নবায়নযোগ্য জ্বালানিই সুলভ বিকল্প

জামালপুরের সরিষাবাড়ীর সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রে ৮ একর জায়গাজুড়ে পেতে রাখা সারি সারি সৌর প্যানেল l প্রথম আলো
জামালপুরের সরিষাবাড়ীর সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রে ৮ একর জায়গাজুড়ে পেতে রাখা সারি সারি সৌর প্যানেল l প্রথম আলো

বিদ্যুতের দাম বাড়ানোই যেখানে সরকারের পরিকল্পনা, জনগণের থেকে আরো বেশি অর্থ আদায়ই যখন উদ্দেশ্য তখন সাশ্রয়ী বিদ্যুতের পথ বন্ধ হবে। তাই দফায় দফায় ব্যয় বৃদ্ধির কয়লা কিংবা পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো অগ্রাধিকার তালিকায় থাকলেও দাম কমতে থাকা সৌর, বায়ু আর বর্জ্যবিদ্যুতের প্রকল্প উন্নয়নের বেলায় নীতিনির্ধারণী মহল যেন কেবলই বিদেশি তহবিলের আশায় থাকা চাতক পাখি।

ভারতের নবায়নযোগ্য জ্বালানিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে ঝুলছে রেকর্ড সর্বনিম্ন মূল্যে সৌর আর বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনের বিজ্ঞাপন। সেখানে এই বিদ্যুৎ বাংলাদেশি মুদ্রায় সাড়ে তিন টাকারও কম মূল্যে উৎপাদিত হচ্ছে। (http://mnre.gov.in/)। বাঁধভিত্তিক জলবিদ্যুৎ ছাড়াই ভারতে এখন নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের ক্ষমতা মোট উৎপাদন ক্ষমতার প্রায় ১৫ শতাংশ। (গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যানুয়াল রিপোর্ট ২০১৬-১৭)। বিপরীতে বাংলাদেশে তা মাত্র ১ দশমিক ৫ শতাংশ। (http://www.sreda.gov.bd/)। ভারতে ২০২২ সালের মধ্যেই সৌর, বায়ু আর বর্জ্যবিদ্যুৎ মিলিয়ে ১ লাখ ৭৫ হাজার মেগাওয়াটের উৎপাদনী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের কারণ শুধু কম দামে বিদ্যুৎ উৎপাদন করাই নয়, বরং এর মাধ্যমে দেশটি নতুন শিল্প প্রসারেরও ছক কাটছে। ভারতের উইন্ড টারবাইন প্রস্তুতকারক কোম্পানি ‘সুযলোন’ ইতিমধ্যেই বিশ্বে অন্যতম শীর্ষ যন্ত্রাংশ উৎপাদন এবং রপ্তানিকারক কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। অথচ বাংলাদেশে এই খাত বর্তমানে পুরোটাই আমদানিনির্ভর, ভবিষ্যতেও এই খাত উন্নয়নে নিজস্ব গবেষণা, উদ্ভাবন আর শিল্প প্রসারের কোনো পরিকল্পনা নেই।

বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ হিসেবে সৌরবিদ্যুতের পরিচিতিই বেশি। এই সৌরবিদ্যুৎ ছড়িয়েছে প্রধানত গ্রাম, মফস্বল ও চরাঞ্চলে। সোলার সিস্টেমের ওয়াটপ্রতি দাম যখন ৪৫০ কিংবা ৫০০ ছিল, তখন থেকেই এটি ব্যবহারে সাধারণ মানুষের আগ্রহ সামাজিক গ্রহণযোগ্যতারই সাক্ষ্য দেয়। এর ফলে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গেই বাংলাদেশে প্রায় ৫০ লাখ সোলার হোম সিস্টেমের ব্যবহার শুরু হয়েছে। অথচ গত সাত বছরের ব্যবধানে প্রতি ইউনিট সৌরবিদ্যুতের দাম বিশ্বব্যাপী ৭২ শতাংশ কমে গেলেও বাংলাদেশে এই বিদ্যুৎ নীতিনির্ধারণী মহলে মূল ধারার ভবিষ্যৎ বিদ্যুৎ উৎপাদনী মাধ্যমে হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। (আইআরইএনএ রিপোর্ট, ২০১৭)। আর ঠিক এ কারণেই ২০১৫ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে পূর্বঘোষিত ৫ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যায়নি।

অন্যদিকে প্রযুক্তি আর চিন্তার অভিনবত্বে নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিদ্যুৎ দিনকে দিন পরিণত হচ্ছে, অতিক্রম করছে সব বাধা। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার জন্য এখন রয়েছে ভাসমান সৌরপ্রযুক্তি, কৃষিজমিতে ফলন আর সৌরবিদ্যুৎ একসঙ্গে করার জন্য ‘সোলার শেয়ারিং’ আর বিকেন্দ্রীভূত গ্রিড ব্যবস্থাপনার মতো সমাধান। অন্য সব বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো সৌর কিংবা বায়ুবিদ্যুৎ করতে বিশাল এলাকা অধিগ্রহণের কোনো প্রয়োজন নেই। পতিত অকৃষিজমি, দখল হয়ে যাওয়া নদীর পাড় এবং বাড়ির ছাদের মতো স্থানে সোলার প্যানেল আর বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ উপকূলবর্তী আর অগভীর সমুদ্র এলাকা বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য খুবই উপযোগী। সেই সঙ্গে সৌর আর বায়ুবিদ্যুতের চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার জন্য রয়েছে দাম কমতে থাকা ব্যাটারির সুবিধা। এভাবে শিল্প, কৃষি আর ব্যবসা-বাণিজ্যে এই বিদ্যুৎ ক্রমেই নিজের দখল বাড়াচ্ছে। ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে মাত্র তিন বছরে ভারতে ১ লাখ ১০ হাজার সৌরবিদ্যুৎ চালিত পানির পাম্প চালু হয়েছে। ২০১৬ সালে জার্মানিতে একক উৎস হিসেবে নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল শীর্ষে। সৌর ও বায়ুবিদ্যুৎ নির্ভরশীলতা দিয়েই ওই বছর জার্মানি ইউরোপে শীর্ষ বিদ্যুৎ রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়। (ডব্লিউএনআইএসআর ২০১৭)। অন্যদিকে, ভারতের চতুর্থ ব্যস্ততম কোচিন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পুরোটাই চলছে সৌরবিদ্যুতে।

নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের সুবিধা মূলধারার অর্থনীতিতে আত্তীকরণ করতে দেশে দেশে ঘোষিত হচ্ছে নিত্যনতুন লক্ষ্যমাত্রা। ভারত ২০৩০ সালের মধ্যেই ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ অজীবাশ্ম জ্বালানি থেকে উৎপাদনের ঘোষণা দিয়েছে। (দ্য গার্ডিয়ান, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৬) আর জার্মানির ক্ষেত্রে এই লক্ষ্যমাত্রা ২০৩৫ সালের মধ্যে ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ। (ইনডিপেনডেন্ট, ৫ মে, ২০১৭)। বিপরীতে বাংলাদেশের সদ্য প্রণীত পাওয়ার সেক্টর মাস্টার প্ল্যান (পিএসএমপি-২০১৬) অনুসারে ২০৪১ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং আমদানি করা বিদ্যুৎ মিলিয়ে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা মোট উৎপাদনের মাত্র ১৫ শতাংশ। বিপরীতে কয়লা এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা যথাক্রমে ৩৫ এবং ১০ শতাংশ।

অথচ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বাধীন বিশেষজ্ঞ মহলের গবেষণাগুলোয় হিসাব কষে দেখিয়ে দেওয়া হচ্ছে, কোন উৎস থেকে কী পরিমাণ বিদ্যুৎ কত টাকা বিনিয়োগে উৎপাদন সম্ভব। সদ্য প্রকাশিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দলের প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ থেকে জানা যাচ্ছে যে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মোট বিদ্যুৎ চাহিদা নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকেই মেটানো সম্ভব; আর তাতে করে প্রতিবছর মাথাপিছু সাশ্রয় হবে দুই হাজার টাকা (Jacobson et al., 2017)। কিন্তু এই সুলভ বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে প্রয়োজন সর্বব্যাপী উদ্যোগ আর রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ। প্রচলিত কোম্পানিভিত্তিক মডেলে অধিক ব্যবসায়িক মুনাফার নিশ্চয়তা আসতে পারে, কিন্তু তাতে কখনোই সস্তা বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাবে না। আর ঠিক এ কারণেই কমতে থাকা সৌরবিদ্যুতের কালে এসেও বাংলাদেশের কোথাও কোথাও গ্রাহককে ইউনিটপ্রতি ৩০ টাকা পর্যন্ত গুনতে হচ্ছে। (ডেইলি স্টার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৭)। আর বর্তমানে কোম্পানিগুলোর সঙ্গে ১২ টাকা ইউনিটে বিদ্যুৎ কিনতে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি হচ্ছে, যার কারণে সুলভ বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুবিধা সাধারণ মানুষ পাবে না, এই খাত পরিণত হবে শুধুই একচেটিয়া মুনাফার কারবারিতে। (ডেইলি স্টার, ২৮ আগস্ট, ২০১৭)।

কমতে থাকা দাম, সাধারণ মানুষের আগ্রহ আর চলতে থাকা বিদ্যুৎ-সংকট বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার প্রসারে উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি করেছে। কিন্তু নীতিনির্ধারণী মহলে উদ্ভাবনী চিন্তার বন্ধ্যাত্বকালে এই খাত উন্নয়নে আপাতত কোনো আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। তবে ভবিষ্যতে সুলভে বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে গবেষণা বরাদ্দ, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ আর প্রণোদনা বাড়িয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে বিদ্যুৎ উৎপাদনী মূল অবকাঠামোয় বড় আকারে যুক্ত করার কোনো বিকল্প নেই।

লেখক: প্রকৌশলী, জ্বালানিপ্রযুক্তি-বিষয়ক গবেষক।
[email protected]