রয়োগ হয়েছে, তার একটি প্রমাণ হচ্ছে মানহানি-সংক্রান্ত মামলাগুলো। ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে মানহানির মামলা করতে পারেন যাঁর মান ক্ষুণ্ন হয়েছে তিনি, অর্থাৎ সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি। অথচ ৫৭ ধারায় এসব মামলা করেছেন সরকারি মন্ত্রী বা নেতা-কর্মীরা, আদালত তা গ্রহণও করেছেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে। আশঙ্কা হচ্ছে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের তা-ই হবে।

এই আইনে পুলিশকে পরোয়ানা ছাড়াই সন্দেহবশত তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, ক্ষমতার অপব্যবহার হলেও পুলিশকে আইনি সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে, তথ্যাধিকার ও মানবাধিকার-সংক্রান্ত আইনের ওপর এর প্রাধান্য ঘোষিত হয়েছে। এমন বহু বিষয় এই আইনে রয়েছে, যা ক্ষমতাশালী ও বিত্তশালী মানুষের অনাচারকে নির্বিঘ্ন করে তুলবে।

৪.
মন্ত্রীরা বলছেন এই আইনে কিছু অপরাধকে জামিনযোগ্য করা হয়েছে। কিন্তু ৫৭ ধারার যে ধরনের মামলাগুলো নিয়ে মানুষকে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে ফেলা হয়েছে, তার অনেকগুলো আসলে অজামিনযোগ্যই রাখা হয়েছে নতুন আইনে। ৩২ ধারাও অজামিনযোগ্য অপরাধ।

এই আইনে কিছু অপরাধের শাস্তি কিছুটা কমানো হয়েছে। কিন্তু অপরাধ প্রমাণের পর শাস্তির আগেই ভুয়া ও বিদ্বেষপ্রসূত মামলায় সাধারণ মানুষ নানাভাবে হয়রানি, ভোগান্তির শাস্তি পেয়ে যায়।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনী না আনা হলে সেই শাস্তির খড়্গ ঝুলতেই থাকবে। সৌদি টিভির মাথা দোলানো মানুষের মতো নতশিরের মানুষে পরিণত হতে হবে আমাদের সবাইকে।

আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক