চিলমারির বানভাসিদের সঙ্গে অন্যায় কেন?

ব্রহ্মপুত্রপারের বাসিন্দারা খেপে গেলে বলেন, ‘হামরা কি বানত ভাসি আইসছি?’ মানে, আমি কি বংশপরিচয়হীন মানুষ? মানুষের কত পরিচয় থাকে। পরিচয় না থাকাও একটা পরিচয়ে দাঁড়িয়ে যায়। পরিচয়হীন মানুষের স্থানীয় পরিচয় বাঁধের বাসিন্দা। ১৯৮৮ সালের মতো বন্যায় যাঁরা সব হারিয়েছেন, আক্ষরিক অর্থেই সর্বহারা তাঁদের ঠিকানা কুড়িগ্রামের নদ-নদীর পাশের পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) এই বাঁধ। তাঁদের সঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দারা আত্মীয়তা করতে চান না। সাংস্কৃতিক তুচ্ছতার শিকার হন তাঁরা। তাই যাঁদেরই একটু জমি কিনে বাড়ি করার সামর্থ্য অর্জিত হয়, তাঁরাই আর বাঁধে থাকেন না। জমি কিনে নতুন বাড়ি করেন। গত ৭ জানুয়ারি (যদিও বাঁধের বাসিন্দারা নোটিশ পেয়েছেন ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে) এই বাঁধের বাসিন্দাদের উদ্দেশে উপবিভাগীয় প্রকৌশলীর দপ্তর উলিপুর, কুড়িগ্রাম থেকে জানায়: ‘আপনার অবস্থানের কারণে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে বাঁধটি বন্যা মোকাবিলায় যথেষ্ট কার্যকর রাখা সম্ভব হচ্ছে না...এমতাবস্থায় পত্র ইস্যুর ১৫ (পনেরো) দিনের মধ্যে স্থাপনাসমূহ অপসারণের জন্য অনুরোধ করা হলো। অন্যথায় আপনার/আপনাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ (স্মারক নং উলি/উপ্রবি/এল-১/১৭৬৬ এর জরুরি নোটিশ)

বাঁধে বসতি স্থাপন বাঁধের ক্ষতি তো করেই না, বরং সেটাই বাঁধগুলোকে টেকসই করার সহায়ক উপায়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ নঈম গওহর ওয়ারা প্রথম আলোয় লিখেছেন, ‘...এবারেও অনেক জায়গায় বাঁধ ভেঙে পানি লোকালয়ে ঢুকেছে। যেখানে গাছ ছিল না, সেখানেও মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশি। বাঁধ নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব এলাকার ভূমিহীনদের দিতে হবে। ১৯৯২-৯৩ সালে ভোলায় ওয়াটার বোর্ড, স্থানীয় সরকার ও এনজিওরা মিলে মানুষকে দিয়ে বাঁধ বানিয়েছিল। যারা বানাতে শ্রম দিয়েছিল, তারাই এর ওপর ঘর বানিয়ে বাস করে, গাছপালা লাগায়, বাঁধের রক্ষণাবেক্ষণ করে। সেই বাঁধ এখনো আছে।’ ১৯৮৮ সালের বন্যার পর গাইবান্ধায় যে বাঁধ বানানো হয়, তার ওপরও ভূমিহীনদের থাকার বন্দোবস্ত করা হয় বাঁধের সুরক্ষার জন্যই।

