বিলম্বিত বিচার সাজা কম হওয়ার অন্যতম কারণ

ডিএমপির কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। ছবি: ডিএমপির ওয়েবসাইট থেকে সংগৃহীত
ডিএমপির কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। ছবি: ডিএমপির ওয়েবসাইট থেকে সংগৃহীত
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের বেশ কিছু মামলা নিয়ে দীর্ঘ তদন্ত ও অনুসন্ধান করেছে প্রথম আলো। এতে দেখা যাচ্ছে, পুলিশ আসামি গ্রেপ্তার করে, মামলা তদন্ত করে প্রতিবেদন দেয়। কিন্তু আদালতে গিয়ে মামলাগুলো আর টিকছে না। সাজার হার খুবই কম। এ বিষয় নিয়ে সম্প্রতি প্রথম আলোকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন গোলাম মর্তুজাআসাদুজ্জামান

প্রথম আলো: সাজার হার কম হওয়ার বিষয়টা কি আপনি জানেন? কেন এমন হচ্ছে বলে আপনি মনে করেন? 
আছাদুজ্জামান মিয়া: একেকটি মামলা প্রমাণের বিষয় সাক্ষী, প্রসিকিউশন ও আলামতের ওপর নির্ভরশীল। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলা বস্তুগত সাক্ষ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। এসব মামলায় অনেক ক্ষেত্রে বস্তুগত সাক্ষ্য কম থাকে এবং মৌখিক সাক্ষ্যের ওপর নির্ভরতা বেশি থাকে, যা আদালতে প্রমাণ করা কষ্টসাধ্য। ফলে সাজার হার কম হয়ে থাকে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলা সাধারণত পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যা থেকে উদ্ভূত। মামলার বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হতে বিলম্ব হয় এবং প্রায়ই বাদী-বিবাদীদের মধ্যে আপস হয়ে যায়। সাজার হার কম হওয়ার ক্ষেত্রে এটি একটি অন্যতম কারণ। এসব মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ, প্রসিকিউশন ও সাক্ষীদের সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে আদালতে মামলা প্রমাণের কার্যক্রম পরিচালিত হলে মামলার গুণগত সাজার মাত্রা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে। 

প্রথম আলো: আদালতের কর্মকর্তা, আইনজীবী, পিপিরা প্রথম আলোকে বলেছেন, মামলার প্রতিবেদন দেওয়ার পরে পুলিশ মামলাটির আর কোনো খোঁজই রাখে না। এমনও মামলা পাওয়া যায়, যেখানে পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা থেকে পুলিশের কেউ আদালতে সাক্ষী দিতে যাননি। প্রসিকিউশনের সাক্ষী হাজির করার কথা পুলিশের, কিন্তু আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে পুলিশ কর্মকর্তাদেরই হাজির করতে পারেন না—এমন নজিরও আমরা দেখেছি। এই পরিস্থিতি কেন হচ্ছে? 
আছাদুজ্জামান মিয়া: আদালত মামলা-সংশ্লিষ্ট যেকোনো বিষয়ে যোগাযোগ করলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিয়ে থাকে এবং যেসব মামলায় পুলিশ সাক্ষী হিসেবে চার্জশিটে বিবেচিত হয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আদালতের তলবমতে পুলিশ সাক্ষ্য প্রদান করে থাকে। আমাদের ‘পারসোনাল ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’-এর (পিআইএমএস) মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সাক্ষীকে দ্রুততম সময়ে আদালতে হাজির হয়ে সাক্ষ্য প্রদানের জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে সাক্ষীর প্রসেস রেজিস্ট্রার ও সাক্ষীর উপস্থিতির হাজিরা রেজিস্ট্রার তদারকির মাধ্যমে সাক্ষীর উপস্থিতির বিষয়ে বহুলাংশে সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

প্রথম আলো: কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গেও প্রথম আলোর কথা হয়েছে। তাঁরা বলেছেন তাঁদের ব্যস্ততা, বদলি ও কাজের চাপের কথা। কিন্তু তাঁরা আবার পাল্টা অভিযোগ করেছেন যে আদালতে সাক্ষী পাঠানোর পর অনেক সময়ই তাঁদের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয় না। এ কারণে সাক্ষীরা হতাশ হয়ে আর আদালতে যেতে চান না। এ বিষয়গুলো আপনার সহকর্মীরা আপনাকে জানান কি না? এর প্রতিকারের উপায় কী হতে পারে বলে আপনি মনে করেন? 
আছাদুজ্জামান মিয়া: পুলিশ সাক্ষী আদালতের তলব মোতাবেক অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সাক্ষ্য প্রদান করবেন, তাই বাঞ্ছনীয়। রাষ্ট্রপক্ষ সরকারি কৌশলী ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে দ্রুততম সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করার জন্য আদালতে উপস্থিত সাক্ষীর জবানবন্দি গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে উপস্থিত সাক্ষীদের হাজিরাসংক্রান্ত রেজিস্ট্রার কার্যক্রমের তদারকি করলে আরও সুফল পাওয়া যাবে।

প্রথম আলো: পুলিশ কর্মকর্তারা আমাদের জানিয়েছেন, নারী ও শিশু মামলার তদন্ত প্রতিবেদন সময়মতো বা ঠিকমতো না দিলে তাঁদের জবাবদিহি করতে হয়। কিন্তু আদালতে যাঁরা মামলা পরিচালনা করেন, সেই পিপিদের কোনো জবাবদিহি নেই। তাঁরা একের পর এক মামলা হেরে গিয়েও দিব্যি বছরের পর বছর পিপির পদ ধরে রাখছেন। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কী? 
আছাদুজ্জামান মিয়া: মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এবং পিপিরা আসামিদের সাজা নিশ্চিতকরণের জন্য নিজেদের অবস্থান থেকে পেশাদারি নিয়ে কাজ করলে এবং প্রতিটি মামলার বিষয়ে সম্যক অবহিত থাকলে এ অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব।

প্রথম আলো: থানাগুলো খোঁজ রাখছে না তাদের তদন্ত করা মামলাগুলো আদালতে গিয়ে কী হচ্ছে। ওসিরা বলতে পরছেন না তাঁদের থানার কত মামলা আদালতে চলমান। অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য পুলিশের কি নিয়মিত মামলার তদারক করা উচিত বলে আপনি মনে করেন? 
আছাদুজ্জামান মিয়া: আদালতে মামলা চলাকালীন আসামি হাজির করা, আলামত উপস্থাপন করা, সাক্ষী উপস্থাপনসহ বিভিন্ন বিষয়ে থানা-পুলিশের সঙ্গে আদালতের নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। প্রসিকিউটররা তাঁদের নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে থেকে মামলা পরিচালনা করে থাকেন। সংশ্লিষ্ট বিভাগের নিবিড় তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তির বিষয়টি নজরে রাখলে ভালো ফল পাওয়া সম্ভব।

প্রথম আলো: ধর্ষণের পর শিশু হত্যার মতো গুরুতর অপরাধের অনেক মামলায় পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিচ্ছে। বাদীপক্ষ পুলিশের গাফিলতি বা অসদুপায়ের কথা বলেছে। আবার কোনো কোনো মামলায় সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা ঘটনা উদ্‌ঘাটন করতে না পারার জন্য আগের তদন্ত কর্মকর্তাদের গাফিলতিকে দায়ী করেছেন। কেউ তদন্তে গাফিলতি করেছেন বলে অভিযোগ এলে তাঁদের সাজা বা তিরস্কারের কোনো ব্যবস্থা আছে কি না? এ রকম ব্যবস্থা থাকলে আপনার জানামতে বছরে ডিএমপির কী পরিমাণ পুলিশ সদস্য এ রকম সাজা ভোগ করেন? 
আছাদুজ্জামান মিয়া: তদন্তপ্রক্রিয়া সম্পূর্ণ সাক্ষ্যপ্রমাণের ওপর নির্ভর। তদন্ত কর্মকর্তা সব মামলার ক্ষেত্রে সাক্ষ্যপ্রমাণ পেলে চার্জশিট দেন। এ নিয়মের কোনো ব্যতিক্রম নেই। শিশু ধর্ষণ, হত্যা ও অন্য সব গুরুত্বপূর্ণ মামলা ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্তৃপক্ষের দ্বারা নিবিড় তদারকির মাধ্যমে পুলিশ প্রতিবেদন দাখিল করতে হয়। এ ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই হয়ে পুলিশ প্রতিবেদন দাখিল করে। অধিকন্তু, পুলিশের তদন্তে গাফিলতি বা অসৎ উপায়ের প্রমাণ পেলে সে ক্ষেত্রে ঢাকা মহানগর পুলিশের প্রফেশনাল স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড ইন্টারনাল ইনভেস্টিগেশন বিভাগের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে।

প্রথম আলো: ধর্ষণ বা ধর্ষণের পরে হত্যার অপরাধের প্রাথমিক আলামত সংগ্রহের কোনো সাধারণ দিকনির্দেশনা আছে কি না? 
আছাদুজ্জামান মিয়া: এসব মামলার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত কর্মকর্তা তদন্ত সম্পন্ন করেন। আলামত সংগ্রহে বিশেষ পারদর্শিতা, ভুক্তভোগীকে পরিচর্যা, জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে আন্তরিকতা ও বস্তুগত আলামত সংগ্রহের জন্য দ্রুততম সময়ের ব্যবস্থা নেওয়া ইত্যাদি বিষয়ে মাথায় রেখে তদন্ত শেষ করার বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দেওয়া আছে।

প্রথম আলো: ভুক্তভোগীদের কয়েকজনের সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়েছে। তাঁরা বলেছেন, নারী নির্যাতন, বিশেষ করে ধর্ষণের মতো অভিযোগ নিয়ে থানায় গিয়ে তাঁদের মারাত্মক অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়তে হয়ে। কেউ কেউ বলেছেন, উল্টো পুলিশ তাঁদের খারাপ মেয়ে বলে গণ্য করে। এ রকম অভিযোগ আপনার কানে এসেছে কি না? ধর্ষণ মামলার বিষয়ে থানাগুলোর জন্য সাধারণ নির্দেশনা কী? তার কি সেটা পালন করে। 
আছাদুজ্জামান মিয়া: নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা, বিশেষ করে ধর্ষণের মতো ঘটনায় কোনো ভিকটিমকে যেন থানায় গিয়ে অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়তে না হয়, সে জন্য প্রতিটি থানায় নারী ও শিশুবান্ধব হেল্প ডেস্ক খোলা হয়েছে এবং সেখানে একজন নারী অফিসার নিয়োজিত আছেন। এ ধরনের মামলার ভিকটিম নারী হওয়ায় নারী পুলিশ কর্মকর্তা দ্বারা তদন্তের জন্য উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন রয়েছে।

প্রথম আলো: ঘটনার শিকার নারী ও শিশুরা বা পরিবারগুলো চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে? অনেকে ভয়ে-চাপে আপস করে ফেলেছেন? যার কারণে অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছে অপরাধীরা? পুলিশ-আইনজীবীরা বলেছেন, বিচারপ্রক্রিয়ায় বিলম্ব, আর্থিক ও সামাজিক—সবদিক বিবেচনা করে আপসকে একটা সামাজিক বাস্তবতা বলতে চান তাঁরা। আপনি কি এর সঙ্গে একমত? 
আছাদুজ্জামান মিয়া: আইনের দৃষ্টিতে অপরাধীদের ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। নারী ও শিশু আইনে ভুক্তভোগী ও তার পরিবারের নিরাপত্তা প্রদানের বিষয়টি মাথায় রেখে সব সাক্ষীর আদালতে সাক্ষ্য প্রদানের ক্ষেত্রে পুলিশ নিরাপত্তা প্রদান করে থাকে। চাপের কাছে নতি স্বীকার করে আপস করা বিচারহীনতার লক্ষণ। এ ধরনের প্রক্রিয়া থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।

প্রথম আলো: এই ডিজিটাল যুগে পুলিশ সাক্ষীদের হাজির করা বা তাঁদের জবানবন্দি সংরক্ষণের কোনো ডিজিটাল পথ বের করতে পারে কি না? আসামিদের আনা-নেওয়ার ঝক্কি, যানজট—সব মিলিয়ে এসব থেকে রক্ষা পেতে সামনের দিনগুলোয় আদালতের সাক্ষ্য প্রদানের কোনো যুগোপযোগী পদ্ধতির কথা ভাবছেন কি না? 
আছাদুজ্জামান মিয়া: সময় প্রবাহের দ্রুততম সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করে ন্যায়বিচার প্রদান করা যৌক্তিক দাবিতে পরিণত হয়েছে। ‘পারসোনাল ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ (পিআইএমএস) এবং ক্রিমিনাল ডেটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (সিডিএমএস) ব্যবস্থাকে অধিকতর যুগোপযোগী করে সাক্ষী হাজিরার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিচারকার্য পরিচালনা করা হলে দ্রুততম সময়ে মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব হবে। ফলে ন্যায়বিচার নিষ্পত্তি হবে।