আন্তর্জাতিক নারী দিবস

আজ ৮ মার্চ। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের নারীসমাজকে আমরা আন্তর্জাতিক নারী দিবসের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি। এ বছরের নারী দিবসে জাতিসংঘের স্লোগান ‘নারীর সমতা সকলের প্রগতি’। নারীর প্রতি সব রকম বৈষম্য ও অন্যায়-অবিচারের অবসান ঘটিয়ে একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক বিশ্ব গড়ার কাজে পুরুষের সমান অবদান রাখার প্রত্যয় নিয়ে নারীর এগিয়ে চলা আরও বেগবান হোক।
এ দিবসটি এক শতাব্দী-প্রাচীন আন্তর্জাতিক দিবস। ১৯০৯ থেকে ১৯১১ সালের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডে সূচিত এই দিবস পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীনসহ পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে উদ্যাপিত হয়। জাতিসংঘ দিবসটি উদ্যাপন শুরু করে ১৯৭৫ সাল থেকে। এখন আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদ্যাপিত হয় বিশ্বের প্রায় সব দেশেই।
বাংলাদেশেও আমরা প্রতিবছর দিবসটি উদ্যাপন করি। নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন চলে, সংবাদমাধ্যমে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়। কিন্তু উন্নত বিশ্ব ও বাংলাদেশের নারীর অবস্থার মধ্যে বেশ পার্থক্য আছে। এ দেশে নারীসমাজ আজও সব ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে। ‘ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন সার্ভে ২০১১’ নামে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপের তথ্য হলো, দেশের ৮৭ শতাংশ বিবাহিত নারী আপন গৃহেই নির্যাতনের শিকার। ৬৫ শতাংশ স্বামীর মাধ্যমে শারীরিক নির্যাতন, ৩৬ শতাংশ যৌন নির্যাতন, ৮২ শতাংশ মানসিক এবং ৫৩ শতাংশ স্বামীর মাধ্যমে অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও ধর্ষণ, অ্যাসিড নিক্ষেপ, যৌতুকের দাবিতে নির্যাতনসহ নানা রকমের সহিংসতা দমনে রাষ্ট্র ও সমাজের ব্যর্থতার পাল্লা যেন দিনে দিনে আরও ভারী হচ্ছে। পথে-ঘাটে ও কর্মক্ষেত্রে তো বটেই; ঘরের ভেতরেও নারীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তাহীনতা দূর হচ্ছে না।
অথচ সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের বিস্ময়কর সাফল্যের পেছনে নারীর বিরাট ভূমিকা রয়েছে। সামাজিক-সাংস্কৃতিক-মনস্তাত্ত্বিক বৈষম্য ও নিরাপত্তাহীনতা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টির ক্ষেত্রে নারীর অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। লিঙ্গসমতা সূচকে এ দেশের নারীদের অবস্থান এখন পার্শ্ববর্তী ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের নারীদের তুলনায় উন্নত হয়েছে। কিন্তু অধিকারের সম্পূর্ণ সমতা আসেনি। চাকরির ক্ষেত্রে নারী সমান সুযোগ থেকে বঞ্চিত; নিম্ন আয়ের শ্রমজীবীদের মধ্যে নারী পুরুষের চেয়ে কম মজুরি পান। স্থানীয় সরকার পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়নের চেষ্টা খুব ফলপ্রসূ হচ্ছে না তাঁদের পুরুষ সহকর্মীদের পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। জাতীয় রাজনীতিতেও নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ বাড়েনি, নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় নারীর গুরুত্বও বাড়ছে না। কিন্তু শিক্ষার সকল পর্যায়েই দেখা যাচ্ছে, নারীরা পুরুষের সমান মেধার পরিচয় দিচ্ছেন।
নারীর সম-অধিকারের প্রশ্নটি কেবল নারীসমাজে অগ্রগতির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। বস্তুত, এতে রয়েছে নারী-পুরুষের মিলিত বিশ্বে সর্বজনীন প্রগতির প্রতিশ্রুতি। আমাদের সমাজে নারী-পুরুষ সমতা অর্জনের পথে পশ্চাৎমুখী দৃষ্টিভঙ্গি এক বিরাট বাধা। শিক্ষায় নারীর আরও অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বক্ষেত্রে সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে অবশ্যই পরিবর্তন আসবে বলে আমাদের বিশ্বাস।