পটুয়াখালী, ভোলা বা গাইবান্ধায় যা সত্য ও সঠিক, তা কেন উলিপুরে সত্য হবে না? অথচ এই বাঁধ-বাসিন্দারাই আজ উচ্ছেদের মুখে। অভিজ্ঞতা থেকেও জানি, এযাবৎ যত জায়গায় বাঁধ ছিঁড়েছে বা ভেঙেছে, কোথাও বসতি করার কারণে তা ঘটেনি। বরং বাঁধের পাদদেশে বাড়ি করার কারণে তা আরও টেকসই হয়েছে। কারণ, বাঁধের পাশে বাড়ি থাকলে বানের পানিকে ওই বেড়া ঠেকনা বা প্রতিরোধ হিসেবে ভূমিকা নেয়। পানির ঢেউ ঠেকিয়ে বাঁধের ক্ষয় রোধ করে। তা ছাড়া ইঁদুর ও পোকামাকড়ের বসতি হওয়ার সুযোগ থাকে না, যা গর্ত করে বাঁধকে বানের সময় ধসিয়ে দিতে পারে। সেটা হয় না বাড়ির সদস্যদের নজরদারির কারণে। এরপর বাড়ির সদস্যরা নিজের পুষ্টির চাহিদা মেটাতে যে ফলফলাদির গাছ লাগায়, তাও মাটিকে শক্ত করে। গত কয়েক বছরের বন্যায় যেসব জায়গায় বাঁধ ধসে গিয়ে শহর এলাকাকে প্লাবিত করেছে, সেসব জায়গায় কোনো বাড়িঘর ছিল না। বাঁধের জমির আগের মালিকেরা যদি বসতি স্থাপনে বাধা না দিতেন আর বাঁধ নির্মাণকালে ত্রুটি না থাকত ও কর্তৃপক্ষে যথাযথ নজরদারি থাকত, তাহলে শহর এলাকা প্লাবিত হওয়ার দুর্ঘটনা ঘটত না। অর্থাৎ বাঁধে জনগণের বসতিই বাঁধের টেকসই হওয়ার নিশ্চয়তা।

তাই বাঁধের বাসিন্দাদের উচ্ছেদ কেবল অমানবিকই নয়, তা অবৈজ্ঞানিকও। তার ওপর এসব মানুষের যাঁদের জমি নদীতে জেগে উঠেছে, তাঁরা যে বাড়িঘর সেখানে সরাবেন, তার জন্য কোনো সময় বরাদ্দ নেই, সিস্টেমই টাইম খেয়ে ফেলে। বরাবরের মতো এখানে ভুক্তভোগী জনগণ নোটিশ পেয়েছেন, নোটিশ ইস্যুর মাস খানেক পর। তারপর আছে তাঁদের বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার জন্য ঔপনিবেশিক সেই দৃষ্টিভঙ্গি, যা সব সময় জনগণকে দোষী করে। ফখরুদ্দীন সরকারের আমলে রাজারভিটায় বাঁধ নির্মাণের সময় জনগণের কাছে মতামত চেয়ে নোটিশ দেওয়া হয়েছিল মতামত প্রদানের শেষ দিনের অফিস টাইমের পর। এখানেও তা-ই হয়েছে। আর যাঁদের অবস্থা শশীবালাদের মতো, তাঁরা বাঁধের পাদদেশে খাস ও পতিত থাকা ৯০ ফুট জায়গার একটি টুকরো চান কিংবা ব্রহ্মপুত্রের বুকে হাজার হাজার বিঘা খাসজমির একটু টুকরা চান; যে জমি একদিন তাঁদের ছিল, যে জমি আইনের প্যাঁচে খাসতালুক হয়েছে লাঠিয়ালদের। এই চাওয়াটা কি খুব বেশি?

এই বাঁধের মানুষদের হাত আর পা-ই সার। মানে শ্রম বিক্রি করা ছাড়া তাঁদের পথ নেই। কিন্তু তাঁরা যে কারখানায় গিয়ে শ্রমিকে উন্নীত হবেন, সেই কারখানাও নেই। আজ এক জাতির মধ্যে দুই জাতি। একদিকে আছে যারা নিয়ে নিয়ে পিরামিডের চূড়ায় পৌঁছে গেছে আর অন্যদিকে যারা পায়নি কিছুই, যারা আজকের বানভাসি। কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারীতে ৭৭ শতাংশ দরিদ্র্য লোকের বাস। গরিবের মধ্যে গরিব হচ্ছেন এই বানভাসি বাঁধের বাসিন্দারা। তাঁদের মধ্যে একজন পুত্র-কন্যাহীন বিধবা সত্তরোর্ধ্ব শশীবালা। তিনি ৯ ফেব্রুয়ারি চিলমারীর পাত্রখাতা স্লুইসগেটে বলেন, ‘হামাক গুলি করে করুক জেলত নিবে? কী হেবে, ভাত খোয়াইবে ত!’ এই দেশটার জন্য শশীবালারা অকাতরে প্রাণ দিয়েছেন। তাঁরা খড়কুটোর মতো বাঁধকেই আশ্রয় মেনেছেন। একদিন পরিচয় ছিল, আজ অপরিচিতের সরণিতে। আমরা তাঁদের চিনতে পাচ্ছি না!

লেখক: প্রধান সমন্বয়ক, রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি।
[email protected]