'ভালোবাসা ছাড়া দুনিয়া মিছা'

ফাগুন দিনে ভালোবাসার ফুল। ঢাকা, ১৩ ফেব্রুয়ারি। ছবি: সাইফুল ইসলাম
ফাগুন দিনে ভালোবাসার ফুল। ঢাকা, ১৩ ফেব্রুয়ারি। ছবি: সাইফুল ইসলাম

কমলা রঙের একটি গোলাপ। ৭০ টাকা চাইল দোকানি। উদ্‌গ্রীব তরুণ দাম শুনে একটু থমকে গেল মনে হলো। কারণ, দোকানির কথায় রসকষ একদম নেই। কথার ঢঙেই বোঝা যায়, এ দাম থেকে একচুলও নড়বে না সে।

‘আর ওটা?’ বাসন্তী রং গোলাপের দিকে আঙুল তুলল তরুণ।

‘এইটা ৯০ টাকা।’

‘একটু কমানো যায় না?’

‘কমামু ক্যামনে? এই দামেই তো দিয়া কুলাইতে পারি না!’

এই বলে দোকানি লাল টুকটুকে গোলাপ দেখিয়ে বলল, ‘এইটা নেন। ৪০ টাকায় পাইবেন।’

তরুণ মাথার ঝাঁকড়া এল চুল ঠিক করে গোলাপ কেনার প্রস্তুতি নিল। শুধু হলুদ গোলাপই নয়, কমলাটাও কিনল। হেসে বললাম, ‘কিনেই ফেললেন?’

অমনি লাজুক হাসি। বলল, ‘কী করব, কিনতে যে হবেই।’

আমাকে বলার কোনো প্রয়োজন নেই। তবু যেন মনের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতেই বলল, ‘হলুদটা আজকের এই বসন্তের জন্য। কমলাটা কালকের।’

এ ঘটনা গতকাল মঙ্গলবার পয়লা ফাল্গুন সন্ধ্যার। ঢাকার তাজমহল রোডে এক ফুলের দোকানের সামনে। হাসিমুখে হলুদ-কমলা দুটো ফুল নিয়ে চলে যায় তরুণ। তার মাথাভরা উষ্কখুষ্ক চুল। পিঠে ঢাউস ব্যাকপ্যাক। বোঝা যায়, সারা দিন কাজের তুফানে আবেগ-অনুভূতি চাপা পড়ে ছিল। এখন বুকের ভেতর পাহাড়ি ঝরনা নেমেছে। তরুণ যে ভালোবাসার ঘ্রাণটা রেখে গেছে, তার সুবাস আমাকে কল্পনায় ভাসায়। দেখতে পাই, প্রিয়জনকে আজ বাসন্তী গোলাপটা দেবে সে। কমলাটা রেখে দেবে কালকের জন্য। ফুলদানি থাকলে তো ভালো। নয় তো কোনো কাপ বা গ্লাসে একটু পানি দিয়ে ফুলেল সতেজতা জিইয়ে রাখবে সে। তারপর যথাসময় সেই ফুল যাবে কমনীয় একটি হাতে। সুবাসহীন সুন্দর এই ফুল তখন ভালোবাসার সুতীব্র সুবাস ছড়াবে।

এভাবেই আমাদের নগরজীবনে আসে ভ্যালেন্টাইনস ডে। আমরা ভালোবাসার আলোয় আলোকিত হই। একে অপরকে ফুল দিয়ে ভালোবাসা জানাই।

এক নারী এলেন ফুল কিনতে। দাম শুনে গলা সপ্তমে চড়ালেন। দোকানিও দামে গোঁয়ার-গোবিন্দ। ওই নারী তিরিক্ষি মেজাজে সুন্দর এক ফুলের তোড়া নিয়ে গেলেন। অন্য সময় এ তোড়ার দাম বড়জোর ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। এখন নিলেন ২৫০ টাকায়। ফুলের মাঝে জাদু আছে। জানি, গন্তব্যে ফিরতে ফিরতে ফুলের মাধুর্যে তাঁর মন থেকে সব খেদ মুছে যাবে। ফুটবে আপন মাধুরী।

রাস্তার পাশে ভ্যানে করে কুল বিক্রি করছেন একজন। ঘ্যাচ করে এসে ব্রেক কষলেন এক স্কুটারচালক। কুল কিনবেন তিনি। আলাপ জমানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু রবিউল নামের এই যুবক মহাবিরক্ত। বলেন, ‘আইজ সারা দিন মাইনষের জ্বালা। কুনহানে গিয়া শান্তি পাইলাম না! খালি জ্যাম আর জ্যাম! দিনডাই মাটি! এক শ একটা দিবস হেগোর লাগে!’

এই ‘হেগোর’ বলতে তিনি কী বোঝালেন, তা তিনিই জানেন। বললাম, ‘কাল তো আরেকটা দিবস আছে।’

‘হ, ভালোবাসা দিবস।’

এই বলে গাল চুলকালেন রবিউল। বললেন, ‘ভালোবাসার দরকার আছে। আমার চাইর বছরের পোলাডা কুল খাইতে চাইছে। এই জন্যই তো স্কুটার থামাইলাম। ভালোবাসা ছাড়া দুনিয়া মিছা!’

ভালোবাসা আসলে এক দিন-দুদিনের বিষয় নয়। ভালোবাসার নদী বয়ে চলে নিরবধি। ভালোবাসা কারও কাছে ফুল, কোনো ঘরে-বা কুল হয়ে ফেরে।

প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় যখন তাঁর সেই বিখ্যাত ‘ফুলের মূল্য’ গল্পটি লেখেন, ওই সময় ভারতবর্ষে ফুল কেনাবেচা হতো না। এমনিই এখানে-সেখানে প্রচুর ফুল পাওয়া যেত। ওই সময় মানুষ এই ফুল দিয়েই ভালোবাসা জানাত। এখন ভালোবাসার ফুলে আর্থিক মর্যাদা যোগ হয়েছে। কিন্তু ফুলের সেই সুবাস একই রয়েছে। এই সুবাস আজ ছড়িয়ে পড়ুক সব মানুষের ঘরে।

শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
[email protected]