বাংলাদেশ কীভাবে আরও ভালো করবে

২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) কর্তৃক প্রকাশিত দুর্নীতির ধারণা সূচক ২০১৭ অনুযায়ী, শূন্য থেকে ১০০ স্কেলে বাংলাদেশ ২৮ স্কোর পেয়েছে, যা ২০১৬-এর তুলনায় ২ পয়েন্ট বেশি। ১৮০টি দেশের মধ্যে তালিকায় নিম্ন অবস্থান অনুযায়ী বাংলাদেশ ১৭ তম স্থান পেয়েছে, যা ২০১৬-এর তুলনায় ২ ধাপ ওপরে। উচ্চ অবস্থান অনুযায়ী এবার বাংলাদেশ ১৪৩ তম, যা ২০১৬-এর তুলনায় ২ ধাপ ওপরে। ২০০১-এ প্রথমবারের মতো এই সূচকে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর বাংলাদেশের এবারের স্কোর সবচেয়ে বেশি। এর আগে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ স্কোর ছিল ২৭,২০১৩ সালে। এবার বাংলাদেশের সমান স্কোর পেয়েছে গুয়াতেমালা, কেনিয়া, লেবানন ও মৌরিতানিয়া।

বাংলাদেশ এখনো এই সূচকের বৈশ্বিক গড় ৪৩-এর তুলনায় অনেক কম, অর্থাৎ দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে মধ্যম মাত্রায় সাফল্য অর্জন থেকে এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছে। তদুপরি, দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি দেশের মধ্যে এবারও বাংলাদেশের অবস্থান বিব্রতকরভাবে আফগানিস্তানের পর দ্বিতীয় সর্বনিম্ন এবং এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ৩১টি দেশের মধ্যে চতুর্থ সর্বনিম্ন। আফগানিস্তান ছাড়া অপর যে দুটি এশীয় দেশ বাংলাদেশের তুলনায় নিম্নতর, তারা হচ্ছে উত্তর কোরিয়া ও কম্বোডিয়া।

১৯৯৫ সাল থেকে প্রণীত দুর্নীতির ধারণা সূচক বা সিপিআই (করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স) সরকারি খাতে, বিশেষ করে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতির ব্যাপকতা সম্পর্কে ধারণা তথ্যের বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন দেশের তুলনামূলক চিত্র প্রদান করে থাকে। সূচকে ১৩টি আন্তর্জাতিক জরিপ তথ্যের বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই সূচকে এমন জরিপের তথ্যই ব্যবহৃত হয়, যার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা সম্ভব। টিআইবি বা অন্য কোনো দেশের টিআই চ্যাপ্টারের গবেষণা বা জরিপলব্ধ কোনো তথ্য এই সূচকে বিবেচিত হয় না। অন্যদিকে সূচকে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য কোনো দেশ সম্পর্কে কমপক্ষে তিনটি আন্তর্জাতিক জরিপ থাকতে হয়।

সূচকটি টিআইয়ের বার্লিনভিত্তিক সচিবালয়ের গবেষণা বিভাগ কর্তৃক প্রণীত হয়। সিপিআইয়ের পদ্ধতি নির্ধারণ করেন যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ এবং ইতালির মিলানে বকোনি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের বিশেষজ্ঞরা। জার্মান ইনস্টিটিউট অব ইকোনমিক রিসার্চ এবং মেক্সিকোর মন্টেরে ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি অ্যান্ড হায়ার এডুকেশনের বিশেষজ্ঞরা সূচকের স্কোর পর্যালোচনা, তথ্য ও বিশ্লেষণের যথার্থতা যাচাই করে থাকেন।

যে ৮টি সূত্র থেকে এবারের সূচকে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে, সেগুলো হলো ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম এক্সিকিউটিভ ওপিনিয়ন সার্ভে, ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের কান্ট্রি রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট, বার্টলসম্যান ফাউন্ডেশন ট্রান্সফরমেশন ইনডেক্স, গ্লোবাল ইনসাইড কান্ট্রি রিস্ক রেটিংস, পলিটিক্যাল রিস্ক সার্ভিসেস ইন্টারন্যাশনাল কান্ট্রি রিস্ক গাইড, বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি পলিসি অ্যান্ড ইনস্টিটিউশনাল অ্যাসেসমেন্ট, ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্টের রুল অব ল ইন্ডেক্স এবং ভ্যারাইটিজ অব ডেমোক্রেটিক ডেটাসেট। তথ্য সংগ্রহের মেয়াদ জানুয়ারি ২০১৬ থেকে সেপ্টেম্বর ২০১৭ পর্যন্ত।

দক্ষিণ এশিয়ায় ভুটান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও বাংলাদেশের স্কোর ২ পয়েন্ট করে বেড়েছে; পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের স্কোর অপরিবর্তিত রয়েছে এবং মালদ্বীপের ৩ পয়েন্ট কমেছে। ২০১৬ সালে স্কোর বেড়েছিল ৬৩টি দেশের ক্ষেত্রে, এবার ৮১টি দেশের ক্ষেত্রে স্কোর বেড়েছে। ২০১৬ সালে ৭১টি দেশের তুলনায় এবার ৬১টি দেশের (প্রায় ৩৩ শতাংশ) স্কোরে অবনতি হয়েছে।

সার্বিক বিবেচনায়, দুর্নীতি একটি বৈশ্বিক সমস্যা, যদিও আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে দুর্নীতির চ্যালেঞ্জ অনেক বেশি উদ্বেগের কারণ। স্মরণ করা যেতে পারে যে ২০০১ থকে ২০০৫ পর্যন্ত পরপর পাঁচবার বাংলাদেশ সর্বনিম্ন স্থানে ছিল। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ২০০৬ সালে তৃতীয়, ২০০৭ সালে সপ্তম, ২০০৮ সালে ১০ তম, ২০০৯ সালে ১৩ তম, ২০১০ সালে ১২ তম, ২০১১ ও ২০১২ সালে ১৩ তম, ২০১৩ সালে ১৬ তম, ২০১৪ সালে ১৪ তম, ২০১৫ সালে ১৩ তম, ২০১৬ সালে ১৫ তম এবং ২০১৭ সালে ১৭ তম স্থান পাওয়ায় কিছুটা স্বস্তি যৌক্তিক বটে। তবে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে কমপক্ষে মধ্যম পর্যায়ের সাফল্য অর্জনের সম্ভাবনা সুদূরপরাহতই থেকে যাচ্ছে।

যেসব কারণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হচ্ছে না, তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে দুর্নীতিবিরোধী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতি। যারা দুর্নীতিতে লিপ্ত, বিশেষ করে উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতির ক্ষেত্রে কিছু কিছু বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া জবাবদিহি নিশ্চিতের দৃষ্টান্তের অভাব প্রকট। ঋণখেলাপিতে জর্জরিত রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতি ও জালিয়াতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের, বিশেষ করে মূল ভূমিকা যাঁদের, তাঁরা সরকারের প্রভাবশালী পদে অধিষ্ঠিতজনের মতে ‘নিজেদেরই লোক’ হওয়ার কারণে জবাবদিহির ঊর্ধ্বেই থেকেছেন।

রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকিং খাতের সংকটের সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় লালিত বেসরকারি ব্যাংকের নজিরবিহীন আর্থিক কেলেঙ্কারি। বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ পাচারের পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত সরকারের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। তদন্ত কমিটির সুস্পষ্ট ইঙ্গিত এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের তদন্ত অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের একাংশের সংশ্লিষ্টতার সম্ভাবনার অভিযোগ আমলে নিয়ে দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে জবাবদিহি নিশ্চিতে কোনো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ দেখা যায়নি। একদিকে ব্যক্তির অবস্থান ও পরিচয়ের প্রাধান্য, অন্যদিকে অস্বীকৃতির মানসিকতা দুর্নীতির সুরক্ষা ও বিচারহীনতা সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাচ্ছে।

এবারের সূচকে ব্যবহৃত তথ্যের মেয়াদে দুর্নীতি দমন কমিশনের তৎপরতা সীমাবদ্ধ ছিল নিম্ন ও মধ্যম পর্যায়ের দুর্নীতির ক্ষেত্রে। জবাবদিহির সার্বিক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দুর্বলতর হয়েছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক অঙ্গনে একচ্ছত্র আধিপত্যে গণতান্ত্রিক জবাবদিহির মৌলিক প্রতিষ্ঠানসমূহের দলীয়করণ প্রকটতর হয়েছে। সরকারি ক্রয়সহ রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবহারে স্বার্থের দ্বন্দ্ব স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ভূমি-বনাঞ্চল-নদী-জলাশয় দখল, সরকারি খাতে নিয়োগে দলীয়করণ এবং দুর্নীতির সুযোগের ভাগাভাগিকেন্দ্রিক সরকারদলীয় আন্তসংঘর্ষ বেড়েই চলেছে। সেবা খাতে দুর্নীতি ও হয়রানি জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। ৭১ শতাংশ সেবাগ্রহীতার অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, ঘুষ প্রদান ছাড়া সেবা পাওয়া অসম্ভব। সরকারের দায়িত্বশীল অবস্থান থেকে প্রকাশ্যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে যে ক্ষমতায় থাকলে সম্পদ বৃদ্ধিই স্বাভাবিক। ঘুষকে আখ্যায়িত করা হয়েছে ‘স্পিড মানি’ হিসেবে, আবার আরও এক ধাপ এগিয়ে ঘুষ লেনদেনকে উৎসাহ দিতে চেয়েছেন ‘ঘুষ নেবেন রয়ে-সয়ে’-এরূপ পরামর্শ দিয়ে। অবৈধ অর্থ পাচারের বৈশ্বিক তালিকায় বাংলাদেশ বিব্রতকরভাবে প্রথম সারিতে রয়েছে। কালোটাকা অর্জনকে পুরস্কৃত করা অব্যাহত রয়েছে।

আশার কথা, দুর্নীতিবিরোধী আইনি, প্রাতিষ্ঠানিক ও নীতিকাঠামোতে গত প্রায় এক দশকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। তবে মূল সমস্যা হচ্ছে এসবের চর্চা ও প্রয়োগের ব্যাপক ঘাটতি। দুর্নীতি যে বাস্তবেই শাস্তিযোগ্য অপরাধ, সব ধরনের ভয় বা করুণার ঊর্ধ্বে থেকে তার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। সম্প্রতি দুদক তার অর্পিত দায়িত্ব পালনে লক্ষণীয়ভাবে সচেষ্ট হয়েছে, যদিও উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতির ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা বজায় রেখেছে এরূপ দৃষ্টান্ত পাওয়া দুরূহ। দুদকের পাশাপাশি অন্যান্য জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে জাতীয় সংসদের কার্যকরতা নিশ্চিত করতে হবে; আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থায় পেশাদারি উৎকর্ষ বৃদ্ধি করতে হবে।

সর্বোপরি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণ, গণমাধ্যম ও বেসরকারি সংগঠনের সোচ্চার ভূমিকা অপরিহার্য, যার পরিবেশ নিশ্চিত করার দায়িত্বও সরকারের। প্রথমবারের মতো ২০১৭ থেকে সরকারিভাবে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস পালনের সিদ্ধান্ত প্রশংসিত হয়েছে। অন্যদিকে মতপ্রকাশ ও বাক্স্বাধীনতা খর্ব করার সুযোগ সৃষ্টিকারী উপর্যুপরি আইনি সংস্কার নিন্দিত হয়েছে। মনে রাখতে হবে, দুর্নীতিবিরোধী চেতনা ও সমালোচনা সইবার সৎসাহস একসূত্রে গাঁথা। সমালোচনা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করা শুধু জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য ক্ষতিকারক নয়, দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ও বিচারহীনতার সংস্কৃতির অন্যতম অনুঘটক। অন্যদিকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতের মাধ্যমে জনগণ যত বেশি সোচ্চার হওয়ার সুযোগ পাবে, তত বেশি সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি প্রতিরোধে অগ্রগতি হবে।

ইফতেখারুজ্জামান: ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক