ঘনীভূত হয়ে উঠছে রোহিঙ্গা সংকট

সীমান্তে মিয়ানমারের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি উসকানিমূলক
সীমান্তে মিয়ানমারের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি উসকানিমূলক

ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে রোহিঙ্গা সংকট। বাংলাদেশ যখন মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে এ সংকটের সমাধান খুঁজছে এবং মিয়ানমারে সীমিত সংখ্যক প্রত্যাবর্তনের উদ্যোগ-আয়োজন চলছে, তখনই মিয়ানমার সীমান্তের তুমব্রু অঞ্চলে সেনা ও সামরিক শক্তি বাড়িয়েছে। শুধু আমাদের গণমাধ্যমেই নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও গুরুত্বের সঙ্গে মিয়ানমারের এই যুদ্ধংদেহী অবস্থানের খবর প্রকাশিত হয়েছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। অনুষ্ঠিত হয়েছে দুই দেশের আঞ্চলিক সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে পতাকা বৈঠক। ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’-এর কাছে এ ধরনের সেনাসমাবেশ স্বাভাবিক বিষয় নয়। ভারী অস্ত্রের উপস্থিতি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অন্য কোনো প্রস্তুতির বিষয়টিকেই তুলে ধরে। এ ধরনের কার্যক্রম প্রতিবেশীসুলভ তো নয়ই, বরং উসকানিমূলক।

মিয়ানমার অবশ্য এই উপস্থিতির কথা স্বীকার করে বলেছে যে বাংলাদেশ নয়, এর লক্ষ্য হচ্ছে রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী সংগঠন ‘আরসা’। তাদের ভাষ্য, ‘জিরো’ লাইনে যেসব রোহিঙ্গা প্রায় ছয় মাস ধরে অবস্থান করছে, তাদের মধ্যে আরসার উপস্থিতি রয়েছে-এমন তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতেই এ সমাবেশ। মিয়ানমারের এমন যুক্তি ধোপে টেকে না। ভারী অস্ত্রের সমাবেশ বা মর্টারের উপস্থিতির কোনো যৌক্তিকতা এতে পাওয়া যায় না। আর এ ধরনের উদ্যোগ নো ম্যানস ল্যান্ডের স্বীকৃত ধারণার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। বাংলাদেশের তরফে একে উসকানি হিসেবে বিবেচনা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

শুধু সেনাসমাবেশই নয়, জিরো লাইনে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের বাঙালি আখ্যায়িত করে ভয় দেখিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টাও তাদের রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের জনগণের আতঙ্ক দূর করতে এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার বাংলাদেশের রয়েছে। তবে এখনই এমন কিছু করলে সেটা মিয়ানমারের ফাঁদে পা দেওয়া হয়ে যেতে পারে।

মিয়ানমার কোনো পরিকল্পনা ছাড়া কাজটি করেছে, এমন মনে হয় না। মিয়ানমারের এ ধরনের সেনাসমাবেশের পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে। প্রায় ছয় হাজার রোহিঙ্গা নো ম্যানস ল্যান্ডে আটকা রয়েছে। এরা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারেনি বা প্রবেশ করতে চায়নি। বাংলাদেশের তরফে যাতে এদের তাদের জায়গায় ফেরত নিয়ে যাওয়ার দাবি তোলা না যায়, সে কারণে মিয়ানমার এই কাজ করে থাকতে পারে। তা ছাড়া এ ধরনের সেনাসমাবেশের ফলে যে ভয়ভীতির সৃষ্টি হয়েছে, তাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীরা স্বেচ্ছায় ফেরত যেতে চাইবে না। ফলে প্রত্যাশিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন আদৌ শুরু হবে কি না, সেই প্রশ্ন এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।

আসলে আরসার কথা বলা হলেও এ অঞ্চলের অন্য সমস্যা নিয়েও মিয়ানমারের সামরিক ও বেসামরিক সরকার যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। আর তা হচ্ছে রাখাইন বা আরাকান অঞ্চলে আরাকান জাতীয়তাবাদীদের শক্তি সঞ্চয় ও উত্থান। এদের রাজনৈতিক সংগঠন ইউনাইটেড লিগ অব আরাকানের (ইউএলএ) একটি সামরিক শাখাও রয়েছে-উত্তর রাখাইনের আরাকান আর্মি। ২০০৯ সালে পুনর্গঠিত হওয়ার পর থেকে তারা শক্তি সঞ্চয় করছে। গত নভেম্বর-ডিসেম্বরের পর রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাশূন্য এলাকায় আরাকান আর্মির (এএ) তৎপরতা বেড়েছে।

গত মাসের (ফেব্রুয়ারি) শেষের দিকে আরাকান রাজ্যের সিতওয়ে শহরে কয়েকটি বোমা হামলা হয়। মিয়ানমার সরকার মনে করে, ২০১৭ সালের ১৭ জানুয়ারি মধ্য রাখাইনের মারক ইউ শহরে সাধারণ মানুষের জমায়েতের ওপর গুলিবর্ষণ এবং ৭ জন রাখাইনবাসীর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে এই হামলা চালানো হয়েছে। ২৩৩ বছর আগে বার্মা কর্তৃক আরাকান রাজ্য দখলের প্রতিবাদে ওই দিন ইউএলপি মারক ইউ শহরে সমাবেশ ডেকেছিল। সে সময় সরকারবিরোধী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী স্লোগান উঠলে মিয়ানমার পুলিশের গুলিতে সাতজন নিহত হয়।

মারক ইউয়ের ওই ঘটনার পর থেকে রাখাইন অঞ্চলে একদিকে আরাকান আর্মির তৎপরতা যেমন বেড়েছে, তেমনি বর্মিদের বিরুদ্ধেও গুপ্তহত্যার ঘটনাও বেড়েছে। ওই ঘটনার পর সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বোবোমিন থাক-সিতওয়ে-ইয়াঙ্গুন রোডে গাড়ির ভেতরে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মৃত পাওয়া যায়। এ কারণে আরাকান ন্যাশনাল পার্টির নেতা আয়ে মং এবং জাতীয়তাবাদী সাহিত্যিক ওয়ে হিন অংকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং তাঁদের মামলা বিচারাধীন। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা নিধন পর্ব শেষ হলে আরাকান আর্মি উত্তর রাখাইনের কালাদান নদীতে ফাঁদ পেতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দুই অফিসারসহ ১১ জনকে হত্যা করে। এরই ধারাবাহিকতায় বুচিডং অঞ্চলে এ বছরের জানুয়ারিতে ভূমি মাইন বিস্ফোরণে ছয় সেনা আহত হয়। অবশ্য এর জন্য দায়ী করা হয়েছে আরসাকে।

রোহিঙ্গাশূন্য অঞ্চলে আরাকান আর্মি এখন অবাধে বিচরণ করছে বলে জানা যাচ্ছে। মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর ধারণা, ভবিষ্যতে আরাকান আর্মির সঙ্গে আরসা যুক্ত হয়ে লড়াই শুরু করতে পারে। আরাকানিদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনেও রোহিঙ্গারা জড়িত হতে পারে বলে মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মনে করে। এর একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর তৎকালীন বার্মার উনু সরকারের একজন রোহিঙ্গা বংশোদ্ভূত মন্ত্রী সুলতান মাহমুদ আরাকানকে আলাদা স্বায়ত্তশাসিত রাজ্য এবং উত্তর রাখাইনকে আলাদা প্রদেশ বা অঞ্চল হিসেবে বহুবার দাবি তুলেছিলেন। আরাকান শাসনের ফর্মুলাও দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৬২ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে রোহিঙ্গাদের দাবি তো দূরের কথা, আরাকানের কোনো অধিকারই নিশ্চিত করা হয়নি।

বাংলাদেশ-মিয়ানমার নো ম্যানস ল্যান্ডে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ছয় হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে দুই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের সিদ্ধান্তের পর মিয়ানমারের আচরণে মনে হচ্ছে ওই আলোচনা একধরনের ধাপ্পাবাজি ছাড়া কিছুই নয়। মিয়ানমার সেনাবাহিনী সীমান্তে সামরিক শক্তি বাড়িয়ে সরকারের ভেতরে তাদের শক্তিটি জানিয়ে দিতে চাইছে। মিয়ানমারের বেসামরিক সরকার যে কার্যত সেনাবাহিনীর অধীন, তা তারা পরিষ্কারভাবে বাংলাদেশ ও পশ্চিমের দেশগুলোকে বুঝিয়ে দিতে চাইছে। বাংলাদেশ সফরে এসে তিন নোবেল বিজয়ী নারী যেসব কঠিন অভিযোগ করেছেন, তা নিশ্চিতভাবেই মিয়ানমার সামরিক বাহিনীকে ক্ষুব্ধ করেছে। একই সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে কয়েকজন জেনারেলের বিরুদ্ধে ভ্রমণ এবং অস্ত্র বিক্রির ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারি মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ওপরে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। মিয়ানমার বাহিনী যে এসব হুমকিধমকির তোয়াক্কাও করে না, সেটা বোঝানোও এই সামরিক শক্তি বৃদ্ধির কারণ হতে পারে।

মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় নীতি ও ইতিহাস দেখলে এটা পরিষ্কার যে সামরিক বাহিনী রাখাইন অঞ্চলকে রোহিঙ্গামুক্ত রাখতে চায়। নানা কায়দায় তারা এ পর্যন্ত রাখাইন রাজ্য থেকে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে এদের আর ফেরত নেবে বলে মনে হয় না। যদি কোনো কারণে কিছুসংখ্যক ফেরত নেয়ও, তাদের আশ্রয়কেন্দ্রেই থাকতে হবে, নিজেদের বসতবাড়িতে নয়। ফলে বাংলাদেশের সামনে খুব বেশি পথ খোলা রয়েছে বলে মনে হয় না। দ্বিপক্ষীয় আলোচনা নিশ্চয়ই চালিয়ে যেতে হবে, তবে এর ফলাফল কেমন হবে, তা অত্যন্ত পরিষ্কার। বাংলাদেশ সীমান্তে সেনা শক্তি প্রদর্শন করে মিয়ানমার আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে। এ ব্যাপারে মিয়ানমারকে সতর্ক করা ছাড়াও বাংলাদেশের উচিত তা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরার উদ্যোগ নেওয়া। জাতিসংঘসহ মিয়ানমারকে সমর্থনকারী দেশগুলোর কাছে বিষয়গুলো আরও জোরালোভাবে তুলে ধরতে হবে। এসব দেশের প্রতিটির সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। কাজেই বাংলাদেশের স্বার্থ সব সময়ের জন্য উপেক্ষা করবে, এমন মনে হয় না।

রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে দক্ষিণ এশিয়া-সংলগ্ন অঞ্চলের ভূকৌশলগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত পরিষ্কার হয়ে উঠছে। এর সুযোগ বাংলাদেশ কতখানি নিতে পারবে, তা নির্ভর করবে সুচিন্তিত এবং জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতার ওপর।

এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার, কলাম লেখক ও পিএইচডি গবেষক
[email protected]