ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্ন করতে বেপরোয়া ট্রাম্প!

মুসলিম, ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের কাছে পবিত্র স্থান বলে বিবেচিত। ছবি: রয়টার্স
মুসলিম, ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের কাছে পবিত্র স্থান বলে বিবেচিত। ছবি: রয়টার্স

ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্ন করতে যেন বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর এবার সেখানে মার্কিন দূতাবাস স্থাপনের তোড়জোড় শুরু করেছেন তিনি। যার অর্থ দাঁড়ায়, জেরুজালেম থেকে ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলা।

ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েলি দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তর করবেন। এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে তাঁর ওপর ইসরায়েলপন্থী মার্কিন রাজনীতিকদের প্রচণ্ড চাপ রয়েছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র তার ইসরায়েলি দূতাবাস জেরুজালেমে স্থাপন করলে পক্ষান্তরে সেটা হবে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের মালিকানা হিসেবে ওয়াশিংটনের স্বীকৃতি।

এই জেরুজালেম মুসলিম, খ্রিষ্টান ও ইহুদি—সবার কাছেই পবিত্র বলে বিবেচিত। শত শত বছর ধরে জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ নিতে স্থানীয় বাসিন্দা, আঞ্চলিক শক্তি ও আক্রমণকারীরা লড়াই করেছে। এর মধ্যে ছিল মিসরীয়, ব্যাবিলনীয়, রোমান, মুসলিম, ক্রুসেডার, অটোমান, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো। সর্বশেষ এই পবিত্র ভূমি দখলে মরিয়া হয়ে উঠেছে দখলদার ইসরায়েল।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স

গত ৬ ডিসেম্বরে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেন ট্রাম্প। এই ঘোষণার পর ফিলিস্তিনিরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বিশ্বজুড়ে ট্রাম্পের ঘোষণার সমালোচনা শুরু হয়। জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে ট্রাম্পের স্বীকৃতি প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে ২১ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভোটাভুটি হয়। তাতে ট্রাম্পের ঘোষণা প্রত্যাখ্যাত হয়। ভোটাভুটিতে ১২৮ সদস্য ট্রাম্পের ঘোষণা প্রত্যাহারের পক্ষে ভোট দেয়। বিপক্ষে ভোট দেয় মাত্র নয়টি দেশ। ৩৫টি দেশ ভোট দানে বিরত থাকে।

কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এই অবস্থানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ট্রাম্প তোড়জোড় শুরু করেছেন জেরুজালেমে দূতাবাস স্থানান্তর নিয়ে। ওয়াশিংটন আগেই আভাস দিয়েছিল, তারা তাদের ইসরায়েলি দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে সরিয়ে নেবে। গত জানুয়ারিতে ইসরায়েল সফরের সময় মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেনস ঘোষণা করেন, ২০১৯ সাল শেষ হওয়ার আগেই মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তর করা হবে। কিন্তু গত ২৩ ফেব্রুয়ারি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র হেথার নুয়েরট জানিয়ে দিলেন, ২০১৯ সাল নয়, চলতি বছরের মে মাসেই জেরুজালেমে দূতাবাস স্থানান্তর করবে ইসরায়েল। তিনি এটাও জানিয়ে দেন, ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ৭০তম বার্ষিকী সামনে রেখে মে মাসেই দূতাবাস স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ইসরায়েল আগামী ১৫ মে তার ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্‌যাপন করবে।

বর্তমানে পূর্ব জেরুজালেমে মার্কিন কনস্যুলেট রয়েছে। এই কনস্যুলেট মূলত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকা ও ফিলিস্তিনিদের বিষয়ে মার্কিন স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো দেখে। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, এই কনস্যুলেট আগের মতোই দায়িত্ব পালন করতে থাকবে।

জেরুজালেমকে ইসরায়েলয়ের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি এবং তেল আবিব থেকে দূতাবাস স্থানান্তর—দুটিই ট্রাম্পের পূর্বসূরিদের ইসরায়েল-ফিলিস্তিন নীতির বিরোধী। শুধু তা-ই নয়, কয়েক দশক ধরে চলমান শান্তি প্রক্রিয়ায় ‘দুই রাষ্ট্র সমাধানের’ নীতিপরিপন্থী ট্রাম্পের এসব সিদ্ধান্ত। ট্রাম্পের আগের মার্কিন নেতারা সবাই ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে চলমান সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের পক্ষে ছিলেন।

জেরুজালেম প্রশ্নে ট্রাম্পের এই বেপরোয়া নীতি ফিলিস্তিন ভূখণ্ডকে অগ্নিগর্ভ করে তুলবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পূর্ব জেরুজালেম হবে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী—এটাই নিপীড়িত ফিলিস্তিনিদের দাবি। জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস হওয়া মানে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে জেরুজালেমের নাম মুছে ফেলা। যার অর্থ হলো, পবিত্র ভূমি জেরুজালেম থেকে ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলা।

আরব নেতারা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা সিদ্ধান্ত মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তি উসকে দেবে। ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের মুখপাত্র নাবিল আবু রাদাইনা বলেন, এটা ট্রাম্পের একেবারেই অগ্রহণযোগ্য পদক্ষেপ। এমন একতরফা সিদ্ধান্ত কাউকে বৈধতা দেবে না; বরং শান্তিপ্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তুলবে।

তবে এসব আশঙ্কাকে থোড়াই কেয়ার করেন ট্রাম্প। বিশ্বব্যাপী সমালোচনা সত্ত্বেও জেরুজালেম প্রশ্নে নিজের নীতিতে অটল ট্রাম্প। তিনি বলেছেন, ‘আমি এটা বলেছি, কারণ আমিই এটা করতে পারি। যদিও অনেক দেশ, অনেক মানুষ আমাকে এটা না করতে বলেছেন। আমি বলেছি, আমরা এটা করব। এটাই ঠিক।’

১৯১৭ সালে ‘বেলফোর ঘোষণার’ পর যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনি ভূমিতে ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ইসরায়েল। ওই বছরই আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডসহ বেশ কিছু আরবভূমি দখল করে নেয় ইসরায়েল। এরপর ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ফিলিস্তিনের প্রায় পুরোটাই ও মিসরে সিনাইয়ের কিছু ভূমিও দখল করে ইসরায়েল। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের জন্য যে সীমানা বরাদ্দ রেখেছিল, বর্তমানে তার অর্ধেকও ফিলিস্তিনিদের নিয়ন্ত্রণে নেই। পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে ফিলিস্তিনিদের হটিয়ে তাদের জমির ওপর প্রায় সাড়ে ছয় লাখ ইহুদিবসতি গড়ে তুলেছে দখলদার ইসরায়েল।

মাহফুজার রহমান: সাংবাদিক
[email protected]