পেশাজীবী সংগঠনে ভোট উধাও

সাধারণ নির্বাচনের মতো দেশের পেশাজীবী সংগঠনগুলোর আঙিনা থেকেও ভোটের জৌলুশ নির্বাসিত হতে চলেছে। প্রশ্ন জাগছে আমরা কোথায় চলেছি? লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত বাংলাদেশে যেখানে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ সকল পর্যায়ে দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়ানোর কথা, সেখানে বিস্ময়করভাবে এর উল্টো যাত্রাই দিনে দিনে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। একটি গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় দেশের শীর্ষস্থানীয় পেশাজীবী ও সামাজিক সংস্থাগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রচর্চার সঙ্গে জাতীয় রাজনীতির গণতন্ত্রায়ণ প্রক্রিয়ার যোগসূত্র অবিচ্ছেদ্য।
উন্নত বিশ্বে জাতীয় পর্যায়ের পেশাজীবী ও নাগরিক সংগঠনগুলো শক্তিশালী ও কার্যকর প্রেশার গ্রুপ হিসেবে কাজ করে। উপরন্তু কোনো দেশের সিভিল সোসাইটির কার্যকরতাও বহুলাংশে দলনিরপেক্ষ পেশাজীবী সংগঠনগুলোর শক্তি-সামর্থ্যের ওপর নির্ভর করে। ভোটের ঐতিহ্যমণ্ডিত ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো থেকে ভোট উধাও হয়ে যাওয়ার যে তথ্য গতকাল প্রথম আলোয় ছাপা হয়েছে, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
এফবিসিসিআই ও বিজিএমইএ ছাড়াও দেশের জেলা পর্যায়ের ৬৪টি বণিক সমিতির মধ্যে ৪৭টিতেই (পূর্ণাঙ্গ ভোট মাত্র ১১টিতে) ভোটাভুটি ছাড়া কমিটি এবং কমপক্ষে ২০টির (৫টি করে চেম্বারের শীর্ষ পদে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতারা) সভাপতি পদে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতারা আসীন হয়েছেন। এই প্রবণতা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, সামনের দিনগুলোতে বাদবাকি কমিটিগুলোও একই দশায় পতিত হতে পারে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আইনজীবী ও চিকিৎসকসহ অন্যান্য কিছু পেশাজীবী সংগঠনেও দূষণ প্রকট হয়ে উঠছে। ঢাকা আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে মারামারি এবং বিভক্ত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাচনে জাল ভোটের বিস্তারের অভিযোগ আমাদের আরও বিচলিত করছে। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি তার আশির দশকের দলনিরপেক্ষ নির্বাচনের গরিমা হারিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে সাদা ও নীল দলের কোন্দল এখন আর কোনো লুকোছাপা বিষয় নয়। ডাকসু নির্বাচনের একটা তোড়জোড় শোনা যাচ্ছে, কিন্তু এই নির্বাচন আগেকার সেই গৌরবময় নির্বাচনের কৌলীন্য পুনরুজ্জীবিত করবে, নাকি তা চলতি হাওয়ার ‘পন্থী’ হবে, সেটা আরেকটি বড় প্রশ্ন।
সামাজিকভাবে সর্বত্র গোপন ব্যালট এবং ভোটাধিকারের যে পবিত্রতা, তা নানাভাবে ক্রমাগতভাবে নিচের দিকে নামছে। অথচ অংশীজনদের মধ্যে এ নিয়ে অন্তত প্রকাশ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। ভোটাভুটির মর্যাদাহানির সঙ্গে প্রার্থী যাচাই–বাছাইয়েও একটি অভিন্ন রুগ্‌ণ প্রবণতা ক্রমেই আরও পরিষ্কার হচ্ছে। সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ ফ্যাক্টরগুলো আর নেতা বাছাইয়ের মূল নিয়ামক হিসেবে টিকছে না। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হওয়া ব্যক্তিদের মনোনয়নও আসছে বাইরে থেকে। আবার যেখানে গোপন ব্যালটে নির্বাচন হচ্ছে, সেখানেও গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মুখ থুবড়ে পড়ছে। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি বা সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সম্পাদকের মতো শীর্ষ পদগুলোতে কারা প্রার্থী হবেন, তা বড় দলগুলোর উচ্চপর্যায়ে ঠিক হচ্ছে।
সব মিলিয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার আড়ালে একধরনের গোষ্ঠী ও পরিবারতান্ত্রিকতার দুর্ভাগ্যজনক প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ঘটছে। প্রভাবশালী পেশাজীবী সংগঠনগুলো সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির বৃত্তে বন্দী হলে কোটারি হিসেবে তারা পরবর্তী সময়ে দলীয় রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠতে পারে। রাজনীতি আরও দূষিত হবে। তাঁরা সংসদে মনোনয়ন লাভে আরও উৎসাহী হবেন। দশম সংসদের সাংসদ হওয়া ১৭৫ জনের পেশা ব্যবসা, ফলে সংসদে ব্যবসায়ীদের হার এখন ৫০ শতাংশ। এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ চাইলে শুধু রাজনৈতিক দলগুলোকে দুষলে চলবে না। রাজনীতিকরণের এই দূষণ থেকে সংগঠনগুলো নিজেদের বাঁচাতে না পারলে পেশাজীবীদের ও নিজ অঙ্গনের বৈধ স্বার্থ বিপন্ন হবে।
সুতরাং অংশীজনদের জাগতে হবে। আপনারা নিজেরা বঁাচুন, নিজেদের সংগঠন বাঁচান, সুশাসন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাঁচতে, শক্তি জোগাতে
সহায়তা দিন।