তথ্যপ্রযুক্তি গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে?

কফি আনান
কফি আনান

একটা সময় ছিল যখন গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার নতুন সুযোগ সৃষ্টির জন্য ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে স্বাগত জানানো হতো। টুইটার, ফেসবুক এবং অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এ ক্ষেত্রে জোরালো ভূমিকা রেখেছেও। বিশেষত ২০০৯ সালে ইরানে, ২০১১ সালে আরব বিশ্বে এবং ২০১৩-১৪ সালে ইউক্রেনে গণজাগরণের নেপথ্যে এগুলোর খুব জোরালো ভূমিকা ছিল। সে সময় একেকটি টুইট বার্তাকে তরবারির চেয়ে শক্তিশালী মনে হতো।

এরপরই কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো ইন্টারনেট স্বাধীনতার ওপর নিয়ন্ত্রণের থাবা বসিয়ে দেয়। এই সাহসী ডিজিটাল বিশ্বকে তাদের ভয় এ কারণে যে, এটি তাদের অ্যানালগ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ভর করে যতগুলো গণ-আন্দোলন বা গণজাগরণ হয়েছে, তার বেশির ভাগই যোগ্য নেতৃত্ব সামনে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা সেই প্রথাগত রাজনৈতিক নেতা কিংবা সামরিক প্রতিষ্ঠানের হাতেই চলে গেছে।

আসলে সরকারগুলো তাদের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করা শুরু করে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের কথা আমরা সবাই কমবেশি জানি। বলা হয়ে থাকে, দেশটি ইউক্রেন, ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন প্রভাবিত করতে ব্যাপকভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করেছে। ফেসবুকের হিসাবমতে, ফেসবুকে যত পোস্ট এবং বিজ্ঞাপন আসে, তা ১২ কোটি ৬০ লাখ আমেরিকানের কাছে, অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৪০ শতাংশ নাগরিকের কাছে পৌঁছায়।

আমাদের স্মরণে আছে, ইউক্রেন ও জর্জিয়ায় ‘কালার রেভল্যুশন’-খ্যাত সরকারবিরোধী গণ-আন্দোলন উসকে দিতে পশ্চিমা দেশগুলো পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে বলে রাশিয়া অভিযোগ করত। এখন মনে হচ্ছে, ইন্টারনেট এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম জনমানস পরিবর্তনে তৎপর চোরাগোপ্তা শক্তিগুলোর নতুন লড়াইয়ের ময়দান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

ইন্টারনেটের কারণে এখন যেখানে প্রযুক্তিগতভাবে সবচেয়ে উন্নত দেশগুলোর পক্ষেও নির্বাচন-প্রক্রিয়াকে সর্বাংশে স্বচ্ছ রাখা সম্ভব হয় না, সেখানে তথ্যপ্রযুক্তিগত দিক থেকে দুর্বল দেশকে কী পরিমাণ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়, তা যে কেউ অনুমান করতে পারে। যখন একটি দেশের সরকারের ওপর জনগণের আস্থা আগে থেকেই কম এবং কর্তৃপক্ষের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত থাকে না; এ অবস্থায় অপপ্রচারের মাধ্যমে ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করে নির্বাচন এবং গণতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করা সহজ হয়ে যায়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মতাদর্শগত পরিমণ্ডল জনগণের প্রকৃতিগত পক্ষপাতদুষ্টতাকে আরও উসকে দেয় এবং সুষ্ঠু বিতর্কের সুযোগকে নস্যাৎ করে দেয়। এটি রাজনৈতিক মেরুকরণ বাড়ায় এবং গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতার জন্য যেটি অপরিহার্য, সেই রাজনৈতিক নেতাদের আপসকামী মনোভাবকে ক্ষয়িষ্ণু করে ফেলে। একইভাবে ইন্টারনেটে বিদ্বেষ-ভাষণ, সন্ত্রাসের আহ্বান এবং বর্ণবাদী ও যৌন হেনস্তামূলক পোস্ট সমাজে সহিংসতা বাড়িয়ে দিতে পারে।

