ধর্মনিরপেক্ষতা ও 'পদ্মাবত' বিতর্ক

পদ্মাবত ছবির একটি দৃশ্য
পদ্মাবত ছবির একটি দৃশ্য

ভারতের রাষ্ট্রীয় চরিত্র নিয়ে স্বাধীনতার শুরু থেকে একধরনের বিতর্ক চলে আসছিল। ভারত ধর্মনিরপেক্ষ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবে কি না, তা নিয়ে পার্লামেন্টে যথেষ্ট বিতর্ক হয়েছিল। ওই সময়ে লোকসভার সদস্য প্রফেসর কেটি শাহ ভারতের সংবিধানের প্রারম্ভে রাষ্ট্রের চারিত্রিক পরিচয়ের প্রশ্নে প্রস্তাব তুলেছিলেন যে স্বাধীন ভারত রাষ্ট্র সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পাশাপাশি যেন সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে সংবিধানে উল্লিখিত হয়। অনেক বিতর্কের পর পণ্ডিত নেহরু ও অম্বেদকারের বিরোধিতার মুখে সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি রাখা হয়নি। স্বাধীনতার তিন দশক পর ১৯৭৬ সালে ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে ভারতের সংবিধানে ৪২ তম সংশোধনীর মাধ্যমে সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি প্রারম্ভিক স্তবকে জুড়ে দেওয়া হয়।

এর তিন দশক পর আবার প্রশ্ন উঠেছে, ভারত সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত থাকবে কি না। শাসক দল বিজেপির নেতা ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনন্ত কুমার হেগড়ে এক সমাবেশে বলেছেন, ভারতে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে সংবিধান থেকে ‘সেক্যুলার’ শব্দটি বাদ দিতে। বিজেপির একাধিক নেতা তাঁর এই বক্তব্যের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করেছেন।

ভারতে যে পরিবর্তন হচ্ছে, তা সংবাদপত্রে চোখ রাখলেই দেখা যায়। মোদির নেতৃত্বে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে নতুন উদ্যমে উগ্রবাদী হিন্দুত্বের উত্থান ঘটেছে। উগ্রবাদীদের সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শন ক্রমেই আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে। এই উত্থান সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়াচ্ছে। আসামে বিজেপির উত্থান এবং সেখানকার বাঙালি মুসলমানদের নাগরিকত্বের প্রশ্নে যে সংকটের আভাস পাওয়া যাচ্ছে, তা নিয়ে হয়তো বাংলাদেশকে চিন্তিত হতে হবে। আগামী আগস্টে হয়তো আসামের বিজেপি সরকারের ‘বাঙালি অভিবাসী’ প্রশ্নের প্রভাব বোঝা যাবে। ত্রিপুরা রাজ্যে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে, আগামী ৩ মার্চ ফলাফল ঘোষিত হবে। যদিও ওই রাজ্যের কমিউনিস্ট সরকার শক্ত অবস্থানে রয়েছে, তথাপি বিজেপি আগের তুলনায় ভালো করবে, এমন মত দিয়েছেন সে দেশের অনেক রাজনৈতিক ভাষ্যকার।

ভারতে হিন্দুত্ববাদের উত্থানের প্রভাব শুধু রাজনৈতিক অঙ্গনেই নয়, শিল্প, সাহিত্য, ইতিহাসের ব্যাখ্যায়ও পড়ছে। মুসলিম শাসনের ইতিহাসের বহুলাংশ বিকৃত অথবা অস্বীকার করার প্রবণতা বাড়ছে। এ রকম প্রবণতা ইতিহাসভিত্তিক বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রেও লক্ষ করা যাচ্ছে। ইদানীং বলিউডের বহু আলোচিত ঐতিহাসিক চরিত্র নিয়ে নির্মিত একটি ছবি নিয়ে উত্তর ও পশ্চিম ভারতের কয়েকটি রাজ্যে কট্টরপন্থী হিন্দুত্ববাদীরা তাণ্ডব চালিয়েছিল। বিতর্ক উঠেছিল মধ্যযুগীয় একটি কল্পিত কাব্যিক উপাখ্যান অবলম্বনে নির্মিত ছবি পদ্মাবতী, পরে নাম পরিবর্তন করে পদ্মাবত নামের ছবিতে মুসলিম শাসক সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির সঙ্গে মেওয়ারের রানি পদ্মাবতীর স্বপ্নদৃশ্যের রোমান্স নিয়ে। নির্মাতা বারবার এমন দৃশ্যের কথা অস্বীকার করলেও তথাকথিত রাজপুত ‘করনি সেনা’ এবং নব্য হিন্দুত্ববাদীরা মুক্তির আগেই প্রেক্ষাগৃহে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করেছিল। বিষয়টি অবশেষে উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ায়। পরে নাম পরিবর্তন করে ছবিটি উত্তর ও পশ্চিম ভারতের কয়েকটি রাজ্য ছাড়া প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়।

এ ছবি মেওয়ারের রাওয়াল রাজা রতন সিংয়ের দ্বিতীয় পক্ষের সুন্দরী রানি পদ্মাবতীর রূপে মোহিত দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির রানিকে পাওয়ার বাসনা নিয়ে। উপাখ্যানটি নেওয়া হয়েছে ষোড়শ শতাব্দীর সুফি কবি মালিক মুহাম্মদ জায়সির কাব্য পদ্মাবত থেকে। এটি অনেক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বাংলায় এটি অনুবাদ করেন কবি আলাওল।

এ বিষয় নিয়ে ১৯৫০-এর দশকে মহারানি পদ্মিনী নামে ছবি হয়েছিল। তখন ভারতের সংবিধানে সেক্যুলারিজম ছিল না, কিন্তু ওই ছবি নিয়ে কোনো হইচই হয়নি। ওই ছবি অনেকাংশে মোহাম্মদ জায়সির পদ্মাবত-এর কল্পকাহিনির ধারাতেই নির্মিত হয়েছিল। বর্তমানের এই ছবিতে উগ্র হিন্দুত্ববাদের প্রভাব লক্ষণীয়। পদ্মাবত কাব্য থেকে সরে গিয়ে দিল্লির সুলতানের চরিত্রকে লম্পট ও বিশ্বাসঘাতক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। যারা ইতিহাসের সঙ্গে তেমন পরিচিত নয়, তাদের কাছে খিলজিকে বাণিজ্যিক ছবির নিকৃষ্টতম খলনায়কের চেয়েও ঘৃণ্য মনে হবে।

সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি তাঁর চাচাকে হত্যা করে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন ১২৯৬ সালে। ১৩১৬ সালে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি দিল্লির খিলজি বংশের দ্বিতীয় সুলতান ছিলেন। খিলজিদের শাসন আলাউদ্দিন খিলজির মৃত্যুর পর মাত্র চার বছর টিকে ছিল। আলাউদ্দিনকে তাঁর রাজত্বকালে মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে ছয়বার যুদ্ধ করতে হয়। প্রতিবারই খিলজি মোঙ্গলদের হাত থেকে তৎকালীন ভারতের সুলতান শাসিত অঞ্চলকে, তথা সমগ্র উপমহাদেশকে মোঙ্গল-তাণ্ডব থেকে রক্ষা করেন। একই সঙ্গে রাজপুতদের বহু ছোট ছোট রাজ্যকে তাঁর বশ্যতা স্বীকার করান।

খিলজি মধ্যযুগীয় অন্য শাসকদের মতোই তাঁর বিরোধীদের প্রতি ছিলেন নির্মম। তিনি মেওয়ার রাজ্য দখল করার চেষ্টায় একবার ব্যর্থ হলেও দ্বিতীয়বার দখল করেন। তাঁর সহযোগী হয়েছিলেন মেওয়ারবিরোধী অন্য রাজপুত রাজারা। ইতিহাস বলে মেওয়ারের রাজা রতন সিং কুম্বালনের রাজা দেবপালের সঙ্গে একক যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন। কাব্যে কথিত যে খিলজি কর্তৃক রতন সিং বন্দী হওয়ার পর কথিত রানি পদ্মাবতীকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সে প্রস্তাব কথিত পদ্মাবতী নাকচ করেছিলেন। রতন সিংয়ের মৃত্যুর পর রানি সতীব্রত পালন করেন।

রানি পদ্মাবতী ও খিলজির উপাখ্যানের সত্যতা ইতিহাসে পাওয়া যায় না। পাওয়া যায় না চিতোরের দুর্গের ৪০০ মহিলার আগুনে ঝাঁপিয়ে আত্মহননের বিষয়টিও। তবে একাধিক ঐতিহাসিক লিখেছেন, আলাউদ্দিন চিতোরের দুর্গ দখল করে এক ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিলেন। তবে আমির খসরুর বর্ণনা মতে, তিনি খিলজির সঙ্গে ওই দুর্গে প্রবেশ করেছিলেন, খিলজি মেওয়ারের রাজপরিবারকে ক্ষমা করেছিলেন। রতন সিংয়ের শাসনকাল মাত্র এক বছর স্থায়ী হয়েছিল (১৩০২-০৩)। আমির খসরু তাঁর রচিত খাজাইন উল ফাতাহ নামের কাব্যে এ বিষয়ে উল্লেখ করেছিলেন। আমির খসরুর সঙ্গে ওই সময়কার ইতিহাসবিদ জিয়াউদ্দিন বারানী এবং ইসমাইল একমত পোষণ করলেও আরও পরে ইতিহাসবিদ বানারী প্রসাদ সাকসেনা এ বিষয়টির ওপর সন্দেহ প্রকাশ করেন।

পদ্মাবতীর সত্যতা নিয়ে গাঞ্জ ফিরিসতা এবং হাজিউদ দাবির মনে করেন, চিতোরের রানি ঐতিহাসিক চরিত্রই ছিলেন; তবে মুহাম্মদ জায়সির কল্পনাপ্রসূত কাব্যের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। যেমন করেছেন বর্তমানের জওহর লাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় (জেএনইউ) দিল্লির ইতিহাসের অধ্যাপক অদিতি মুখার্জি। তিনি বলেন, কিংবদন্তি ছাড়া ইতিহাসে এই চরিত্রের কোনো প্রমাণ নেই।

এই ছবিকে ঘিরে রাজপুত করনি সেনাদের বিবাদ হয়তো থেমে গেছে; কিন্তু একাধিক মুসলিম ভারতীয় ধর্মীয় নেতা আলাউদ্দিন খিলজিকে এমনভাবে উপস্থাপন করাতে সমালোচনায় মুখর। তাঁদের মতে, ছবিটির পরিচালক ও প্রযোজক যেভাবে আলাউদ্দিনকে খলনায়ক বানিয়েছেন, তা মুহাম্মদ জায়সির পদ্মাবত কাব্যের বাইরে। ইতিপূর্বেও মহারানি পদ্মিনী নামে ১৯৬৪ সালের নির্মিত ছবি মুহাম্মদ জায়সির কাব্যের কাছাকাছি ছিল। তখন ভারতে সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বা সেক্যুলারিজম অন্তর্ভুক্ত ছিল না। ওই সময় সোহরাব মোদির পুকার, মেহবুবের হুমায়ুন-এর মতো ছবি নির্মিত হয়েছিল। এসব ছবি নিয়ে কেউই সাম্প্রদায়িতার প্রশ্ন তোলেনি।

আজকের ভারত ওই অবস্থায় নেই। ভারতের শাসকগোষ্ঠীর একাংশ এবং তাদের পেছনের শক্তি ভারতকে সাম্প্রদায়িকতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ অবস্থা ভারতের মতো দেশের জন্য যেমন সুখকর নয়, তেমনি উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের জন্যও সুখকর হবে না। একটি রাষ্ট্র ও সমাজের একাংশ অসহিষ্ণু হয়ে উঠলে এর প্রভাব সমাজের অন্যান্য অঙ্গনেও পড়তে বাধ্য। তবে আশার বিষয় এই, ভারতের সিংহভাগ মানুষ এখনো ‘অসাম্প্রদায়িক’ চেতনা ধারণ করেন। এই শ্রেণির মানুষগুলো ক্রমেই উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতে জিম্মি হয়ে পড়ছেন। উপমহাদেশে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার উন্মাদনার শিকার হচ্ছে হাজার হাজার সাধারণ জনগণ। একে রুখতে হলে অবশ্যই সচেতন নাগরিকদের সচেতন হতে হবে। অন্যথায় রাষ্ট্রের যে ক্ষতি হবে, তা হতে পারে ভয়াবহ।

এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার, কলাম লেখক ও পিএইচডি গবেষক
[email protected]