একা হওয়া যাবে না?

তরুণীটি একা যাচ্ছিলেন নিজের বাড়ি। পথে উঠে পড়েন এক ইজিবাইকে। যাত্রীর আসনে আগে থেকেই ছিলেন দুজন তরুণ। তাঁরা একপর্যায়ে তরুণীর সঙ্গে অশোভন আচরণ করতে শুরু করেন। চালক নিয়ে যান একটি নির্জন স্থানে। ইজিবাইক থেকে জোর করে তরুণীকে নামিয়ে পালাক্রমে তিনজন ধর্ষণ করেন। নিজেরা ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হননি; ফোন করে ডেকে নিয়ে আসেন আরও চারজনকে। তাঁরাও ধর্ষণ করেন তরুণীটিকে। ভয়াবহ এই ঘটনাটি ঘটেছে গত শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজবাড়ী জেলায়।

টাঙ্গাইলের মধুপুরে চলন্ত বাসে রূপা ধর্ষণ ও হত্যা মামলার বিচারের রায়ে সারা দেশের মানুষ যখন একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছে, ঠিক তখনই আবার একই ধরনের ঘটনা ঘটল। মনে প্রশ্ন জাগে, কবে আমাদের দেশের নারীরা নিরাপদে চলাচল করতে পারবেন? আদৌ কখনো পারবেন কি?

প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, মোট সাতজন পুরুষ তরুণীটিকে বলতে গেলে মহাসমারোহে ধর্ষণ করেন। একা অসহায় মেয়েটির নিজেকে রক্ষা করার কোনো উপায়ই ছিল না। ভয়ে শিউরে উঠি—আমিও তো একা চলাচল করি! যদি কোনো দিন আমার অবস্থা ওই তরুণীর মতো হয়? হবে না—এমন কথা তো আমি হলফ করে বলতে পারি না। আমার মনে হয় কোনো নারীই বলতে পারবেন না।

মনে আছে, আমি যখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি, তখন একবার এক বান্ধবীর বাসায় যেতে চাই। আমার মা আমাকে একা ছাড়লেন না। সঙ্গে দিলেন ছোট ভাইকে। বোধ হয় নিরাপত্তাহীনতার বোধ থেকেই তিনি এ কাজ করেছিলেন। যদিও আমার চেয়ে দুই বছরের ছোট ভাইটির তখন কারও দ্বারা আক্রান্ত হলে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা ছিল না। মা হয়তো ভেবেছিলেন, আমার পাশে কোনো ছেলেকে দেখলে কেউ কিছু বলতে আসবে না। কেউ উত্ত্যক্ত করার সাহস পাবে না। তার মানে কি মেয়েদের একা হওয়া মানেই উত্ত্যক্তের শিকার হওয়া? পুরুষের ভোগের বস্তুতে পরিণত হওয়া?

আচ্ছা, যখন কোনো নারী কোথাও একা হয়ে পড়েন, তখন তাঁর আশপাশে কি একজন পুরুষও থাকেন না, যিনি তাঁকে ভোগের বস্তু মনে করেন না? রূপা যখন চলন্ত বাসে একা হয়ে পড়েছিলেন, তখন বাসের চালক ও সহকারী পুরুষেরা কেন একযোগে হিংস্র হায়েনা হয়ে গিয়েছিলেন? এঁদের মধ্যে অন্তত একজন থাকতে পারতেন, যিনি কিনা অন্যদের বাধা দিতে পারতেন। বলতে পারতেন, না, কাজটা ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু সে রকম হয়নি। সবাই একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়েন রূপার ওপর। কেন এ রকম হয়? এসব পুরুষ তো এই সমাজেরই মানুষ। তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ। কিন্তু তাঁদের রিপুর এমনই তাড়না যে একা পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়েন একটি অসহায় মেয়ের ওপর।

শুধু কি গণপরিবহনে? কর্মস্থলে, এমনকি বাসাবাড়িতে এভাবে একা হয়ে পড়া নারীরা পুরুষের লোভ-লালসার শিকার হচ্ছেন। আমার এক পরিচিত নারী গত ডিসেম্বরে ছেলেমেয়েদের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর ১৫ দিনে জন্য বাপের বাড়ি গিয়েছিলেন। বাড়িতে রেখে যান স্বামী ও অল্পবয়সী গৃহকর্মীকে। প্রথম দুদিন ঠিকঠাক গেলেও তৃতীয় দিন ওই নারীর স্বামী চড়াও হন গৃহকর্মীটির ওপর। স্ত্রী যেন কোনোভাবেই জানতে না পারেন, সে জন্য গৃহকর্মীকে প্রাণনাশসহ নানা ধরনের হুমকি দেন তিনি। কিন্তু স্ত্রী ফিরে এসে যখন সব জানতে পারেন, তখন তাঁর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। ওই নারী কখনো ভাবতে পারেননি, তাঁর উচ্চশিক্ষিত স্বামীটি এভাবে লম্পটের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন। এ রকম আরও বহু নজির আছে। দেখা যাচ্ছে, নারীদের যৌন হয়রানি, উত্ত্যক্ত বা ধর্ষণ করার জন্য পুরুষের শিক্ষা বা অশিক্ষা কোনো বিষয় নয়; বিষয় নয় তাদের বয়স বা সামাজিক অবস্থান।

প্রশ্ন হচ্ছে, এ রকম কি চলতেই থাকবে? আমরা নারীরা কি সব সময় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকব? ঘর থেকে বের হতে হবে ভাই, বাবা বা স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে? ঘরে থাকতে হবে দল বেঁধে?

দেশে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে নীতিমালা হয়েছে। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে আইন হয়েছে। কিন্তু এ দেশে প্রতিদিন যে হারে নারীরা যৌন হয়রানি, ধর্ষণসহ নানা ধরনের সহিংসতার শিকার হচ্ছেন, তাতে এসব আইন ও নীতিমালা অসার প্রমাণিত হচ্ছে। এসব আইন ও নীতিমালার কোনো প্রয়োগ নেই।

এভাবে আর কত দিন? এখন সময় হয়েছে পুরুষদের এসব লাম্পট্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার। সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে সেসব পুরুষকে, যাঁরা নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধ, নারী ধর্ষণের বিরুদ্ধে। নারীদেরও মুখ বুজে বসে থাকলে চলবে না। পুরুষের অপকর্মের কথা সবাইকে জানাতে হবে। সরকারকেও নারীদের সুরক্ষায় গৃহীত আইন ও নীতিমালা কার্যকর করতে হবে। নারী নিগ্রহকারীদের কঠিন শাস্তি দিতে হবে। তা নাহলে এই পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হবে না। আসুন, সবাই আমরা রুখে দাঁড়াই।

রোকেয়া রহমান: সাংবাদিক