তবে তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লব ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমই যে প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক ব্যবস্থার সামনে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে, তা নয়। ছাপা সংবাদপত্র, রেডিও এবং টেলিভিশন-এগুলোর সবই নিজ নিজ সময়ে বিপ্লবী ভূমিকা রেখেছে। এসব তথ্যমাধ্যমকে সবচেয়ে উদার গণতান্ত্রিক দেশেও সুকৌশলে কমবেশি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। গতানুগতিক গণমাধ্যমের স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও করারোপ বিষয়ে যে নিয়মনীতি অনুসরণ করা হয়, একই নিয়মনীতির আওতায় কীভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে আনা যায়, সেটি এখন অনিবার্যভাবেই আমাদের ভাবতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রে সিনেটরদের একটি গ্রুপ ‘অনেস্ট অ্যাড অ্যাক্ট’ নামের একটি আইন প্রস্তাব করেছেন। এই আইনে ছাপা পত্রিকা, রেডিও এবং টেলিভিশন পরিচালনা-বিধিকে সম্প্রসারণ করে এর মধ্যে সামাজিক মাধ্যমকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই গ্রুপটি আশা করছে, ২০১৮ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগেই প্রস্তাবটি আইন আকারে পাস হবে। জার্মানিতে পাস করা একটি নতুন আইনে বলা হয়েছে, সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলোকে তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ঘৃণা ছড়ানো বক্তব্য ও ভুয়া খবর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সরিয়ে ফেলতে হবে। অন্যথায় তাদের ৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার পর্যন্ত জরিমানা দিতে হতে পারে।

এসব আইন হয়তো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে, তবে অনলাইন পলিটিক্যাল অ্যাকটিভিটি নিয়ন্ত্রণে এসব আইন পুরোপুরি সমর্থ হবে কি না, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই। অনেক গরিব দেশের পক্ষে এ ধরনের প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব নয়, সবখানে এ ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভবও নয়। ইন্টারনেটের স্বাধীনতার বাহুল্য ছেঁটে ফেলার ক্ষেত্রে আমাদের খুবই সতর্ক থাকতে হবে। মানুষের মতপ্রকাশের মৌলিক অধিকারকে আমরা কোনোভাবেই অচল করে দিতে পারি না। আবার সব ছেড়ে দিয়ে আমাদের একেবারে বসে থাকলেও চলবে না।

স্বচ্ছ ও অবাধ নির্বাচন-প্রক্রিয়ার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ২০১২ সালে আমার আহ্বানে নির্বাচন, গণতন্ত্র ও নিরাপত্তার বিষয়ে গ্লোবাল কমিশনের একটি সম্মেলন হয়। সেখানে বলা হয়, একমাত্র জনগণের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনই নেতৃত্বের শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক পালাবদল ঘটাতে পারে। এমন নির্বাচনই বিজয়ী পক্ষকে বৈধতা এবং পরাজিত পক্ষকে সুরক্ষা দিতে পারে।

কফি আনান ফাউন্ডেশনের পৃষ্ঠপোষকতায় আমি এখন নতুন একটি কমিশন গঠন করতে যাচ্ছি। গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি সামনে রাখার জন্য রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যাঁরা মূল মাথা, তাঁদের এই কমিশনে রাখা হবে। আমরা কিছু সুপারিশ করব। আশা করি, এই সুপারিশগুলো প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং মানবসভ্যতার সবচেয়ে বড় অর্জন গণতন্ত্রের মধ্যকার উত্তেজনা প্রশমন করবে।

প্রযুক্তি এক জায়গায় স্থির থাকে না। গণতন্ত্রেরও স্থবির হয়ে থাকার কথা নয়। ফলে আমাদের দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ, কোটি কোটি মোবাইল ফোনের সেন্সর ও অন্যান্য ডিভাইসের মাধ্যমে আমাদের যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত গোটা ইন্টারনেট জগৎ নিয়ন্ত্রণে রাখা ‘বড় ভাইদের’ হাতে চলে যাচ্ছে এবং তাঁরা তাঁদের উদ্দেশ্য হাসিলে এসব ব্যবহার করে আমাদের বিপর্যয়কর অবস্থায় ফেলে দিচ্ছেন।

আমাদের ফোন এবং ঘড়ির মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া এসব ডেটার মালিক কে হবে? এই ডেটা কীভাবে ব্যবহার করা হবে? আমাদের অনুমতি ছাড়াই কি অন্যরা সেগুলো ব্যবহার করতে পারবে? আমাদের ডেটা যারা ব্যবহার করবে, তাদের জবাবদিহি কাদের কাছে থাকবে? এগুলোই এখন বড় প্রশ্ন। এই প্রশ্নগুলোই আমাদের ভবিষ্যতের কাঠামো বিনির্মাণ করবে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

কফি আনান: জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব ও বর্তমানে কফি আনান ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান